February 18, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, February 2nd, 2025, 1:06 pm

নারী ফুটবলারদের পাশে দাঁড়ান, তাঁরা নিজেরাই জেতেন না, জেতান দেশকে

বাফুফে ভবনের নিচে কোচ পিটার বাটলারকে নিয়ে কথা বলেন সাবিনারা

অনলাইন ডেস্ক:
বাংলাদেশের মেয়েরা আমাদের দুই দুইবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের মুকুট এনে দিয়েছেন। বয়স ভিত্তিক টুর্নামেন্টে তাঁদের সাফল্যের পাল্লা আরও অনেক ভারী। গত বছর নেপালের কাঠমান্ডুর রঙ্গশালা স্টেডিয়ামে নেপালের বিরুদ্ধে ঋতুপর্ণা চাকমার গোলটা চোখে লেগে আছে। ২-১ গোলে বাংলাদেশ জিতেছিল সেই ম্যাচটা।

পরপর দুইবার সাফ চ্যাম্পিয়নের গৌরব আমাদের এনে দিয়েছেন নারী ফুটবলাররা। বাংলাদেশই বর্তমান সাফ চ্যাম্পিয়ন। ২০২৪ সালের অক্টোবরে দেশে ফেরে চ্যাম্পিয়নেরা, হুডখোলা বাসে করে তাদের নিয়ে আসা হয় বিমানবন্দর থেকে। সমস্ত দেশ আনন্দে ভাসতে থাকে।

এই ঋতুপর্ণা ক্যামেরার সামনে স্টুডিওতে আমাকে বলেছেন, ‘আমার পরিবারের আর্থিক দুরবস্থা নিয়ে কথা বলতে একেবারেই সংকোচ নেই। আমার বাবা মারা গেছেন। একমাত্র ভাই মারা গেছে দুর্ঘটনায়। এক বোন নিয়ে আমার নিঃসঙ্গ মা প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে যাচ্ছেন।’ আপনারা অনেকেই ঋতুপর্ণা চাকমার মায়ের ছবি দেখেছিলেন। এক পর্ণকুটিরের সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন ঋতুপর্ণার মা। পরে তাদের একটা বাড়ি করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অভাব কি গেছে ওই পরিবারের?

বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার (বাঁয়ে) ও অধিনায়ক সাবিনা খাতুনবাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের প্রধান কোচ পিটার বাটলার (বাঁয়ে) ও অধিনায়ক সাবিনা খাতুন ছবি: বাফুফে

আপনারা জানেন, তবুও বারবার করে মনে করিয়ে দিতে চাই: এই মেয়েরা যখন প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ত, তখন তারা ফুটবল খেলতে স্কুলমাঠে আসত, কারণ ফুটবল খেললে দুটো বিস্কুট খেতে পাওয়া যায়, কখনো কখনো হয়তো সঙ্গে কলা থাকে। এদের অনেকেই শুধু একটুখানি খাওয়া পাওয়ার আশায় মাঠে আসত।

মায়ের সঙ্গে সাফজয়ী ঋতুপর্ণা চাকমামায়ের সঙ্গে সাফজয়ী ঋতুপর্ণা চাকমাছবি: সংগৃহীত

কতবার বলব, আজ থেকে প্রায় ১০ বছর আগের কথা। ২০১৫ সালে ময়মনসিংহের ধোবাউরার কলসিন্দুর গ্রামের ফুটবলার মেয়েদের ওপরে একটা প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করে। আজকের সানজিদা, মারিয়া, শামসুন নাহাররা তখন অনেক ছোট। অনূর্ধ্ব ১৪। ওরা সারাদিন শুটিং করে। ওদের এই পরিশ্রম দেখে ওদের বলেন, ‘তোমরা অনেক কষ্ট করলে। আমাদের কাছে কিছু চাও।’ ওরা জবাব দেয়, ‘আমাদের একবেলা পেট ভরে ভাত খাওয়ান।’ উত্তরে আমরা বলি, ‘তোমরা আরও বেশি কিছু চাও।’ মেয়েরা এবার বলে, ‘তাহলে আমাদের পেটভরে ভাত খাওয়ান। আর আরও কিছু খাবার আমাদের দিয়ে দেন। আমরা বাড়িতে নিয়ে যাব। আমাদের ভাইবোনেরা খাবে।’

কিন্তু প্রিয় পাঠক, আপনারা কি একবার এই মেয়েদের চোখ দিয়ে সমস্ত বিষয়টা একবার ভাববেন! সাতক্ষীরা থেকে, টাঙ্গাইল থেকে, রংপুর থেকে, রাঙামাটি থেকে ১২/১৩ বছরের মেয়েরা ঢাকায় এসে থাকছে হোস্টেলে, তাদের বাবা-মা পরিবার ছেড়ে। কঠিন শৃঙ্খলাবদ্ধ কঠোর পরিশ্রমে ভরা তাদের একটা দিন। অনেক ভোরে ঘুম থেকে উঠতে হয়, তারপর চলে যেতে হয় মাঠে। অনুশীলন, অনুশীলন। শ্রান্ত হয়ে ফেরে তারা।

পেট ভরে খেতে পারে না। হয়তো এটা তাদের ডায়েট চার্টের কারণে, হয়তো ফুটবল ফেডারেশনের বাজেট বরাদ্দ না থাকায়। বিকেলে আবার মাঠে যাও। এই মেয়েগুলো আমাদের চোখের সামনে বড় হচ্ছে বলে আমি তাদের আমার নিজের মেয়ের মতো করে দেখি। আমার সঙ্গে যখনই দেখা হয়, প্রথম কথা ওদের, ‘খেতে দেন।’ একবেলা ভাত, একবেলা রুটি খেয়ে প্রচণ্ড শারীরিক পরিশ্রম করা মেয়েগুলো এখনো একটু শান্তিমতো ভাত খেতে চায়।

২০২২ সাল পর্যন্ত মেয়েরা কত টাকা করে মাসিক ভাতা পেত জানেন? ৬ হাজার টাকা থেকে ১০ হাজার টাকা। ২০২২ সালে ওরা যখন সাফ চ্যাম্পিয়ন হয়, তারপর তারা বেতন বাড়ানোর জন্য আবেদন-নিবেদন করতে থাকে। এখন সাবিনা, মারিয়াদের মতো সিনিয়রদের বেতন ৫০ হাজার করা হয়েছে। ছোটদের বেতন এখনো ১০ হাজারই রয়ে গেছে। ভাবছেন, ভালোই তো। কিন্তু এই বেতনও অনিয়মিত। অক্টোবরের পর থেকে তারা আর বেতন পাননি। বাফুফের সভাপতি ঘোষণা দিয়েছেন, চ্যাম্পিয়ন মেয়েদের দেড় কোটি টাকা দেওয়া হবে, এটা মেয়েরা এখনো পায়নি। খেলার জন্য মেয়েদের ৫ হাজার দশ হাজার টাকা করে ম্যাচ ফি পাওয়ার কথা ছিল, তাও তাদের দেওয়া হয়নি।

সংবাদ সম্মেলনের পর বাফুফে চত্বরে ফুটবলাররাসংবাদ সম্মেলনের পর বাফুফে চত্বরে ফুটবলাররা

এই মেয়েরা এই বিরূপ সমাজের ভ্রুকুটি উপেক্ষা করে ফুটবল খেলে। তাদের লড়াই তো শুধু নেপাল বা ভারতের বিরুদ্ধে নয়, সমাজের প্রতিক্রিয়াশীল শক্তির বিরুদ্ধে, দারিদ্র্যের বিরুদ্ধে, নিজের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে দুর্ভাবনার বিরুদ্ধে। সম্প্রতি সাংবাদিক সম্মেলনে নারী ফুৃটবলাররা কাঁদছিলেন, দেশের বিভিন্ন স্থানে নারী ফুটবল টুর্নামেন্টে আক্রমণ আর কটাক্ষের কথা মনে করে।

আপনি চিন্তা করুন, ১২ বছরের এক গ্রামীণ বালিকা এসেছে শহরে, হোস্টেলে থাকে, সারাদিন কঠোর প্রশিক্ষণ ও অনুশীলনে কাটে তাদের দিন, পেট ভরে খায় না, এবং বাবা-মা ভাইবোন থেকে থাকে বহুদূরে। আজকে ইনজুরি কিংবা বয়সের কারণে যখন সে খেলার বাইরে চলে যাবে, সে করবেটা কী?

জাতীয় দলের চ্যাম্পিয়ন ফুটবলারদের না হয় আমরা চিনি। তাদের সাফল্য আর ব্যর্থতার কাহিনি আমরা লিখে রাখতেও পারব। কিন্তু সারা দেশে যে শত শত মেয়ে ফুটবল খেলে, তাদের জীবনের কাহিনি কঠিন সংগ্রামের। হয়তো কোনো একটা ম্যাচে খেলতে কেউ নিয়ে গেল আরেক জেলায়, হাতে ধরিয়ে দিল ৫০০ টাকা। যারা জাতীয় দলে ডাক পায় না, বাফুফের ক্যাম্পে আসতে পারে না, তাদের দীর্ঘশ্বাস কোথাও পৌঁছায় না।

২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা ২০২২ সালে দক্ষিণ এশিয়ার চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশের মেয়েরা

এখন যে–মেয়েরা আমাদের দুই দুবার সাফ শিরোপা এনে দিয়েছে, তাদের পাশে দাঁড়াতে হবে। অক্টোবর ২০২৪-এ কাঠমান্ডুতে সাফের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশ হারতে বসেছিল পাকিস্তানের কাছে। সবাই জানে, দিবালোকের মতো স্পষ্ট, ০-১ গোলে দল হারতে বসেছিল কোচ পিটার বাটলারের ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের কারণে। পরে সাংবাদিক সম্মেলনে খেলোয়াড়রা প্রকাশ্যে বলে দিয়েছিলেন যে, হেড কোচ তো সিনিয়র খেলোয়াড়দের দেখতে পারেন না। পাকিস্তানের মতো দুর্বল দলের কাছে হারা যখন নিশ্চিত তখন কোচকে বারবার তাঁর সহকারীরা বলছিলেন কৃষ্ণা, মারিয়া, সানজিদাদের মাঠে নামাতে। শেষে সিনিয়রদের নামানো হয়, সিনিয়রদের কৃতিত্বের কারণেই সেই ম্যাচ ১-১ ড্র হয়।

কোচের সঙ্গে সিনিয়র খেলোয়াড়দের দ্বন্দ্ব তখন থেকেই স্পষ্ট এবং প্রকাশ্য। নভেম্বর, ডিসেম্বর, জানুয়ারি- তিন মাস চলে গেল, এই দ্বন্দ্বের ফয়সালা হলো না কেন? বাফুফে করলটা কী? আজকে কেন ১৮ জন সিনিয়র খেলোয়াড় একযোগে অনুশীলন বন্ধ করে বসলেন? কেন তারা হুমকি দিচ্ছেন একযোগে অবসর নেবার?

২০২৪ সালে সাফ শিরোপা জিতে দেশে ফিরেছে বাংলাদেশের মেয়েরা
বাটলার বলেছেন, তাঁর কিছু যায় আসে না। তিনি জুনিয়রদের নিয়ে আসবেন সামনে। তিনি তো তা-ই চান। তিনি সিনিয়রদের পছন্দ করেন না। কিন্তু আমরা এটা হতে দেব কেন? নারী ফুটবল টিমটা যদি আমরা নিজ হাতে ধ্বংস করি, তাহলে প্রমাণিত হবে যে, এই অভাগা দেশে কোনো কিছুই সুন্দর করে সমাপ্ত করতে আমরা পারি না। ‘আমরা আরম্ভ করি, কিন্তু শেষ করি না।’ নারী ফুটবল দলটা যদি ছন্নছাড়া হয়ে যায়, সারা বাংলাদেশের অসংখ্য তরুণ-তরুণীদের কাছে এটা একটা অশনিসংকেত দেবে।

বাফুফের সভাপতি তাবিথ আউয়াল একটা তদন্ত কমিটি করে দিয়েছেন। আজ ২ ফেব্রুয়ারি বেলা ৩টা থেকে সিনিয়র নারী ফুটবলারদের সঙ্গে কথা বলবেন কমিটির সদস্যরা। আমাদের চাওয়া হলো, মেয়েরা অনুশীলনে যাবে। আমাদের চাওয়া হলো মেয়েরা অবসরে যেতে বাধ্য হবে না।

ছাদখোলা বাসে গর্বিত মেয়েদের হাতে বাংলাদেশের পতাকা
সেটা করার জন্য মেয়েদের কথা শুনতে হবে। ধোঁয়া থাকলে অবশ্যই আগুন আছে। আগুন না নিভিয়ে ধোঁয়া তাড়ানোর জন্য বাতাস করে লাভ নেই। বাটলারের যে সমস্যা আছে, সাফ টুর্নামেন্ট থেকেই তা স্পষ্ট। মেয়েদের যদি সমস্যা থাকে, তাদের কাউন্সেলর দিন, তাদের সঙ্গে কথা বলুন। আমরা, বাইরে থেকে, সমাধানের উপায় বাতলে দেব না। কিন্তু আমরা দেখতে চাই, আমাদের সিনিয়র মেয়েরা হাসিমুখে মাঠে ফিরেছেন।

এই সুযোগে সরকারের কাছে, বাফুফের কাছে কতগুলো করণীয়র তালিকা দিই:

১. সারাদেশে ফুটবলার মেয়েদের নিয়ে পুল গঠন করুন। প্রতিটা মেয়ের জন্য বৃত্তির ব্যবস্থা করুন।

২. সারাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের কোচ, সহকারী কোচের জন্য মাসিক ভাতা দিন।

৩. ঢাকার ক্যাম্পে থাকা মেয়েদের মাসোহারা বৃদ্ধি করুন। তাদের ভাতা যেন তারা নিয়মিত পান, এটা নিশ্চিত করুন।

৪. খেলোয়াড়ি জীবন শেষে মেয়েরা যাতে সমাজে মাথা উঁচু করে চলতে পারে, সে জন্য ব্যাক-আপ পরিকল্পনা ও কর্মসূচি রাখুন।

আমার মনে পড়ছে, কলসিন্দুর গ্রামের নেতাই নদীর তীরে সমবেত আপামর বৃদ্ধ বনিতাদের কথা। ২০২২ সালের ১ অক্টোবর সাফ চ্যাম্পিয়ন মারিয়াদের বাড়ি যাওয়ার জন্য কিশোর আলোর দল নৌকায় উঠেছিল। ওই পারে গ্রামবাসী সমবেত হয়েছিলেন। ওই মুরুব্বিদের আমি জিজ্ঞাসা করেছিলাম, আপনাদের মেয়েরা ফুটবল খেলে, আপনারা আপত্তি করেন না?

কেন আপত্তি করুম- নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধ একযোগে বলে উঠেছিলেন, তারা তো খালি আমগো গ্রামরে জিতায় নাই, তারা আমাগো দ্যাশরে জয় আইনা দিছে, আমরা তাগো সাপোর্ট করি, কইরা যামু। নারী ফুটবলারদের আমাদের ‘সাপোর্ট’ করে যেতে হবে, তারা তো নিজেদের বিজয়ের জন্য সোনালি শৈশব এবং তারুণ্য ক্যাম্পের চার দেয়ালের মধ্যে বন্দী করেনি, বাংলাদেশকে বিজয়ী করার জন্য লড়ে যাচ্ছে।