October 5, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, October 5th, 2024, 1:47 am

ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে কতটা প্রভাব ফেলবে ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা

গাজায় নির্বিচার হামলা ও ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানিয়ে বিক্ষোভ সমাবেশে অস্ত্র হাতে হুতি বিদ্রোহীরা। সানা, ইয়েমেনফাইল ছবি: রয়টার্স

আল জাজিরা:
ইসরায়েল ও ইরানের মধ্যে একটি সর্বাত্মক যুদ্ধের ঝুঁকি যতই বাড়ছে, ততই স্পষ্ট হচ্ছে যে এই যুদ্ধে দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলকে সমর্থন দিচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের এ দুই চির বৈরী প্রতিবেশী দেশ যুদ্ধে জড়ালে ইরানের আঞ্চলিক মিত্ররা তাতে কতটা প্রভাব ফেলতে পারবে, সেই প্রশ্ন উঠেছে।

গত বছরের ৭ অক্টোবর ফিলিস্তিনের গাজায় নির্বিচার হামলা শুরু করে ইসরায়েল। গাজায় হত্যাযজ্ঞের প্রতিবাদ ও ফিলিস্তিনিদের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে এর পর থেকে প্রায় এক বছর ধরে লোহিত সাগর, এডেন উপসাগর ও বাব এল–মান্দেব প্রণালিতে ইসরায়েলের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে, এমন জাহাজে নিয়মিত হামলা চালাচ্ছেন ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা।

গত সপ্তাহে লেবাননের রাজধানী বৈরুতের একটি আবাসিক এলাকায় ইসরায়েলের বিমান হামলায় নিহত হয়েছেন হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরুল্লাহ। এর পর থেকে মধ্যপ্রাচ্যের নানা প্রান্ত থেকে ইসরায়েলকে হুমকি দেওয়া হচ্ছে।

হাসান নাসরুল্লাহ নিহত হওয়ার পর হুতিদের মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি এক টেলিভিশন ভাষণে ইসরায়েলকে হুমকি দেন। তিনি বলেন, অবরুদ্ধ গাজা উপত্যকা ও লেবাননে ইসরায়েল যত দিন হামলা বন্ধ না করবে, তত দিন তাদের হামলা অব্যাহত থাকবে। হুতিরা তেল আবিবে ইসরায়েলের বিভিন্ন সামরিক স্থাপনা ও লোহিত সাগরতীরে ইসরায়েলের বন্দরনগরী এলিয়াতে ড্রোন হামলা চালিয়েছে বলেও জানান তিনি।

হিজবুল্লাহর দীর্ঘদিনের প্রধান হাসান নাসরুল্লাহকে ইসরায়েল হত্যা করার পর থেকে ইসরায়েলে ড্রোন ও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে আসছে ইরাকের বিভিন্ন শিয়া সশস্ত্র গোষ্ঠী ও ইয়েমেনের হুতি বিদ্রোহীরা। যদিও ইসরায়েলি বাহিনীর দাবি, ইরান ও তাদের মিত্ররা যেসব হামলা করেছে, সেসব হামলার বেশির ভাগই নিজেদের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা ছাড়াও যুক্তরাষ্ট্র, জর্ডান ও অন্যান্য দেশের সহায়তায় প্রতিহত করেছে তারা। এসব হামলার পাশাপাশি গত মঙ্গলবার ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলায় নামমাত্র ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে দাবি ইসরায়েলের।

লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহকে ইরানের মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করা হয়
লেবাননের সশস্ত্র সংগঠন হিজবুল্লাহকে ইরানের মিত্রদের মধ্যে সবচেয়ে শক্তিশালী মনে করা হয়ফাইল ছবি: এএফপি
যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল পলিসির জ্যেষ্ঠ ফেলো সিনা তুসি আল–জাজিরাকে বলেন, ইরানের হামলায় ক্ষয়ক্ষতির বিষয়টি ছোট করে দেখার চেষ্টা করছে ইসরায়েল। কিন্তু এর একটা ইতিবাচক দিকও রয়েছে। এতে করে যেটা হয়েছে ক্ষয়ক্ষতি কম হয়েছে বলার কারণে ইরানে পাল্টা হামলা চালাতে ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের ওপর যতটা রাজনৈতিক চাপ আসার কথা, সেটা আসবে না। পাশাপাশি এমন একটা পরিস্থিতি তৈরি হবে যে অত বড় পরিসরে পাল্টা হামলা চালানোর কোনো প্রয়োজন নেই।

সিনা তুসি বলেন, ‘এতে করে যুদ্ধবিরতির বিষয়টি আবারও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। যদি বাইডেন প্রশাসন কয়েক মাস আগেই এটা থামতে পারত তাহলে আমাদের এই পরিস্থিতি দেখতে হতো না। কিন্তু আমরা সেই দিকেই যাচ্ছি, যার পরিণতি হবে খুবই ভয়ংকর। আমি মনে করি, কোনো পক্ষই এই যুদ্ধ চায় না। সে রকম কিছু যেন না ঘটে, সে জন্য ইরান ও তার মিত্ররা হুমকি দিচ্ছে।’

বড় বিষয় হবে জ্বালানি তেল

এমন পরিস্থিতিতে ইরান ও তাদের মিত্রদের জন্য পুরো অঞ্চলে থাকা জ্বালানি তেল স্থাপনাগুলো মূল বিষয় হয়ে উঠবে বলে মনে করেন মধ্যপ্রাচ্যবিষয়ক বিশেষজ্ঞ সিনা তুসি। তিনি আল–জাজিরাকে বলেন, ‘ইসরায়েল যদি এখন একটি বড় হামলা করে, তাহলে পাল্টা হামলা চালানোর হুমকি দিয়েছে ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো। বলেছে, মধ্যপ্রাচ্যে জ্বালানি তেল স্থাপনাগুলোতেও হামলা চালাবে তারা। আর এতে করে যদি পারস্য উপসাগর হয়ে জ্বালানি রপ্তানি বিঘ্নিত হয়, তাহলে বৈশ্বিক জ্বালানি তেলের বাজার, বৈশ্বিক অর্থনীতি ও ইউরোপে এর প্রভাব পড়বে।’

মধ্যপ্রাচ্যে এর আগেও জ্বালানি তেলের স্থাপনা হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়েছে। এসব হামলা যে জ্বালানি তেলের বৈশ্বিক বাজারে ব্যাপক ব্যাঘাত ঘটায়, সেটাও দেখা গেছে। ২০১৯ সালে সেপ্টেম্বরে সৌদি আরবের দুটি বড় জ্বালানি তেলের স্থাপনায় ড্রোন হামলা চালানোর দাবি করে হুতি বিদ্রোহীরা। এসব স্থাপনা ছিল সৌদি আরবের রাষ্ট্রমালিকানাধীন জ্বালানি তেল কোম্পানি সৌদি অ্যারামকোর। সেবারের এ হামলার জন্য ইরানকে দায়ী করেছিল যুক্তরাষ্ট্র।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আরেকটি বড় শক্তি ইরাকের বিভিন্ন সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠী
মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের আরেকটি বড় শক্তি ইরাকের বিভিন্ন সশস্ত্র শিয়া মিলিশিয়া গোষ্ঠীফাইল ছবি: রয়টার্স
হুতিদের ওই হামলায় দিনে ৫ কোটি ব্যারেল তেল উৎপাদন কমে যায়, যা সৌদি অ্যারামকোর দৈনিক তেল উৎপাদনের অর্ধেক অথবা বৈশ্বিক তেল সরবরাহের ৫ শতাংশ। সিনা তুসি বলেন, ‘হুতিরা কী করতে পারে, সৌদি আরবের সঙ্গে তাদের যুদ্ধবিরতির সমঝোতা হওয়ার আগে আমরা সেটা দেখেছি। এর আগে সৌদি আরবের অভ্যন্তরে অনেক দূরে পর্যন্ত হুতিদের আমরা হামলা চালাতে দেখেছি।’

ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোও ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রকে হুমকি দিয়েছে। গত মঙ্গলবার এসব গোষ্ঠী হুমকি দিয়ে বলেছে, ইরানের বিরুদ্ধে পাল্টা হামলায় যুক্তরাষ্ট্রও যদি অংশ নেয় অথবা ইরানে হামলায় ইসরায়েল যদি ইরাকের আকাশসীমা ব্যবহার করে, তাহলে মার্কিন ঘাঁটিগুলোতে হামলা চালাবে তারা।

সিনা তুসির মতে, ইরাক ছাড়াও সৌদি আরব, সংযুক্ত আরব আমিরাত, কাতার ও বাহরাইনে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক ঘাঁটি আছে। এসব ঘাঁটি ও ইরাকের আকাশসীমা ব্যবহারের ক্ষেত্রে হুমকি দিয়েছে ইরান। তেহরান বলেছে, ইরানের বিরুদ্ধে হামলায় এসব দেশও দায়ী বলে বিবেচনা করা হবে এবং দেশগুলোর গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামোগুলোও ইরানের হামলার লক্ষ্যবস্তু হয়ে উঠবে।

গোষ্ঠীগুলো ইসরায়েলে হামলায় কতটা সক্ষম

কিংস কলেজ লন্ডনের স্কুল অব সিকিউরিটি স্টাডিজের সহযোগী অধ্যাপক ও ভূরাজনৈতিক ঝুঁকিবিষয়ক বিশ্লেষক আন্দ্রেয়াস ক্রেইগ বলেন, দূর থেকে সরাসরি ইসরায়েলে হামলা করার মতো সক্ষমতা ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর নেই। এ ছাড়া তাদের অস্ত্রভান্ডারও হিজবুল্লাহ ও হুতিদের মতো অতটা সমৃদ্ধ নয়। ইরাক যুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন ন্যাটো বাহিনীকে মোকাবিলায় তাদের এসব অস্ত্র তৈরি করা হয়েছিল। তাঁর মতে, মূলত গেরিলারা এসব ব্যবহার করত এবং অপ্রচলিত যুদ্ধে এসবের ব্যবহার হয়েছে। এসব অস্ত্র ইসরায়েলের সঙ্গে যুদ্ধে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারবে না।

ভূরাজনৈতিক এই বিশ্লেষক বলছেন, অন্যদিকে হিজবুল্লাহর রয়েছে বৈশ্বিক নেটওয়ার্ক। তারা সৌদি আরব থেকে শুরু করে পশ্চিম আফ্রিকা পর্যন্ত বিভিন্ন অঞ্চলে তৎপর। এটা তাদের ইসরায়েলের জন্য অনেক বেশি ভয়ানক করে তুলেছে। কারণ, বিভিন্ন দেশ থেকে তারা ইসরায়েলে হামলা চালানোর সক্ষমতা রাখে। এ ছাড়া ইরাক থেকে যেসব ক্ষেপণাস্ত্র বা ড্রোন হামলা চালানোর খবর পাওয়া যায়, সেগুলো ইরাকে থাকা ইরানিরাই করেন, ইরাকের সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলো নয়।

গত মঙ্গলবার ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে
গত মঙ্গলবার ইসরায়েলে ইরানের ক্ষেপণাস্ত্র হামলার মধ্য দিয়ে মধ্যপ্রাচ্যে আঞ্চলিক যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছেছবি: এএফপি
আন্দ্রেয়াস ক্রেইগ বলেন, ‘বর্তমানে ইয়েমেন অথবা লেবাননের চেয়ে ইরাক থেকে ইসরায়েলে হামলা করাটা সহজ। (ইসরায়েলে) হামলা চালানোর জন্য ইরাককে আপনি ব্যবহার করেত পারেন। তবে এর জন্য সেখানে অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে।’

গত মাসে সবচেয়ে বড় পরিসরে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালাতে দেখা গেছে হুতিদের। হুতিদের সেসব ক্ষেপণাস্ত্র তেল আবিব ও ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চল পর্যন্ত গিয়েছিল। একই সঙ্গে ইসরায়েলের জাফাতে একটি সামরিক স্থাপনাতেও হামলা চালিয়েছে হুতিরা।

হুতিদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, তাদের ছোড়া হাইপারসনিক (শব্দের চেয়েও ৫ থেকে ১০ গুণ গতিতে ছুটতে সক্ষম) ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে পারেনি ইসরায়েলের প্রতিরক্ষাব্যবস্থা। দুই হাজার কিলোমিটার দূর থেকে ছোড়া এসব ক্ষেপণাস্ত্র মাত্র ১১ মিনিটে ইসরায়েলের মধ্যাঞ্চলে পৌঁছায় এবং বেন গুরিয়ন বিমানবন্দর থেকে ১১ কিলোমিটার দূরে আঘাত হানলে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।

হুতির গণমাধ্যম শাখার ভাইস চেয়ারম্যান নাসরেদ্দিন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম এক্সে দেওয়া এক পোস্টে বলেছেন, তাঁদের ছোড়া অন্তত ২০টি ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করতে ব্যর্থ হয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র–ব্যবস্থা। এদিকে ইসরায়েল দাবি করেছে, ক্ষেপণাস্ত্র ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, কিন্তু পাল্টা হিসেবে ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্রের মাধ্যমে তা ধ্বংস করা যায়নি। এদিকে একজন ইসরায়েলি কর্মকর্তার দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, এতে ৯ জন সামান্য আহত হয়েছেন।

লোহিত সাগরে সরবরাহব্যবস্থায় ব্যাঘাত

আন্দ্রেয়াস ক্রেইগ বলেন, হুতিদের তৎপরতায় এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বড় প্রত্যক্ষ প্রভাব পড়ার ঘটনা হলো বাব এল–মান্দেব প্রণালিতে জাহাজ চলাচল বন্ধ হয়ে যাওয়া। কেননা, ইসরায়েল লক্ষ্য করে তাদের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিহত করা হয়েছে।

তুরস্কের আঙ্কারা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের সহকারী অধ্যাপক বেতুল দোগান আল–জাজিরাকে বলেন, পণ্যবাহী জাহাজে হামলা ও জাহাজ ছিনতাইয়ের ঘটনায় গাজায় ইসরায়েলের হামলার মধ্যে তেমন কোনো প্রভাব ফেলতে পারেনি। কিন্তু তারা একটা অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পেরেছে।

অধ্যাপক বেতুল দোগান বলেন, ‘তারা (হুতিরা) ইসরায়েলকে নিরাপত্তাহীনতায় ফেলতে পেরেছে। আমার মতে, এটাই তাদের চূড়ান্ত লক্ষ্য এবং এই মুহূর্তে এটাই তাদের সাফল্য। আমরা জানি, ইরান নিজেই ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করতে পারে। কিন্তু তারা হুতিদের ব্যবহার করছে। এটা হলো, নিজস্ব সক্ষমতার বাইরেও তাদের বাড়তি একটি সক্ষমতা।’