December 12, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, December 12th, 2025, 2:52 pm

ইটভাটার বিষাক্ত ধোঁয়ায় ক্ষতি হচ্ছে দেশের পরিবেশ

 

রাকিব হোসেন মিলন

বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়ন, আবাসন নির্মাণ এবং দ্রুত নগরায়ণের সাথে তাল মিলিয়ে দেশে ইটের চাহিদা অভূতপূর্বভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। বর্তমানে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে সাত হাজারের বেশি ইটভাটা রয়েছে, যার বেশিরভাগই এখনো পুরোনো ও দূষণকারী প্রযুক্তিতে পরিচালিত হয়। অর্থনীতিতে ইটভাটার গুরুত্বপূর্ণ অবদান থাকলেও পরিবেশ ও জনস্বাস্থ্যের ওপর এর বিধ্বংসী প্রভাব এখন এটি জাতীয় সংকটে পরিণত হয়েছে।

ইটভাটা থেকে সৃষ্ট বায়ুদূষণ সবচেয়ে গুরুতর সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত। অধিকাংশ ভাটা এখনো ফিক্সড চিমনি কিলন প্রযুক্তির ওপর নির্ভরশীল। যেখানে নিম্নমানের কয়লা, কাঠ, টায়ার সহ নানা ক্ষতিকর জ্বালানি পোড়ানো হয়। এর ফলে বাতাসে বিপুল পরিমাণ কার্বন ডাই অক্সাইড, কার্বন মনো অক্সাইড, সালফার ডাই অক্সাইড, ব্ল্যাক কার্বন এবং ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র কণা ছড়িয়ে পড়ে। এসব দূষক শুধু জলবায়ু পরিবর্তনই বাড়িয়ে দেয় না বরং জনবহুল এলাকাগুলোতে স্থায়ীভাবে বায়ুর মানকে ঝুঁকিপূর্ণ পর্যায়ে নিয়ে যায়।

জনস্বাস্থ্যের ওপর এর প্রভাব সবচেয়ে ভয়াবহ। ইটভাটার আশপাশে বসবাসকারী মানুষদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, অ্যাজমা, ব্রঙ্কাইটিস, ও ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজের মতো রোগ বেশি দেখা যায়। শিশু ও প্রবীণরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। আন্তর্জাতিক গবেষণা অনুযায়ী দীর্ঘমেয়াদে ভাটার ধোঁয়ার সংস্পর্শে থাকা মানুষের হৃদরোগ, ফুসফুসের সংক্রমণ এমনকি অকালমৃত্যুর ঝুঁকি পর্যন্ত বাড়ায়। কৃষকরাও এ ক্ষতির বাইরে নন। বায়ুদূষণের কারণে ফসলের উৎপাদন কমে, মাটির উর্বরতা হ্রাস পায় এবং চারপাশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

বন উজাড় ইটভাটার আরেকটি বড় পরিবেশগত প্রভাব। বিশেষ করে আমাদের দেশের উত্তরাঞ্চল ও পূর্বাঞ্চলে অনেক ভাটায় এখনো কাঠ ব্যবহার করা হয় যা সস্তা জ্বালানি হিসেবে বিবেচিত। এর ফলে বনভূমি ধ্বংস হচ্ছে, বন্যপ্রাণীর আবাসস্থল নষ্ট হচ্ছে, এবং জীববৈচিত্র্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। পরিবেশবিদদের মতে, এ ধারা অব্যাহত থাকলে বন উজাড় জলবায়ু ঝুঁকি আরও বাড়িয়ে দেবে। যেমন বন্যা, নদী ভাঙন এবং আবাদি জমির ক্ষতি বাড়ার তীব্র আশংকা রয়েছে।

ইটভাটার কারণে কৃষিজমিরও ব্যাপক ক্ষতি হয়। ভাটা স্থাপনের জন্য উর্বর ফসলি জমি দখল করা হয় আর ভাটার তাপ এবং রাসায়নিক নির্গমনের ফলে আশপাশের মাটিও ব্যাপক নষ্ট হয়। ইট তৈরির জন্য জমির উপরিভাগের উর্বর মাটি কেটে নেওয়ায় উৎপাদন ক্ষমতা কমে যায়, যা দীর্ঘমেয়াদে খাদ্য নিরাপত্তার জন্য হুমকি তৈরি করতে পারে।

এ সমস্যা মোকাবিলায় সরকার ও পরিবেশবাদী সংগঠনগুলো বিভিন্ন উদ্যোগ নিয়েছে। এর মধ্যে জিগজ্যাগ প্রযুক্তির প্রসার সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য। এই প্রযুক্তি জ্বালানি ব্যবহার ৩০–৪০ শতাংশ পর্যন্ত কমায় এবং দূষণ উল্লেখযোগ্যভাবে হ্রাস করে। পাশাপাশি পরিবেশ অধিদপ্তর ভাটা স্থাপনের বিধিনিষেধ কঠোর করা এখন সময়ের দাবি। অবৈধ ভাটা উচ্ছেদে অভিযান নিয়মিত পরিচালনা করলে এবং লাইসেন্স নবায়নের ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর শতভাগ কঠোর থাকলে আশা করা যায় যে অবৈধ ব্যবসায়ীরা অন্যায় করতে দশবার ভাববে।

এছাড়া নির্মাণশিল্পে ইকো-ফ্রেন্ডলি উপকরণ, যেমন কংক্রিট ব্লক, হোল্লো ব্লক, ফ্লাই-অ্যাশ ব্রিক ও কমপ্রেসড আর্থ ব্লক ব্যবহারের ওপর জোর দেওয়া প্রয়োজন। এসব বিকল্প উপকরণ টেকসই, পরিবেশবান্ধব এবং উৎপাদনে কম শক্তি প্রয়োজন হয়। তবে বাজারে সচেতনতার ঘাটতি ও বিনিয়োগ ব্যয়ের কারণে এই পরিবর্তন এখনো ধীরগতিতে এগোচ্ছে।

বাস্তব পরিস্থিতি বলে অনেক চ্যালেঞ্জ মাঠে বিদ্যমান। পর্যাপ্ত তদারকির অভাব, রাজনৈতিক প্রভাব, স্থানীয় পর্যায়ের দুর্নীতি, এবং প্রযুক্তি পরিবর্তনের ব্যয় এসব কারণে অনেক ভাটা এখনো নিয়ম ভঙ্গ করে চলছে। নীতিমালা থাকলেও কার্যকর বাস্তবায়ন নিশ্চিত না হলে দূষণ কমানো সম্ভব নয়।

সর্বোপরি বলতে গেলে ইটভাটা বাংলাদেশের উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখলেও এর পরিবেশগত ক্ষতি উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করতে হলে পরিচ্ছন্ন প্রযুক্তি গ্রহণ, কঠোর আইন প্রয়োগ এবং জনসচেতনতা বাড়ানো জরুরি। দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করতে এখনই সময় ইটভাটা দূষণকে জাতীয় অগ্রাধিকার হিসেবে বিবেচনা করার।

রাকিব হোসেন মিলন, লেখক ও সাংবাদিক

এনএনবাংলা/