নিজস্ব প্রতিবেদক:
আদালতে তথ্যের অভাবে মামলায় হারছে সরকার। বর্তমানে উচ্চ আদালতে রাষ্ট্র ও জনগণের স্বার্থসংশ্লিষ্ট ৮৬ হাজার ৭২৩টি মামলার ভবিষ্যৎ ঝুলে আছে। বছরের পর বছর ধরে ওসব মামলা নিষ্পত্তি হচ্ছে না। আর তথ্যের অভাবে অধিকাংশ মামলায় সরকার হেরে যাচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীর গাফিলতিতে অনেক মামলায় সরকার হেরে যায়। এ ছাড়া আদালত থেকে এ-সংক্রান্ত যে কোনো মামলার নোটিশ বা আদেশ সঠিক সময়ে মন্ত্রণালয়ে না পৌঁছার কারণেও অনেক মামলার আপিল হয় না। একপর্যায়ে ওসব মামলায় একতরফা রায় হয়ে যায়। তাতে প্রভাবশালীরা সুবিধা পেলেও রাষ্ট্র ও সরকারের বিপুল ক্ষতি হচ্ছে। আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, উচ্চ আদালতে সরকারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট অনিষ্পন্ন মামলাগুলোর মধ্যে রয়েছে পদোন্নতি না পাওয়া, আইন বা বিধি চ্যালেঞ্জ করা, জমির মালিকানা, ভ্রাম্যমাণ আদালতের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করা, গাড়িসুবিধা নগদায়ন নীতিমালা চ্যালেঞ্জ করে রিট এবং জাতীয় গৃহায়ন কর্তৃপক্ষের আবাসন প্রকল্প ও ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন ধরনের স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা। সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন মামলায় অতীতে এমনো দেখা গেছে, পুরো ফাইল গায়েব হয়ে গেছে। আবার ফাইল থেকে গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র ফেলে দেওয়া হয়েছে। ওসব কারণে মামলা সরকারের বিপক্ষে যাচ্ছে। নথির অভাবে ওসব মামলায় সরকার আপিল করতে পারেনি অথবা আপিল করলেও জিততে পারেনি।
সূত্র জানায়, বিগত ২০২০ সালে উপজেলা পরিষদ আইনসংক্রান্ত রিট করা হয়। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পরিষদের মুখ্য নির্বাহী কর্মকর্তা হবেন- উপজেলা পরিষদ আইনের এমন বিধান সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক এবং বাতিল ঘোষণা করে চলতি বছর ২৯ মার্চ রায় দেন হাইকোর্ট। যদিও ৫ এপ্রিল হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগের চেম্বার আদালত। মামলাটি গত প্রায় ৭ বছর উচ্চ আদালতে ঝুলে আছে। তাছাড়া চট্টগ্রাম জেলা ক্রীড়া পরিষদ বনাম সামরিক ভূসম্পত্তি অধিদপ্তরের মধ্যে একটি মামলা ২০১৮ সাল থেকে উচ্চ আদালতে চলমান। কবে শেষ হবে কেউ জানে না। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন বনাম প্রতœতত্ত্ব অধিদপ্তরের মধ্যে একটি রিট মামলা ২০১৮ সাল থেকে চলছে।
বাংলাদেশ রেলওয়ে বনাম গণপূর্ত অধিদপ্তর একটি রিট মামলা ২০১১ সাল থেকে চলছেই। তাছাড়া পণ্যে পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক ব্যবহার আইন ২০১০ চ্যালেঞ্জ করে ৩৪টি রিট পিটিশন দায়ের হয়েছে। প্রতিটির বিষয়বস্তু এক ও অভিন্ন। অথচ এগুলো বছরের পর বছর ধরে চলছে বিভিন্ন বেঞ্চে। একটি বেঞ্চে শুনানি হলে হয়তো মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে যেত। অভিযোগ রয়েছে, অদৃশ্য কারণে বছরের পর বছর মামলাগুলো একত্র করে একটি বেঞ্চে শুনানির উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে চলমান মামলার নোটিশ, রায়, শুনানির তারিখ ইত্যাদি ম্যানুয়ালি জারি হচ্ছে। অনেক সময় এসব মামলার নোটিশ যথাসময়ে মন্ত্রণালয়ে পৌঁছায় না। ফলে সরকারি স্বার্থ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আর সরকারের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালতে হেরে যাওয়া মামলায় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে আপিল করা যাচ্ছে না।
এছাড়াও একটি সরকারি প্রতিষ্ঠান অপর একটি সরকারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করছে। অথচ এ ধরনের সমস্যা নিরসনে মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের একটি কমিটি রয়েছে। সেখানে প্রতিকার না চেয়ে সরাসরি উচ্চ আদালতের দ্বারস্থ হচ্ছে বিবদমান সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া একই বিষয়ে সরকারের বিরুদ্ধে একাধিক মামলা উচ্চ আদালতে চলমান।
এদিকে সরকারের বিরুদ্ধে দায়ের করা উচ্চ আদালতে ঝুলে থাকা মামলার বিষয়ে অভিজ্ঞ আইনবিদদের মতে, কর্মকর্তারা আইন ও বিধি সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান রাখেন না। বিদ্যমান আইনবিধি অমান্য করে কেনাকাটা ও ব্যয় নির্বাহ করে থাকেন। ফলে মামলার উদ্ভব হয়। প্রতিটি মন্ত্রণালয়ের আইন ক্যাডারে কর্মকর্তার সমন্বয়ে একটি উইং থাকা জরুরি। আইন বিধি মেনে কাজ করলে মামলাই হবে না। তাছাড়া রাজনৈতিক বিবেচনায় আইনজীবী নিয়োগের কারণেও সরকার অধিকাংশ মামলায় হেরে যাচ্ছে।
দলীয় বিবেচনায় নিয়োগ পাওয়া আইনজীবীরা যথাযথভাবে সরকারের পক্ষে প্রতিনিধিত্ব করতে পারেন না বা করেন না। যদি সরকার নির্মোহভাবে দলীয় বিবেচনা পরিহার করে পেশাদার আইনজীবী নিয়োগ দেয়, তাহলে এত বেশি মামলায় হারবে না। অন্যদিকে গত মে মাসে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত উচ্চ আদালতে চলমান সরকারি স্বার্থসংশ্লিষ্ট মামলা পরিচালনার বিষয়ে সভায় মামলা সংক্রান্ত বেশ কিছু সমস্যা চিহ্নিত করা হয়। সভার কার্যবিবরণীতে বলা হয়, হাইকোর্ট বিভাগে দায়ের করা সবগুলো রিট মামলাই সরকারের বিরুদ্ধে।
এসব মামলার প্রয়োজনীয় নথি ও কাগজপত্র যথাসময়ে অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসে পৌঁছায় না। সভায় উপস্থিত অ্যাটর্নি জেনারেল অফিসের প্রতিনিধি বলেন, মন্ত্রণালয় ও বিভাগের অসাধু কর্মকর্তা-কর্মচারীরা মামলার তথ্য ও প্রয়োজনীয় কাগজপত্র ধামাচাপা দিচ্ছে। এসব অব্যবস্থাপনা ও জালজালিয়াতি থেকে বেরিয়ে আসতে ই-নথি পদ্ধতিতে অনলাইনে মামলার নোটিশ প্রেরণ ও প্রাপ্তি ব্যবস্থার সুপারিশ করেছে কমিটি।
উচ্চ আদালতে সরকারি স্বার্থসংম্লিষ্ট সব মামলা ব্যবস্থাপনার জন্য একটি অভিন্ন সফটওয়্যার তৈরির সুপারিশ করেছে কমিটি। কমিটির ওই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। ডিজিটাল সিস্টেম চালু হলে মামলার শুরু থেকে নিষ্পত্তি পর্যন্ত সবই ডিজিটাল ব্যবস্থাপনায় করা হবে। সব ধরনের তথ্য অনলাইনে লেনদেন হবে।
আরও পড়ুন
প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের মাঝে সহায়ক উপকরণ হুইল চেয়ার ও ত্রুাচ বিতরণ
পাবনায় ছাত্রলীগ নেতাসহ তিনজন আটক; আগ্নেয়াস্ত্র জব্দ
কার্গো কমপ্লেক্সের সর্বোত্তম ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে…সচিব নাসরীন জাহান