নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে গ্যাসের চরম ঘাটতির মধ্যে চুরি ও অপচয় অব্যাহত রয়েছে। বর্তমানে বিশ্ববাজারে বেশি দামের কারণে খোলাবাজার থেকে এলএনজি কেনা বন্ধ রেখেছে সরকার। তাতে গ্যাসের সরবরাহ কমে গেছে দিনে ৩০ কোটি ঘনফুট। তাতেই দেশের বিদ্যুৎ, শিল্প ও আবাসিক খাতে প্রচন্ড সংকট দেখা দিয়েছে। এক দশকের মধ্যে দেশ সবচেয়ে বেশি লোডশেডিংয়ের কবলে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকার বাধ্য হয়ে গ্যাস-বিদ্যুতে নানা পদক্ষেপ নিচ্ছে। কিন্তু তারপরও গ্যাস চুরি ও অপচয় থেমে নেই। জ্বালানি বিভাগ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দেশের বিভিন্ন স্থানে তিতাস গ্যাস অভিযান চালিয়ে বিপুল পরিমাণ অবৈধ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করেছে। কিন্তু একদিকে অবৈধ সংযোগ বন্ধ করা হলেও অন্যদিকে অবাধে সংযোগ নিয়ে গ্যাস ব্যবহার করা হচ্ছে। নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, ঢাকা, গাজীপুর, ময়মনসিংহ জেলার অধিকাংশ এলাকায় লাখ লাখ অবৈধ সংযোগ রয়েছে। মাইলের পর মাইল পাইপলাইন বসিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ উপায়ে গ্রামের পর গ্রামে অবৈধভাবে গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়েছে। আর বছরের পর বছর কিছু স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারীরাই মূলত অবৈধ কারবার চালাচ্ছে।
সূত্র জানায়, অবৈধ সংযোগ ও ওভারলোডের মাধ্যমে প্রতিদিন ১৫-২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস চুরি হচ্ছে। বিতরণ কোম্পানিগুলো তা সিস্টেম লসের নামে চালিয়ে দিচ্ছে। পাশাপাশি সার কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং শিল্প-কারখানার অদক্ষ বয়লার ও জেনারেটরের কারণেও দিনে ২০ থেকে ২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অপচয় হচ্ছে। ওই চুরি ও অপচয় ঠেকানো গেলে গ্যাসের চলমান ঘাটতি মোকাবেলা অনেক সহজ হতো। স্পট মার্কেটের ব্যয়বহুল এলএনজি আমদানির দরকার পড়তো না। বর্তমানে দেশে গ্যাসের চাহিদা ৪২০ কোটি ঘনফুট আর সরবরাহ করা হচ্ছে ২৮০ কোটি ঘনফুট। তার মধ্যে এলএনজি থেকে মিলছে ৫০ কোটি ঘনফুট। অথচ দ্রুত বাস্তবায়নযোগ্য কয়েকটি উদ্যোগ নিলেই স্বল্পসময়েই ৫ থেকে ৬ কোটি ঘনফুট উৎপাদন বাড়ানো সম্ভব। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর গাফিলতিতে ওসব উদ্যোগ মাসের পর মাস ধরে ঝুলে আছে।
সূত্র আরো জানায়, মূলত সিস্টেমলসের নামেই গ্যাসের চুরি বেশি হচ্ছে। সম্প্রতি গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলো গ্যাসের দাম বাড়ানোর প্রস্তাবে সিস্টেম লস দেখিয়েছে ৭-৮ শতাংশ। সঞ্চালন কোম্পানি জিটিসিএল ৪ শতাংশ পর্যন্ত সিস্টেম লস দেখিয়েছে। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, বিতরণ ও সঞ্চালন মিলিয়ে আদর্শ সিস্টেম লস ২.২৫ শতাংশের ওপর হওয়ার কথা নয়। অর্থাৎ কোম্পানিগুলো ৮-১০ শতাংশ বাড়তি সিস্টেম লস দেখাচ্ছে। যার একটা বড় অংশই অবৈধ সংযোগ এবং অনুমোদনের অতিরিক্ত লোড হিসেবে চুরি হচ্ছে। অতিরিক্ত সিস্টেম লস ৭ শতাংশ ধরলেও চুরির পরিমাণ দাঁড়াচ্ছে ২১ কোটি ঘনফুট। আর অবৈধ গ্যাস সংযোগ রোধে বিতরণ কোম্পানিগুলো নিয়মিত অভিযান চালিয়েও খুব বেশি সফলতা পাচ্ছে না। কারণ অবৈধ সংযোগের সঙ্গে তিতাসের কর্মকর্তা-কর্মচারী ও স্থানীয় প্রভাবশালীরা জড়িত। সেজন্যই উচ্ছেদ অভিযান পরিচালনার পরই আবার সংযোগ বসে যায়। ঢাকার কামরাঙ্গীরচর, পুরান ঢাকা, নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার, সোনারগাঁ, রূপগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জের গজারিয়া, নরসিংদীসহ বিভিন্ন এলাকায় অবৈধ গ্যাস সংযোগের রমরমা অবস্থা চলছে। সম্প্রতি তিতাস কামরাঙ্গীরচর এলাকায় বড় ধরনের অভিযান পরিচালনা করে। দেখা গেছে হাইপ্রেশার লাইন ছিদ্র করে ২-৩ ইঞ্চি নিম্নমানের গ্যাসের লোহার পাইপ ও প্লাস্টিকের পাইপ নিয়ে অবৈধ গ্যাস সংযোগ নেয়া হয়েছে। ফলে অধিকাংশ অবৈধ সংযোগ খুবই ঝুঁকিপূর্ণ।
এদিকে গ্যাস খাত সংশ্লিষ্টদের মতে অদক্ষ, পুরোনো যন্ত্রাংশ, বয়লার ও জেনারেটর ব্যবহারের কারণে দেশের সার-কারখানা, বিদ্যুৎকেন্দ্র ও শিল্প-কারখানার বয়লার এবং জেনারেটরে অতিরিক্ত গ্যাস ব্যবহৃত হচ্ছে। দেশের ৪টি সরকারি সার কারখানায় গড়ে ১ টন ইউরিয়া উৎপাদনের জন্য ৪৩ দশমিক ৭২ মিলিয়ন ঘনফুট (এমসিএফ) গ্যাস প্রয়োজন হয়। অথচ আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী একই পরিমাণ সার উৎপাদনের জন্য ২৫ এমসিএফ গ্যাস ব্যব্যহৃত হওয়ার কথা। কল-কারখানায় ব্যবহৃত অধিকাংশ ক্যাপটিভ জেনারেটরের দক্ষতা ১০ থেকে ১৫ শতাংশ। যেখানে একটি দক্ষ কমবাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা প্রায় ৪০-৪৫ শতাংশ। ফলে ক্যাপটিভে পুড়িয়ে যে বিদ্যুৎ পাওয়া যায় সমপরিমাণ গ্যাস দিয়ে দ্বিগুণ বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব। ফলে শিল্প-কারখানার বয়লারেও গ্যাস অপচয় ঘটছে। তাছাড়া অনেক বিদ্যুৎকেন্দ্র বহু পুরোনো হওয়ায় দক্ষতা কমে গেছে। সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দক্ষতা কম। কমবাইন্ড সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর দক্ষতা যেখানে ৪০-৫০ শতাংশ, সেখানে সবচেয়ে দক্ষ সিম্পল সাইকেল কেন্দ্রটির দক্ষতা ৩০ শতাংশের বেশি নয়। দেশের অধিকাংশ সিম্পল সাইকেল বিদ্যুৎকেন্দ্রের দক্ষতা ২০ শতাংশের কম। অনেক কমবাইন্ড সাইকেলের দক্ষতা ৩০ শতাংশে নেমে এসেছে। অদক্ষতা আর পুরোনো বিদ্যুৎকেন্দ্র, সার কারখানা ও শিল্প-কারখানায় দিনে ২০-২৫ কোটি ঘনফুট গ্যাসের অপচয় ঘটছে। আর দেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে জোরালো উদ্যোগ না থাকায় গ্যাস ঘাটতি চরম আকার ধারণ করেছে। যথাযথ পদক্ষেপ না থাকায় বরং গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন কমে গেছে। তার মধ্যেও বিতরণ কোম্পানিগুলো কিছু ছোট ছোট উদ্যোগ নিজেদের গাফিলতিতে মাসের পর মাস ফেলে রেখেছে। সেক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি অবহেলা করছে সিলেট গ্যাসফিল্ডস কোম্পানি। কোম্পানিটির রশিদপুর গ্যাসক্ষেত্রের ৯ নম্বর কূপ ৫ বছর আগেই উৎপাদনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। ওই কূপ থেকে মাত্র আড়াই কিলোমিটার দূরে ৭ নম্বর কূপের প্রসেস প্লান্টের সঙ্গে একটি পাইপলাইন বসালেই ১ থেকে দেড় কোটি ঘনফুট গ্যাস পাওয়া সম্ভব। কিন্তু এতোদিনেও ওই পাইপলাইন বসানো হয়নি।
অন্যদিকে জ্বালানি বিশেষজ্ঞদের মতে, গ্যাসের সিস্টেম লস কখনোই ৭-৮ শতাংশ হতে পারে না। সিস্টেম লসের আড়ালে মূলত চুরির ঘটনা ঘটে। শুধু তিতাস গ্যাসেই দিনে ১৫ কোটি ঘনফুটের মতো গ্যাস চুরি হয়। সিস্টেম লস বলতে পাইপলাইনে লিকেজ, বিভিন্ন সংযোগে গ্যাস বের হওয়া ইত্যাদি ধরা যেতে পারে। কিন্তু দেশে গ্যাস বিতরণ সিস্টেম দুর্বল বলে এত লিকেজ নেই যে দিনে ১৫-২০ কোটি ঘনফুট গ্যাস বেরিয়ে যাচ্ছে। আর সঞ্চালন লাইনে একটু লিকেজ থাকলেই তা বড় ঘটনা হতো। গ্যাসের দাম বাড়ানোর শুনানিতে বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশনের চেয়ারম্যান আবদুল জলিল বলেছিলেন, গ্যাসের আদর্শ সিস্টেম লস হচ্ছে ২ শতাংশের নিচে। বিশ্বের কোথাও ২ শতাংশের ওপরে সিস্টেম লস নেই। ৭-৮ শতাংশ সিস্টেম লস গ্রহণযোগ্য নয়।
এ প্রসঙ্গে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ জানান, সরকার গ্যাস চুরি ঠেকাতে বদ্ধপরিকর। সেজন্য যত কঠোর পদক্ষেপ নেয়া প্রয়োজন তাই নেয়া হবে।
আরও পড়ুন
চিকিৎসার জন্য বেগম খালেদা জিয়ার লন্ডন যাওয়ার দিনে সৃষ্ট যানজটে বিএনপির দুঃখ প্রকাশ
মাসুদা ভাট্টির বিষয়ে রাষ্ট্রপতিকে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের প্রতিবেদন
শীতের সবজির বাজারে স্বস্তি, কমেছে পেঁয়াজ,ডিম-মুরগির দামও