অনলাইন ডেস্ক :
খুব বড় কোনো তারকা নেই। নেই কোনো ‘গোল মেশিন।’ তবে দলে আছেন এই মুহূর্তে বিশ্ব ফুটবলের সেরা প্রতিভাদের কয়েকজন। খেলছেন নজর কাড়া ফুটবল। রক্ষণ, মাঝমাঠ ও আক্রমণে অভাব নেই বৈচিত্র্যের। তার এক সুতোয় গাঁথার জন্য আছেন লুইস এনরিকে। ক্লাব ফুটবলে সাফল্যের ভেলায় চেপে এসেছেন জাতীয় দলের দায়িত্বে। তার হাত ধরেই বিশ্ব মঞ্চে বিজয় নিশান উড়াতে চায় স্পেন। সাম্প্রতিক সময়ে তেমন কিছু জেতেনি তারা। সবশেষ শিরোপা জিতেছিল সেই ২০১২ সালে। স্পেনকে নিয়ে অনেকেরই বড় স্বপ্ন দেখার মূল কারণ- সম্ভাবনা। রোমাঞ্চকর সব ফুটবলারে ঠাসা দলটির সেরাটা দেখা হয়তো এখনও বাকি। এই সম্ভাবনার জন্যই মূলত ফেভারিটদের মধ্যে আছে স্পেন। সাম্প্রতিক সময়ে দলটি যেভাবে স্কোয়াড সাজিয়েছে তাতে এটা মোটামুটি নিশ্চিত, প্রথমবারের মতো বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পাচ্ছেন বেশ কয়েক জন। তাদের মতো একটি প্রথমের স্বাদ পাচ্ছেন এনরিকেও। কোচ হিসেবে এবারই প্রথম বিশ্ব আসরে যাচ্ছেন তিনি, এর আগে খেলোয়াড় হিসেবে স্পেনের প্রতিনিধিত্ব করেছেন তিনটি আসরে। বিশ্বকাপ মানে কি খুব ভালো করেই জানা এনরিকের। জানেন এই টুর্নামেন্টে শিরোপা জেতা কতটা কঠিন। তবে নিজের দলে সেই সামর্থ্য দেখেন ৫২ বছর বয়সী এই কোচ। “আমি বিশ্বাস করি, আমার দলটি বিশ্বকাপে শেষ পর্যন্ত যেতে সক্ষম। (শিরোপা স্বপ্নে) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে এবং দল হিসেবে কঠিন প্রতিপক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে এগিয়ে যেতে চাই আমরা।” এনরিকের কোচিং ও দলের সামর্থ্য নিয়ে দারুণ আশাবাদী অধিনায়ক সের্হিও বুসকেতস। সম্প্রতি ফিফাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে নিজেদের দল নিয়ে আশার কথা শোনান বার্সেলোনার অভিজ্ঞ মিডফিল্ডার। “আমাদের সবসময় বড় প্রত্যাশা থাকে। কারণ, স্প্যানিশ সমর্থকরা সবসময় আমাদের সেরা হওয়ার প্রত্যাশা করে। এমনই হওয়া উচিত বলে আমি মনে করি। আমি নিশ্চিত, প্রতিপক্ষরা আমাদের সম্মান করবে এবং সমর্থকরা আমাদের সমর্থন করবে। আশা করি, আমরা আমাদের ধরন অনুযায়ী খেলতে পারব, যা আমাদের এ পর্যায়ে নিয়ে এসেছে। বিশ্বাস করি, আমরা সবার প্রত্যাশা পূরণ করতে পারব।” স্পেনের বর্তমান দলে ২০১০ বিশ্বকাপজয়ী দলের একমাত্র সদস্য হিসেবে আছেন সের্হিও বুসকেতস। দলের স্বার্থে অভিজ্ঞতার তুলনায় শুরু থেকেই তারুণ্যকে প্রাধান্য দিয়ে আসছেন এনরিকে। তাতে তিনি বাদ দিতে পিছপা হননি স্পেনের হয়ে সবচেয়ে বেশি ম্যাচ খেলা ও বিশ্বকাপজয়ী তারকা ডিফেন্ডার সের্হিও রামোসকেও। তবে পেদ্রি, আনসু ফাতি, গাভিদের মতো তরুণদের কাঁধে সবসময় আস্থার হাত রেখেছেন এনরিকে। সমালোচনার মুখে তাদের আগলে রেখেছেন অভিভাবকের মতো। এর প্রতিদানও তিনি পাচ্ছেন। সময়ের পরিক্রমায় এই তরুণরা হয়ে উঠেছেন দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। বিশ্বসেরার মঞ্চে দলটির ভাগ্য গড়ে দেওয়ার কারিগরও হতে পারেন তারাই। এনরিকে তার দলকে যেভাবে খেলান, তাতে ব্যক্তিগত পারফরম্যান্সের চেয়ে মুখ্য ভূমিকা রাখে দলগত প্রচেষ্টা। গোলের নিচে দাভিদ দে হেয়ার ফর্ম দলটির চিন্তার কারণ হলেও ভরসা হতে পারেন আথলেতিক বিলবাওয়ের উনাই সিমোন। অভিজ্ঞ দানি কারভাহাল, জর্দি আলবা, সেসার আসপিলিকুয়েতা, মার্কোস আলোনসোদের নিয়ে গড়া রক্ষণ স্পেনের বড় শক্তির জায়গা। মাঝমাঠে বুসকেতস, থিয়াগো আলকান্তারারা তো আছেনই, তবে সাম্প্রতিক ফর্ম বিবেচনায় স্পেনের সফলতা-ব্যর্থতার অনেকটাই নির্ভর করবে বার্সেলোনার দুই মিডফিল্ডার পেদ্রি ও গাভির ওপর। তাদের সঙ্গ দিতে আছেন রদ্রি, কোকে ও মার্কোস ইয়োরেন্তের মতো কার্যকর মিডফিল্ডাররা। ফাতি, ফেররান তরেস, মার্কো আসেনসিওদের নিয়ে গড়া স্পেনের আক্রমণে বেশ সমৃদ্ধ হলেও এনরিকের জন্য চিন্তার কারণ হতে পারে একজন ‘ক্লিনিক্যাল’ স্ট্রাইকারের অভাব। রাউল দে তমাস, আলভারো মোরাতারা আছেন, তবে শীর্ষ পর্যায়ে ধারাবাহিকভাবে তারা পারফর্ম করতে পারেননি এখনও। ফরোয়ার্ডরা যদি নিজেদের কাজটা ঠিকঠাক করতে পারেন, তাহলে স্পেনের পক্ষে অনেকদূর এগিয়ে যাওয়া সহজই হওয়ার কথা।
দলের চালিকাশক্তি হতে পারেন পেদ্রি
বর্তমান সময়ে সবচেয়ে প্রতিভাবান খেলোয়াড়দের একজন হিসেবে বিবেচিত পেদ্রি তার ক্লাব বার্সেলোনার মতো স্পেন দলেও গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আগামী ২৫ নভেম্বর ২০-এ পা দিতে যাওয়া এই মিডফিল্ডার খুব অল্প সময়ের মধ্যে শীর্ষ পর্যায়ে নিজেকে নিয়ে গেছেন সেরাদের কাতারে। বার্সেলোনায় পেদ্রি খেলেন ৮ নম্বর জার্সিতে। লম্বা সময় ধরে ক্লাবটির কিংবদন্তি মিডফিল্ডার আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা মাঠ মাতিয়েছিলেন এই ৮ নম্বর জার্সিতেই। পেদ্রির খেলায় মুগ্ধ কাতালান ক্লাবটির কোচ শাভি এরনান্দেস তার মধ্যে দেখতে পান তার সাবেক সতীর্থ ইনিয়েস্তার ছায়া। “যেভাবে (পেদ্রি) খেলাটা বোঝে, তাকে খেলতে দেখাটা চমৎকার। সে আমাকে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তার কথা অনেক মনে করিয়ে দেয়, এমন প্রতিভা আমি খুব বেশি দেখিনি।” জাতীয় দল ও ক্লাবের হয়ে ইনিয়েস্তার যা অর্জন, পেদ্রি তার কতোটা অর্জন করতে পারেন, তা সময়ই বলে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত তার পথচলা বলে দিচ্ছে সব ঠিক থাকলে সামনে অপেক্ষা করছে অসাধারণ দুত্যিময় এক ক্যারিয়ারে। এর সব রসদই আছে তার খেলায়। পেদ্রির মধ্যে রয়েছে একজন আধুনিক প্লেমেকারের সব গুণাবলি। কঠিন পরিস্থিতিতে সতীর্থকে খুঁজে বের করার সৃজনশীলতার পাশাপাশি সঠিক সময়ে সঠিক পাস দিতে সিদ্ধহস্ত তিনি। প্রতিপক্ষের সীমানায় তার পাসগুলোও হয় একদম মাপা, তুলির আচরে যেন এঁকে বেড়ানো নিখুঁত কোনো চিত্রকর্ম। গত বছরের মার্চে প্রথমবারের মতো জাতীয় দলে ডাক পান পেদ্রি। তার আগেই অবশ্য বার্সেলোনা দলে নিয়মিত মুখ তিনি। গত ইউরোপিয়ান চ্যাম্পিয়নশিপে স্পেন দলে ছিলেন পেদ্রি। পুরো টুর্নামেন্টে তার পারফরম্যান্সের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেছিলেন এনরিকে। “আপনারা কি দেখেছেন ১৮ বছর বয়সে এত বড় টুর্নামেন্টে পেদ্রি কীভাবে পারফর্ম করেছে? এমনকি আন্দ্রেস ইনিয়েস্তাও তা করতে পারেনি। আমাদের পেদ্রির সঙ্গে সাথে তাল মিলিয়ে খেলতে হবে।” স্পেনের হয়ে এখন পর্যন্ত ১৪ ম্যাচ খেলা পেদ্রি যদি বিশ্বকাপে স্বমহিমায় থাকেন, দলটির ভক্তরা বুদ হতেই পারেন ১২ বছর পর আবারও বিশ্বসেরা হওয়ার স্বপ্নে।
চোখ রাখতে হবে গাভির ওপর
পেদ্রির বার্সেলোনা সতীর্থ গাভিও অল্প বয়সেই পাদপ্রদীপের আলোয় চলে এসেছেন তার দুর্দান্ত পারফরম্যান্স দিয়ে। বার্সেলোনার বিখ্যাত লা মাসিয়া একাডেমি থেকে উঠে আসার পর ২০২১ সালের অগাস্টে গাভির মূল দলে অভিষেক হয়। এরপর গত মৌসুমে ক্রমেই দলের গুরুত্বপূর্ণ সদস্য হয়ে ওঠেন। সব প্রতিযোগিতা মিলিয়ে ম্যাচ খেলেন ৪৭টি। স্পেন দলে গাভির অভিষেক গত বছরের অক্টোবরে। সময়ের পরিক্রমায় ক্লাবের মতো জাতীয় দলেও বড় ভরসা হয়ে উঠছেন তিনি। মাত্র ১৮ বছর বয়সী গাভির ওপর মাঝমাঠের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব সপে দেওয়া স্পেনের কোচ হিসেবে এনরিকের সাহসী সিদ্ধান্তগুলোর একটি। অমিত সম্ভাবনাময় গাভির প্রশংসায় পঞ্চমুখ এই স্প্যানিয়ার্ড। “গাভি শুধু বল দিয়ে দৌড়ায় না – এই কাজে সে সত্যিই বিপজ্জনক। সে একজন পরিপূর্ণ সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার এবং সে গোলও করতে পারে। তার বয়স ১৮ এবং সে অনন্য। তার খেলার প্রেমে না পড়া কঠিন। সে স্কুলের খেলার মাঠের মতো করে খেলাটা খেলে। সে জাতীয় দলের বর্তমান ও ভবিষ্যত।” আক্রমণে দারুণ সক্রিয় গাভি রক্ষণেও বেশ কার্যকরী ভূমিকা রাখতে সক্ষম। মাঠে তার নড়াচড়া, বল কেড়ে নেওয়ার দক্ষতা ও অন্তর্দৃষ্টি তাকে সময়ের সেরাদের কাতারে নিয়ে যাচ্ছে। মাঠে তিনি যাই করেন, তা করে থাকেন গতি ও নির্ভুলতার সঙ্গে। গাভি এমন একজন খেলোয়াড় যিনি পুরো দলকে এক সুতোয় গেঁথে দেন। তার গতি রয়েছে, ডিফেন্ডারদের ফাঁকি দিয়ে বল পায়ে নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দক্ষতা রয়েছে এবং রক্ষণচেরা পাস দিতে তার জুরি মেলা ভার। বিশ্বকাপ তার জন্য হতে পারে নিজেকে মেলে ধরার আদর্শ মঞ্চ। একঝাঁক তরুণ খেলোয়াড় ও আন্তর্জাতিক পরিম-লে পরীক্ষিত কিছু অভিজ্ঞ খেলোয়াড় থাকলেও স্পেনের এই দলে নেই খুব বড় মাপের কোনো তারকা। এটিকে অবশ্য নিজেদের দুর্বলতা হিসেবে মানতে নারাজ পেদ্রি। তার মতে, ফেভারিট হিসেবেই কাতারে যাবেন তারা। “সম্ভবত আমাদের কাছ থেকে লোকেরা খুব বেশি কিছু প্রত্যাশা করছে না। তারা আমাদের ফেভারিটের তালিকায়ও রাখছে না, তবে দলের ভেতর আমরা নিজেদের ফেভারিট হিসেবেই দেখছি।” বিশ্বকাপের মতো আসরে অবশ্য ফেভারিট হিসেবে খেলার চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করা এবং দল হিসেবে খেলা। সবশেষ বিশ্বকাপে এটি করেই চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল দিদিয়ের দেশমের ফ্রান্স। এনরিকের স্পেনও যদি দল হিসেবে খেলতে পারে, তাহলে ফেভারিটের তকমা গায়ে না মেখেও শিরোপা উঁচিয়ে ধরতে পেদ্রি-গাভিদের রুখবে কে?
আরও পড়ুন
মুখোমুখি হচ্ছেন সাকিব-তামিম
চ্যাম্পিয়নস ট্রফির জার্সিতে ‘পাকিস্তান’ লেখা নিয়ে আপত্তি ভারতের, খেপেছে পিসিবি
মালানের সঙ্গে কী হয়েছিল মাঠে, নিজেই জানালেন তামিম