অন্য বছরের তুলনায় এবার কোরবানির হাটগুলোতে ছোট গরুর চাহিদা সবচেয়ে বেশি। এরপরই রয়েছে মাঝারি সাইজের গরু। সেই তুলনায় গরু-মহিষ, দুম্বা-উটসহ বড় কোনো পশুর বেচাকেনা নেই বললেই চলে। তাই যারা হাজার হাজার টাকা খরচ করে ব্যাপক যত্ন-আত্তিতে লালন পালন করা বড় পশু বিক্রির উদ্দেশ্যে হাটে নিয়ে এসেছেন, তাদের মাথায় যেন বাজ ভেঙে পড়েছে।
হাট ইজারাদাররা বলছেন, আওয়ামী লীগ নেতাদের আত্মগোপনের প্রভাব পড়েছে কোরবানির পশুর হাটে। বিশেষ করে বড় গরু-মহিষ বিক্রিতে চরম মন্দা দেখা দিয়েছে। সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, আওয়ামী লীগের যেসব নেতা গত বছর ঈদুল আযহায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার এক বা একাধিক গরু কোরবানি দিয়েছেন, এবার তাদের অনেকেই হাটে পা মাড়াচ্ছেন না। তাদের বেশিরভাগ ঘরবাড়ি ও এলাকা ছেড়ে বিদেশে কিংবা অন্যত্র আত্মগোপন রয়েছেন। কেউ কেউ আবার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে উধাও। তাদের অন্য স্বজনদের সামর্থ থাকলেও পাছে কারো নজরে পড়ে, এ ভয়ে প্রায় কেউই বড় পশু কোরবানি দিচ্ছেন না।
এমনকি দলের যেসব কর্মী আওয়ামী লীগের ১৭ বছরের শাসনামলে কোনো ঈদেই ছোট কিংবা মাঝারি সাইজের গরু কোরবানি দিতে বাদ দেননি, তারাও এবার দ্বিধা-দ্বন্দ্বে রয়েছেন। তাদের কেউ কেউ নিকটাত্মীয়-স্বজন কিংবা বন্ধু-বান্ধব বা সহকর্মীদের সঙ্গে ভাগে ছোট আকারের পশু কোরবানি দিয়ে কোনোরকমে মুখ রক্ষা করছেন। অনেকে আবার তাতেও সাহস পাচ্ছেন না।
স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়, রাজনৈতিক বড় নেতারা অনেকেই ধর্মীয় নির্দেশনা পালনের চেয়ে দলীয় কর্মীদের তুষ্ট রাখার বিষয়ে বেশি গুরুত্ব দিয়ে বিশাল আকৃতির এক বা একাধিক গরু-মহিষ কোরবানি দিতেন। কর্মীদের পাশাপাশি আত্মীয়-স্বজন, বন্ধু-বান্ধব ও সহকর্মীদের মাঝে মাংস বিতরণ করে নিজের নেতৃত্ব জাহির করতেন। এছাড়া কোন নেতা কত বড় গরু কোরবানি দিচ্ছেন, তা নিয়েও চলতো এক ধরণের প্রতিযোগিতা। তবে রাজনৈতি পট পরিবর্তনের পর তারা নিজেরাই এখন নানা ধরণের সংকটে রয়েছেন। তাই কোরবানির এ ইস্যু নিয়ে চলমান পরিস্থিতিতে অনেকেরই কোনো মাথাব্যথা নেই। ফলে কোরবানির পশুর হাটে আওয়ামী লীগের বিশাল নেতাকর্মীর অনুপস্থিতির মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে বেচাবিক্রিতে।
এদিকে হাট ইজারাদার ও পশু ব্যবসায়ীসহ অনেকেই কোরবানির পশু বিক্রিতে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের অনুপস্থিতির বিষয়টিতে সর্বাধিক গুরুত্ব দিলেও অর্থনীতিবিদরা অনেকেই বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের অভিমত, শুধু এই এক ইস্যুতেই কোরবানির পশুর হাটের বিক্রিতে মন্দা দেখা দেয়নি। এর নেপথ্যে আরও বেশকিছু কারণ রয়েছে। এটি অর্থনৈতিক সংকট, মূল্যস্ফীতি, সামাজিক প্রবণতার পরিবর্তন ও রাজনৈতিক বাস্তবতার যৌথ ফল।
সংশ্লিষ্টদের ভাষ্য, চাল, ডাল, তেল, পেঁয়াজ, চিনির মতো নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের মূল্য বেড়ে যাওয়ায় মানুষের সঞ্চয় কমে গেছে। মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রেণির মানুষের আয় অনেক দিন ধরে বাড়েনি, কিন্তু খরচ বেড়েছে। এছাড়া ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ায় ব্যবসায়ী ও সাধারণ মানুষ ঋণ নিয়ে পশু কেনার ক্ষেত্রে পিছিয়ে যাচ্ছে। তাই অনেকেই এবার কোরবানি না দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন বা ভাগে ছোট পশু নিচ্ছেন।
অন্যদিকে ট্রাকভাড়া ও অন্যান্য খরচ বাড়ায় যার প্রভাব সরাসরি গরুর দামের উপর পড়েছে। হাটে অতিরিক্ত হাসিল, অঘোষিত চাঁদা বা সিন্ডিকেটের কারণে দাম বেড়ে গেছে। তাই বিক্রেতারা বেশি দাম হাঁকতে বাধ্য হচ্ছেন। ফলে ক্রেতা কমেছে, বিক্রিতে মন্দা নেমেছে।
আগে কয়েকজন মিলে বড় গরু কিনতেন, এখন সেই ধারা কমেছে নিরাপত্তা ও আস্থা সংকটে। শহরে কোরবানি করতে অনেকেই অনিচ্ছুক, কারণ পরিচ্ছন্নতা, কসাই, পরিবেশ ও বর্জ্য ব্যবস্থাপনা নিয়ে সমস্যা। অনলাইন কোরবানির প্রতি ঝোক বাড়লেও আস্থা কমেছে। কারণ অনেকে অনলাইন কোরবানির দিকে ঝুঁকে প্রতারণার শিকার হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আস্থায় ধস নেমেছে।
দেশের বিভিন্ন হাটের ক্রেতা-বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে যায়যায়দিনের প্রতিনিধিরা জানান, ছোট ও মাঝারি সাইজের গরুর ক্রেতা সবচেয়ে বেশি। বিক্রেতাদের মধ্যেও যারা এই আকারের গরু নিয়ে বাজারে এসেছেন তাদের বিক্রি ভালো হচ্ছে। তবে বড় গরু নিয়ে হাটে আসা বেপারী ও গৃহস্থরা পড়েছেন চরম বিপাকে। তাদের গরু বিক্রি দূরে থাক, অনেকের গরু কেউ দামাদামিও করছে না।
গাবতলীর স্থায়ী পশুর হাটের ইজারাদার ও ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলেও একই ধরণের তথ্য পাওয়া গেছে। কুষ্টিয়ার মেহেরপুর থেকে ২১টি ছোট আকারের গরু নিয়ে দুইদিন আগে হাটে এসেছেন বেপারী শরিফুল মিয়া। প্রথম দিনই তার ১১টি গরু বিক্রি হয়েছে। পরদিন বিকেলের মধ্যে আরও ৭টি গরু বিক্রি হয়েছে। ছোট গরুর দাম বাড়ছে দেখে বাকিগুলো তিনি দর কষাকষি করে চড়া দরে বেচতে চাইছেন।
আরও পড়ুন
বঙ্গবন্ধুসহ নেতাদের মুক্তিযোদ্ধা স্বীকৃতি বাতিলের বিষয়টি ঠিক নয়
আওয়ামী লীগ না থাকলেও ‘অন্তর্ভুক্তিমূলক’ নির্বাচন হতে পারে
টিউলিপ সিদ্দিকের ১৩ বছরের কর নথি জব্দ