December 26, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, October 3rd, 2023, 4:39 pm

আশুলিয়ায় র‌্যাবের অভিযানে শিশু সন্তানসহ স্বামী-স্ত্রীকে খুনের রহস্য উদঘাটন,আটক ২

জেলা প্রতিনিধি, সাভার:

আশুলিয়ায় বহুল আলোচিত ও ক্লুলেস স্বামী-স্ত্রী ও শিশুসহ একই পরিবারের তিনজন-কে নৃশংসভাবে গলা কেটে হত্যা ও হত্যাকান্ডের মূলহোতা সাগর আলী ও তার স্ত্রী ইশিতা বেগম’কে গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে গ্রেপ্তার করেছে র‌্যাপিড এ্যাকশন ব্যাটালিয়ন র‌্যাব-৪ সিপিসি-২ সাভার নবীনগর র‌্যাব ক্যাম্প।

মঙ্গলবার (৩ অক্টোবর) দুপুরে রাজধানীর কারওয়ান বাজারে র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে এক সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানান র‌্যাব সদর দপ্তরের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইং পরিচালক কমান্ডার খন্দকার আল মঈন।

এসময় তিনি বলেন,নিহত মোক্তার হোসেন ও তার স্ত্রী সাহিদা বেগম আশুলিয়ার একটি পোশাক কারখানায় কাজ করতেন। তার সন্তান মেহেদী হাসান জয় স্থানীয় একটি স্কুলে ৭ম শ্রেণিতে পড়াশোনা করত। ভুক্তভোগী মোক্তার ও তার স্ত্রী চাকরির উদ্দেশে সন্তানসহ বেশ কিছুদিন আগে ঠাকুরগাঁও থেকে আশুলিয়া এলাকায় এসে বসবাস শুরু করছিলেন। এসময় তিনি আরও বলেন, ৯০ হাজার টাকা চুক্তিতে শারীরিক চিকিৎসার কথা বলে বাসায় গিয়ে ইসুবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়। এরপর একে একে কুপিয়ে ও গলা কেটে হত্যা করা হয় ভুক্তভোগী স্বামী-স্ত্রী ও তাদের শিশু সন্তান-কে।

গতকাল রাত্রে র‌্যাব সদর দপ্তরের গোয়েন্দা শাখা ও র‌্যাব-৪ এর একটি দল গোপন সংবাদের ভিত্তিতে গাজীপুরের শফিপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে হত্যাকাণ্ডের মূলহোতা মো: সাগর আলী (৩১) ও তার স্ত্রী ঈশিতা বেগম-কে (২৫) গ্রেপ্তার করে। গ্রেপ্তার সাগর টাঙ্গাইলের মোবারক ওরফে মোগবর আলীর ছেলে। এছাড়া উদ্ধার করা হয় হত্যাাকান্ডের সময় ভিকটিম মোক্তারের কাছ থেকে লুটকৃত আংটি।

গত ৩০ সেপ্টেম্বর আশুলিয়ার জামগড়া ফকির বাড়ির মোড় এলাকার মেহেদী হাসানের মালিকানাধীন ৬ তলা ভবনের ৪ তলার একটি ফ্ল্যাট থেকে দুর্গন্ধ ছড়িয়ে পড়লে ভবনের অন্য ভাড়াটিয়ারা বিষয়টি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে অবগত করে। পরে ফ্ল্যাট থেকে মোক্তার, তার স্ত্রী সাহিদা ও তাদের ১২ বছরের শিশু সন্তান মেহেদীর অর্ধগলিত গলাকাটা মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নৃশংস এ হত্যাকাণ্ডের পর রোববার (১ অক্টোবর) আশুলিয়া থানায় অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে একটি হত্যা মামলা করা হয়।

কমান্ডার মঈন বলেন, প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে গ্রেপ্তার দম্পতি জানান,প্রথমে অর্থের লোভে ও পরে কাঙ্ক্ষিত অর্থ না পেয়ে ক্ষোভ থেকে তাদের হত্যা করা হয়।

ঘটনার বিবরণ দিয়ে র‌্যাব মুখপাত্র বলেন,গত ২৮ সেপ্টেম্বর গ্রেপ্তার সাগর সাভার বারইপাড়া এলাকার একটা চায়ের দোকানে চা খাওয়ার সময় ভিকটিম মোক্তার-কে পাশের একটি কবিরাজি ও ভেষজ ওষুধের দোকানে তার শারীরিক সমস্যার বিষয়ে চিকিৎসা নিয়ে কথা বলতে দেখেন। গ্রেপ্তার সাগর জানতে পারেন,মোক্তার ওই দোকানে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসা বাবদ ১৫-২০ হাজার টাকা খরচ করেও কোনো ফলাফল পাননি। সাগর কৌশলে মোক্তার-কে ডেকে নিয়ে আলাপচারিতায় ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার প্রতি তার আগ্রহ ও আস্থার কথা জানতে পারেন। মোক্তার তার ও তার পরিবারের বেশ কিছু শারীরিক সমস্যার কথাও সাগর-কে জানান।

সাগর জানায়,তার স্ত্রী একজন ভালো কবিরাজ এবং সে তার সমস্যার সমাধান করে দেবে। এমন মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে কথাবার্তার এক পর্যায়ে ৯০ হাজার টাকার চুক্তি করেন। সাগর ও তার স্ত্রী পরদিন (২৯ সেপ্টেম্বর) সকালে ওষুধসহ তার বাসায় গিয়ে চিকিৎসা করবে বলে জানান। যোগাযোগের জন্য মোক্তার-কে সাগর নিজের নম্বর না দিয়ে এক আত্মীয়ের মোবাইল নম্বর দেন।

বাসায় গিয়ে সাগর স্ত্রী ঈশিতা-কে পুরো ঘটনা ও পরিকল্পনার কথা জানান। স্ত্রী নগদ বিপুল অঙ্কের অর্থ পাওয়ার আশায় রাজি হন। তারা পরিকল্পনা করেন ভুক্তভোগী মোক্তারের বাসায় গিয়ে ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার কথা বলে তার পরিবারের সবাই-কে ঘুমের ওষুধ খাইয়ে তাদের অর্থসহ মূল্যবান সামগ্রী লুট করবেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী সাগর গাজীপুরের মৌচাক এলাকার একটি ফার্মেসি থেকে এক বক্স ঘুমের ওষুধ ক্রয় করেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী ২৯ সেপ্টেম্বর সকালে গ্রেপ্তার সাগর ও তার স্ত্রী গাজীপুরের মৌচাক থেকে মোক্তারের সঙ্গে জামগড়া মোড়ে সাক্ষাৎ শেষে বাসায় যান। সেখানে প্রাথমিক পরিচয়ের পর গ্রেপ্তার সাগরের স্ত্রী ঈশিতা তাদের সমস্যার কথা শুনেন এবং ইসবগুলের শরবতের সঙ্গে চেতনানাশক ওষুধ মিশিয়ে তাদের ভেষজ ও কবিরাজি চিকিৎসার ওষুধ বলে খাওয়ান। মোক্তার,তার স্ত্রী ও ছেলে ঘুমের ওষুধের প্রভাবে ঘুমিয়ে পড়লে সাগর ও তার স্ত্রী মিলে প্রথমে মোক্তারের কক্ষে গিয়ে মোক্তারের হাত ও পা বাঁধেন,পরে মোক্তারের স্ত্রীর হাত-পা বাঁধেন।

পরে তারা মোক্তারের মানিব্যাগ,তার স্ত্রীর পার্স ও বাসার অন্য স্থানে অর্থ ও মূল্যবান সামগ্রীর জন্য তল্লাশি করে মাত্র ৫০০০ টাকা পান। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে বাসার বটি দিয়ে প্রথমে মোক্তারের গলায় উপর্যুপরি কোপ দিয়ে হত্যা করেন।

পরে অন্য কক্ষে গিয়ে ছেলে ও স্ত্রীকে একই বটি দিয়ে পর্যায়ক্রমে কুপিয়ে হত্যা করেন। পালানোর আগে তারা মোক্তারের হাতে থাকা আংটি খুলে নিয়ে যান।
গ্রেপ্তার দম্পতি ভিন্ন পথে রিকশাযোগে গাজীপুরের মৌচাকে তার শ্বশুরবাড়ি যায় এবং সেখানেই অবস্থান করতে থাকেন। হত্যাকাণ্ডের ঘটনা গণমাধ্যমে প্রচারের পর তারা আত্মগোপনে চলে যান। পরে আত্মগোপনে থাকাকালেই গাজীপুরের শফিপুর এলাকা থেকে তাদের গতকাল রাত্রে গ্রেপ্তার হন।

গ্রেপ্তার সাগর সম্পর্কে কমান্ডার মঈন বলেন, সে মাদকাসক্ত এবং বিভিন্ন পেশার আড়ালে চুরি ও ছিনতাই করত বলে জিজ্ঞাসাবাদে জানিয়েছে। ২০২০ সালে টাঙ্গাইলের মধুপুরে ২০০ টাকার জন্য একই পরিবারের চার জনকে চেতনানাশক ওষুধ খাইয়ে একই কায়দায় গলা কেটে হত্যায় অভিযুক্ত সাগর।
ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় সাগর র‌্যাব-১২ কর্তৃক গ্রেপ্তার হয়ে সাড়ে তিন বছর কারাভোগ করে ২০২৩ সালের জুন মাসে জামিন পেয়ে গাজীপুরের মৌচাক এলাকায় তার শ্বশুরের ভাড়া বাসায় কিছুদিন অবস্থান করে।

দীর্ঘদিন জেলহাজতে থাকায় তার আর্থিক অবস্থা ভালো না থাকায় সে রাজমিস্ত্রি,কৃষি শ্রমিকসহ বিভিন্ন পেশার আড়ালে ঢাকা,সিলেট ও টাঙ্গাইলে অবস্থান করে সুযোগ বুঝে চুরি ও ছিনতাই করত।

একটি জেলায় বেশ কিছুদিন অবস্থানের পর স্থান পরিবর্তন করে অন্য জেলায় আশ্রয় নিত সাগর। এছাড়াও সে অবৈধ পথে পার্শ্ববর্তী দেশে জুলাই মাসে গমন করে ২০-২৫ দিন অবস্থান করে এবং আগস্ট মাসে দেশে ফিরে কুমিল্লায় কিছুদিন অবস্থান করে। গ্রেপ্তার দম্পতির বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে বলে জানিয়েছেন র‌্যাবের এ কর্মকর্তা।