দীর্ঘ ৪০ বছরের সংসার জীবনে শেফালী দাসের বসতঘর কমপক্ষে ২০ বার গুড়িয়ে দেয়া হয়েছে অথবা ভাঙা পড়েছে। রাস্তার পাশে আবার কখনো বা নদীর চরে বা অন্যের জমিতে ঝুপড়ি ঘর বেঁধে বসতি গড়ে ওই নারী। স্বামী আর তিন মেয়েকে নিয়ে এইভাবে সংসার চলছিল ৬০ বছর বয়সী ভূমিহীন শেফালী দাসের।
নিজেরা স্থায়ীভাবে একটি ঘর তৈরি করে বসবাস করবে এমন স্বপ্ন দেখেছিল ওই পরিবারটি। বাগেরহাটের রামপালের গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্পে শেফালী দাসকে জমিসহ ঘর দিয়ে তার দীর্ঘদিনের লালিত স্বপ্ন পুরণ করছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
নতুন ঘরের খুঁশিতে আত্মহারা শেফালী দাস আনন্দ অশ্রু ঝড়ালেন। এখন তিনি স্বাবলম্বী হওয়ার স্বপ্ন বুনছেন। মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রমের ৩য় পর্যায়ের ২য় ধাপে গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৪৫টি পরিবার জমিসহ গৃহ পাচ্ছেন।
শুধু শেফালী দাস নয়, গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকেল্পর বাসিন্দা বিউটি সরকার, তাসলিমা বেগম, সাবেরা বেগম, ফুলজান বেগম, আফরোজা বেগম, ইব্রাহিম হাওলাদার এবং ইউনুছ তালুকদারসহ সবার জীবনের গল্প প্রায় একই রকম। ভূমিহীন ওই সব পরিবারগুলোর নদীর চরে, কখনো অন্যের জমিতে ঝুঁপড়ি ঘরে তাদের জীবন চলছিল। সবার স্বপ্ন ছিল একখন্ড জমিতে তাদের নিজেদের ঘর হবে। কিন্তু ভূমিহীন ওই সব পরিবারের অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা ছিল না। মুজিব শতবর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে জমি ও গৃহ পেয়ে এসব ভূমিহীনদের স্বপ্ন পুরণ হচ্ছে।
মঙ্গলবার রামপালের গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্পে গিয়ে দেখা গেছে, ভূমিহীনদের জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রমের উদ্বোধনকে ঘিরে সেখানে উৎসবের আমেজ বয়ে যাচ্ছে। ঘরে ছাউনি দেয়া লাল রঙের টিন দেখে দুর থেকে মানুষকে আকৃষ্ট করে। সেখানে আসা ভূমিহীন পরিবারগুলো উচ্ছ্বসিত।
জমিসহ ঘর দেয়ায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রতি কৃতজ্ঞতা আর ধন্যবাদ জানালেন ভূমিহীন পরিবারগুলো।
শেফালী দাস জানান, প্রায় ৬০ বছর আগে নদীর চরে বাবার ঝুপড়ি ঘরে তার জন্ম হয়। তার বাবারও নিজের জমি আর ঘর ছিল না। এ কারণে নদীর চরে ঝুপড়ি ঘরে তার বেড়ে উঠা। প্রায় ৪০ বছরে স্বামীর সংসারে এসেও তাদের নিজেদের ঘর বলে কিছুই ছিল না। কখনো রাস্তার পাশে আবার কখনো বা নদীর চরে এবং অন্যের জমিতে ঝুঁপড়ি ঘরে বেঁধে তাদের সংসার চলছিল। সংসার জীবনে ২০ থেকে ২৫ বার তাদের ঝুপড়ি ঘর উচ্ছেদ করা হয়েছে অথবা ভাঙা পড়েছে।
তিনি বলেন, নিজেদের জমি আর ঘর না থাকায় স্বামী ও সন্তানদের নিয়ে পথে পথে ভেসে বেড়িয়েছি। স্বপ্ন ছিল একখন্ড জমি আর নিজের ঘরের। নিজের বাবা আমার জন্য যা করতে পারেনি প্রধানমন্ত্রী জমি ও ঘর দিয়ে সেই কাজটি করছেন। প্রধানমন্ত্রী আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পুরণ করছেন।
প্রধানমন্ত্রীর প্রতি কৃতজ্ঞতা জানান শেফালী দাস।
আরেক সুবধিাভোগী সায়েরা বেগম জানান, তার স্বামী রাস্তায় ঘুরে ঘুরে বাদাম-বুট বিক্রি করে। ১২ বছরের সংসার জীবনে তাদের দু’টি সন্তান। তাদের নিজেদের কোন জমি ও ঘর নেই। একারণে বিভিন্ন সময় নদীর চরে বা রাস্তার পাশে ঝুপড়ি ঘরে বেঁধে তারা বসবাস করতে হয়েছে। তার স্বপ্ন ছিল নিজের একটি ঘরের। কিন্তু তার স্বামী যা আয় করে তা দিয়ে তাদের খাওয়া চলেনা। এর পরে কি ভাবে জমি ক্রয় আর কি দিয়ে ঘর তৈরি করবে। প্রধানমন্ত্রী জমি ও গৃহ দিয়ে তাদের দীর্ঘদিনের স্বপ্ন পুরণ করছেন।
৭০ বছর বয়সী শারীরিক প্রতিবন্ধী হাওলাদার ইব্রাহিম হোসেন জানান, নিজের একখন্ড জমি ও ঘর নেই। ভূমিহীন হিসেবে এখানে সেখানে জীবনের এতগুলো বছর কেটে গেছে। পরিবার পরিজন নিয়ে অনেক কষ্টে দিন যাচ্ছে। রামপাল আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও ঘর পেয়েছি। আগামি বৃহস্পতিবার প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিক ভাবে তাদের উপহার হিসেবে জমি ও গৃহ দিবেন।
জানা গেছে, ৬ দশমিক ২ একর জমির ওপর ৮৫টি ভূমিহীন পরিবারের জন্য গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। মুজিববর্ষে ভূমিহীন ও গৃহহীনদের জন্য জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রমের ৩য় পর্যায়ের ২য় ধাপে গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ৪৫টি পরিবার জমি ও গৃহ পাচ্ছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আগামী বৃহস্পতিবার (২১ জুলাই) আশ্রয়ণ প্রকল্পের উপকারভোগীদের নিকট জমি ও গৃহ প্রদান কার্যক্রমের ভার্চুয়াল উদ্বোধন করবেন।
বাগেরহাট জেলা প্রশাসকের কার্যালয়ের তথ্য মতে, বাগেরহাট জেলায় মোট ৪ হাজার ৯৩৬টি ভূমিহীন পরিবার রয়েছে। জেলার ৯টি উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৩য় পর্যায়ের ২য় ধাপে ৫০০টি ভূমিহীন পরিবারকে আশ্রয়ণ প্রকল্পে জমি ও গৃহ পাচ্ছেন। মুজিব শতবর্ষ উপলক্ষে এ নিয়ে এ পর্যন্ত জেলায় মোট দুই হাজার ১৩৭টি ভূমি ও গৃহহীন পরিবার প্রধানমন্ত্রীর উপহার জমি ও গৃহ পাবেন।
বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আজিজুর রহমান জানান, অবৈধ দখলদার উচ্ছেদ করে ৬ দশমকি ২ একর জমির উপর গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্প গড়ে তোলা হয়েছে। অন্য যে কোন আশ্রয়ণ প্রকল্পের চেয়ে গৌরম্ভা আশ্রয়ণ প্রকল্পে ভিন্নতা রয়েছে। ওই আশ্রয়ণ প্রকল্পের প্রতিটি ঘরের সামনে পর্যাপ্ত ফাঁকা জায়গা রযেছে। ওই ফাঁকা জায়গায় উপকারভোগীরা সবজি এবং বিভিন্ন ফল গাছ রোপন করতে পারবেন।
তিনি বলেন, উপকারভোগীদের স্বাবলম্বী করতে তাদের নানাভাবে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে। সেখানে মসজিদ এবং শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও কমিউনিটি সেন্টার গড়ে তোলা হবে।
—ইউএনবি
আরও পড়ুন
সেন্টমার্টিন ভ্রমণে নিবন্ধনসহ যা করতে হবে পর্যটকদের
জান্নাতে বাবা-মায়ের সাথে সন্তানরা যেভাবে মিলিত হবে
কিশমিশ-মনাক্কায় যত উপকার