নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশে কোনো অঘটন ঘটলেই রাজনৈতিক দলগুলোর পরস্পরের বিরুদ্ধে অভিযোগ তোলার ‘প্রতিযোগিতা’ দীর্ঘদিন ধরে চলে আসছে। সম্প্রতি কুমিল্লায় পূজামন্ডপে কোরআন অবমাননার অভিযোগে উদ্ভূত পরিস্থিতিতেও তারই পুনরাবৃত্তি দেখা যাচ্ছে। দুই দল একে অপরকে সন্দেহ করছে, ষড়যন্ত্রও খুঁজছে পরস্পরের বিরুদ্ধে। ঘটনার জন্য একে অপরকে দায়ীও করছে। দুই দলের দায় চাপানোর কৌশল ও পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে উত্তাপ ছড়িয়েছে রাজনীতিতে। দেশও উত্তপ্ত। সহিংসতায় প্রাণও গেছে অন্তত ছয়জনের। এর আগে কক্সাবাজারের রামু, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর, কুমিল্লার মুরানগর, সুনামগঞ্জ ও ভোলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনায় দুই দলকে পরস্পরের বিরুদ্ধে বিষোদগার করতে দেখা যাচ্ছে। পাল্টাপাল্টি অভিযোগ আর দোষ চাপানোর কৌশলে প্রকৃত অপরাধীদের কখনই চিহ্নিত করা যায়নি। এবারও একই আশঙ্কা করে বামপন্থি রাজনীতিকরা বলেছেন, দোষারোপের রাজনীতি মন্দির ভাঙচুরে জড়িতদের পরিচয় আড়াল করবে।
কুমিল্লার ঘটনার পর অন্তত ২২ জেলায় সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা ঘটেছে। বেশ কয়েক জেলায় পুলিশের সঙ্গে বিক্ষোভকারীদের সংঘর্ষের ঘটনাও ঘটে। নোয়াখালীর চৌমুহনী, ফেনী, চাঁদপুরসহ বেশ কয়েকটি জেলায় পরিস্থিতি এখনো বেশ উত্তপ্ত। কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে সবচেয়ে ভয়ানক ও অমানবিক ঘটনাটা ঘটেছে রংপুরের পীরগঞ্জ উপজেলায়। সেখানে অসংখ্য নিরীহ সংখ্যালঘু হিন্দু পরিবারের বাড়িঘরে আগুন দেওয়া হয়েছে, লুটপাট করা হয়েছে অর্থসম্পদ।
কুমিল্লার ঘটনার পর এ নিয়ে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর তদন্ত শেষ হওয়ার আগেই আওয়ামী লীগ এবং বিএনপির নীতিনির্ধারকরা পরস্পরকে দায়ী করে আসছেন। আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রোববার বলেছেন, বিএনপি হচ্ছে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির নাম্বার ওয়ান পৃষ্ঠপোষক। দেশের সব অপকর্ম ও সাম্প্রদায়িকতার জনক হচ্ছে এই দল। রোববার সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিভার্সিটি ল্যাবরেটরি স্কুল অ্যান্ড কলেজে শেখ রাসেলের ৫৮তম জন্মদিন উপলক্ষে আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ উপ-কমিটি আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন।
এদিন নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে হামলা-সহিংতার ঘটনার বিষয়ে দলের অবস্থান তুলে ধরতে সংবাদ সম্মেলন করেছে বিএনপি। দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেছেন, ক্ষমতায় অবৈধভাবে টিকে থাকার জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলার ঘটনা আওয়ামী লীগ ঘটাচ্ছে। দেশের সব অর্জনকে বিসর্জন দিয়ে, ধ্বংস করে আওয়ামী লীগ এ ঘটনাগুলো ঘটাচ্ছে।
দুই দলের এমন বক্তব্যের মধ্যে হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রানা দাশগুপ্ত বলেছেন, রাজনীতিবিদদের ওপর আমাদের কোনো আস্থা নেই। অব্যাহতভাবে হামলার ঘটনা ঘটছে। সাম্প্রদায়িক হামলাকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে উড়িয়ে দেওয়ার সুযোগ আর নেই। আমরা মনে করি ও বিশ্বাস করি, সবটাই পরিকল্পিত।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল রোববার সাংবাদিকদের বলেন, কুমিল্লায় সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা সৃষ্টির চেষ্টাকারীদের চিহ্নিত করা হচ্ছে। আমরা অনেক কিছুই দেখছি, অনেক কিছুই অনুমান করছি। প্রমাণের অপেক্ষায় আছি, প্রমাণ পেলেই সবার সামনে তুলে ধরব। জড়িতদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, চিহ্নিত করার প্রচেষ্টা নেওয়া হয়েছে। আমরা শিগগিরই তাদের অ্যারেস্ট করতে পারব।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, প্রধান দুই দলের মধ্যে বিভিন্ন বিষয়ে বাহাস হতে পারে। রাজনৈতিক বিতর্কের মাধ্যমে অনেক কিছু বের হয়ে আসে। ওই বাহাস যদি হয় দায় এড়ানো কিংবা প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করার কৌশল তাহলে তার মাশুল দিতে হয় জনগণকে।
এর আগে বাংলাদেশে অনেক অঘটনের পর মন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের নেতারা তদন্তের আগেই সমস্বরে তথ্য-প্রমাণ ছাড়াই রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। ফলে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী দায়িত্বশীল ব্যক্তিদের বক্তব্যের বাইরে যেতে পারে না। বিরোধী দলও বরাবরই কোনো প্রমাণ ছাড়া ঘটনার সঙ্গে সরকারি দলের নেতাদের সংশ্লিষ্টতা খুঁজে পাওয়ার দাবি করেন।
শনিবার তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, কুমিল্লার ঘটনায় বিএনপি-জামায়াতসহ ধর্মান্ধ গোষ্ঠী যুক্ত। চট্টগ্রামের রাঙ্গুনিয়া উপজেলা ছাত্রলীগের ত্রিবার্ষিক সম্মেলনে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, এ ঘটনায় সারাদেশে সাম্প্রদায়িক উসকানি দেওয়া হয়েছে। এর পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য ছিল। বিএনপি-জামায়াত সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করে দেশে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে চেয়েছিল।
একই দিন নয়া পল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী বলেন, ‘ইসলাম ধর্ম নিয়ে তথ্য প্রতিমন্ত্রী মুরাদ হাসানের বক্তব্যের পরে ঘটনা ঘটল কুমিল্লায়, এরপরে সারাদেশে টেনশন, উত্তেজনা ও রক্তপাত। চৌমুহনীতে উত্তেজনা বিরাজ করেছে, ১৪৪ ধারা জারি করেছে। কেন এই পরিস্থিতি? মুরাদ হাসান যে বক্তব্য রেখেছে তারপরই এই ঘটনা, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়।’
শনিবার বিভিন্ন স্থানে হিন্দুদের মন্দির ও বাড়িঘরে হামলার কথা উল্লেখ করে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বিএনপিকে অভিযুক্ত করে বলেছেন, এসব হামলা চালিয়েছে সাম্প্রদায়িক এবং স্বাধীনতাবিরোধী শক্তি। তাদের মদদ দিচ্ছে বিএনপি। একই দিন চট্টগ্রামে এক সমাবেশে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের আন্দোলন থেকে দৃষ্টি ফিরিয়ে নিতে সরকার কুমিল্লার ঘটনাকে কেন্দ্র দেশের বিভিন্ন স্থানে সাম্প্রদায়িক হামলা চালাচ্ছে। আগের দিন এক আলোচনাসভায় তিনি বলেন, সরকার সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি বিনষ্ট করার চেষ্টা করছে। সেদিনও আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক বিএনপি-জামায়াতকে দায়ী করে বলেছেন, জাতীয় নির্বাচনকে সামনে রেখে উগ্র গোষ্ঠী এসব ঘটাচ্ছে।
আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টি। দলটির সভাপতি ও সাংসদ রাশেদ খান মেনন শনিবার বলেছেন, সাম্প্রদায়িক হামলা ও মন্দির ভাঙচুরকে কেন্দ্র করে দোষারোপের রাজনীতি ওই সব ঘটনার সঙ্গে জড়িত ষড়যন্ত্রকারীদের প্রকৃত পরিচয়কেই আড়াল করবে। সরকারকে দল-নির্বিশেষেই অপরাধীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এ ঘটনায় জড়িতদের অবিলম্বে গ্রেপ্তার ও বিচার করতে হবে। করোনা প্রতিরোধে শহীদ রাসেল ব্রিগেডের কার্যক্রমের ১০০ দিন উপলক্ষে আয়োজিত ব্রিগেডের স্বেচ্ছাসেবকদের সম্মেলন অনুষ্ঠানে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তৃতায় তিনি এসব কথা বলেন।
নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক বিএনপির মিত্র মাহমুদুর রহমান মান্না শনিবার বলেন, পবিত্র কোরআন অবমাননার খবরে হামলা ও সংঘর্ষের ঘটনা একটি ‘রাজনৈতিক ব্যাপার’। এর জন্য সরকার দায়ী।
শুক্রবার কুমিল্লায় ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা ও ট্রাস্টি ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী বলেছেন, পূজামন্ডপ রক্ষার মূল দায়িত্ব সরকারের, ব্যর্থতার দায়ও সরকারের। বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ। এখানে এই ধরনের হামলা কোনোভাবেই গ্রহণযোগ্য নয়। সরকারের চরম ব্যর্থতায় এ ধরনের ঘটনার পুনরাবৃত্তি হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য ও ১৪ দলের সমন্বয়ক আমির হোসেন আমু ঘটনার দিন এক বিবৃতিতে বলেন, একটি চিহ্নিত মহল হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে কুমিল্লার ঘটনা ঘটিয়েছে।
ষড়যন্ত্র ও গোয়েন্দা ব্যর্থতা দেখছে আ.লীগ সরকার। এ ঘটনায় আওয়ামী লীগ রাজনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে দলের মধ্যে আলোচনা আছে। বরাবরের মতো এ ঘটনায় দেশি-বিদেশি ষড়যন্ত্রও দেখছে দলটি। ঘটনা আঁচ করতে না পারায় বিষয়টি গোয়েন্দা ব্যর্থতা বলে মনে করেন দলের নীতিনির্ধারকরা। তারা এও বলেন, সহিংসতা উসকে দেওয়ার জন্য বিএনপি, জামায়াত ও হেফাজতের হাত দেখছেন নেতারা। একই সঙ্গে আশঙ্কা করছেন, নির্বাচন সামনে রেখে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্টের চেষ্টা আরও হতে পারে।
নোয়াখালী, কুমিল্লা, চাঁদপুরসহ বিভিন্ন স্থানে মন্দিরে হামলার ঘটনায় আওয়ামী লীগ নিজেদের রাজনৈতিক দুর্বলতার বিষয়টিও খতিয়ে দেখছে। পূজা উপলক্ষে দলের নেতাকর্মীদের আগে থেকেই তৎপর থাকার জন্য কেন্দ্রীয়ভাবে মৌখিক নির্দেশনা দেওয়া ছিল। দলের কেন্দ্রীয় পর্যায়ের একাধিক নেতা বলছেন, যেখানে দলের সাংগঠনিক অবস্থা কিছুটা দুর্বল, অভ্যন্তরীণ দ্বন্দ্ব আছে, মূলত সেসব জায়গাতেই এবার হামলার ঘটনা ঘটেছে। এর বাইরে গোয়েন্দা ব্যর্থতাও কাজ করেছে।
অন্যদিকে এ ঘটনায় সরকারের দায় দেখছে বিএনপি। দেশের বিভিন্ন স্থানে হিন্দু সম্প্রদায়ের ওপর হামলার ঘটনায় বিএনপি উদ্বিগ্ন এবং একই সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের ‘গাফিলতি’ও দেখছে। দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করেন, এ ধরনের স্পর্শকাতর ঘটনার পর সরকার যথেষ্ট সময় পেয়েও বিষয়টির গভীরে গিয়ে তা সামাল দেওয়ার চেষ্টা করেনি। তাৎক্ষণিকভাবে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থান নিশ্চিত করার মাধ্যমে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে রাখার ব্যাপারে উদাসীনতার ‘ছাপ’ স্পষ্ট ছিল।
বিএনপি নেতারা মনে করেন, ঘটনার দিন বুধবার সকালে পূজামন্ডপে কোরআন শরিফ পাওয়া গেছে। দুপুরের পর কুমিল্লার বিভিন্ন জায়গায় প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। সন্ধ্যার পর তা সারাদেশের বিভিন্ন জেলায় বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। এতে প্রমাণ হয় পরিস্থিতি সামাল দিতে সরকারের যথেষ্ট সময় পেয়েছে। কিন্তু ঘটনার মর্ম সরকার বোঝেনি নাকি ইচ্ছে করে সময় নষ্ট করেছে, তা খতিয়ে দেখতে হবে।
আরও পড়ুন
আগামী বিজয় দিবস গণহত্যাকারীর শাস্তির রায়ে উদ্যাপন হবে: আসিফ নজরুল
বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে খাসি-মুরগি-মাছ
শুধু সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে নয়, বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্যও প্রয়োজন ঐক্য