বেগুনের অন্যতম পাইকারি বাজার জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার শিমুলতলী বাজারে কৃষক বেগুন বিক্রি করছেন। পাইকাররা পাইকারি কিনে বিক্রির জন্য নিয়ে যাচ্ছেন। গতকাল শনিবার বিকেলে তোলা: ছবি
নিজস্ব প্রতিবেদক:
জামালপুরের মেলান্দহ উপজেলার উত্তর বালুরচর গ্রামের কৃষক আমির হামজা এবার সাড়ে পাঁচ বিঘা জমিতে বেগুনের চাষ করেছেন। খেতের বেগুন বিক্রি করতে তিনি গতকাল শনিবার বিকেলে উপজেলার অন্যতম পাইকারি বাজার শিমুলতলীতে যান। প্রতি কেজি বেগুন বিক্রি করেন ৯ টাকা দরে।
সেই বেগুন ১৫ কিলোমিটার দূরে জামালপুর শহরের খুচরা বাজারে আজ রোববার সকালে ক্রেতাদের কিনতে হচ্ছে আড়াই গুণ দামে। এভাবেই পাইকারি বাজারে কৃষকের ৯ থেকে ১০ টাকার বেগুন হাতবদল হয়ে বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকায়।
মেলান্দহের বিভিন্ন চরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বেগুনের চাষ হয়। এসব বেগুন বিক্রির জন্য প্রতিবছর শিমুলতলীতে পাইকারি বাজার বসে। সেখান থেকে বেগুন কিনে ট্রাকভর্তি করে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন বাজারে নিয়ে যান পাইকাররা। খুচরা বাজারে বেগুনসহ সব ধরনের সবজি বেশি দামে বিক্রি হলেও কৃষকদের তেমন লাভ হচ্ছে না। মুনাফা হাতিয়ে নিচ্ছেন একশ্রেণির মধ্যস্বত্বভোগী ব্যবসায়ী। হাত ঘুরলেই বাড়ছে সবজির দাম। এতে ঠকে যাচ্ছেন সাধারণ ক্রেতা ও চাষিরা।
মেলান্দহ উপজেলার কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল ফয়সাল বলেন, মধ্যস্বত্বভোগীরা যাতে মুনাফা হাতিয়ে নিতে না পারেন, সে জন্য কৃষকদের নিয়ে নানা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যেমন প্রতিটি এলাকায় ভ্যানগাড়ি দেওয়া হয়েছিল। যাতে কৃষকেরা সরাসরি বাজারে সবজি বিক্রি করতে পারেন। এ জন্য সমিতিও করা হয়েছিল। কিন্তু বেশির ভাগ কৃষক ওই পদ্ধতিতে যাননি।
হাত বদলে বেগুনের দাম বাড়ার বিষয়ে পাইকারি একজন ব্যবসায়ী বলেন, ৯ টাকা দরে বেগুন কিনেছেন। ঢাকার কারওয়ান বাজারে নিয়ে বিক্রি করবেন। বাজার পর্যন্ত নিতে ট্রাক ভাড়া, হাটের ইজারা, বস্তা ক্রয়, বস্তা ভর্তির মজুরি, ট্রাকে বস্তা ওঠা-নামার মজুরিসহ নানা খরচ আছে। সব মিলিয়ে কারওয়ান বাজারে ১৮ থেকে ১৯ টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হবে। এতে দু-এক টাকা লাভ হবে। আবার বাজার খারাপ থাকলে অনেক সময় লোকসানও হয়। তিনি বলেন, ‘আমাদের কাছ থেকে ঢাকার আড়তদাররা কিনে নেন। তাঁরা আবার খুচরা বিক্রি করেন। হাতবদলের কারণে খুচরা বাজারে কয়েক গুণ দাম বেড়ে যায়।’
গতকাল বিকেলে সরেজমিনে দেখা যায়, জামালপুর-ইসলামপুর মহাসড়কের পাশে মেলান্দহ রেলওয়ে স্টেশন-সংলগ্ন শিমুলতলী এলাকায় বিশাল মাঠে বেগুনের পাইকারি বাজার বসেছে। উপজেলার বিভিন্ন গ্রাম ও চরাঞ্চল থেকে ইজিবাইক, রিকশা, ভ্যান, ঘোড়ার গাড়ি, মহিষের গাড়িতে করে চাষিরা বাজারে বেগুন নিয়ে আসছেন। বাজারের একপাশে সারিবদ্ধভাবে ট্রাক ও পিকআপ ভ্যান দাঁড়ানো। বিকেল চারটার মধ্যে পুরো হাট বেগুনে ভরে যায়। এরপর শুরু হয় বেচাকেনা। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা পাইকাররা কৃষকদের কাছ থেকে বেগুন কিনে নেন। তারপর শ্রমিক দিয়ে বস্তায় ভরে ট্রাক-পিকআপে তোলেন।
মেলান্দহের বিভিন্ন চরাঞ্চলে বিপুল পরিমাণ বেগুনের চাষ হয়। এসব বেগুন বিক্রির জন্য প্রতিবছর শিমুলতলীতে পাইকারি বাজার বসে:
খুচরা ও পাইকারি বাজারের দামের তারতম্যের কথা কৃষকেরাও জানেন। মেলান্দহের কান্দারচর গ্রামের একজন কৃষক বলেন, আসলে একসঙ্গে তাঁদের অনেক সবজি বিক্রি করতে হয়। যেটা শহরের বাজারে বসে বিক্রি সম্ভব নয়। এ জন্য কষ্ট করে সবজি চাষ করেও কৃষকেরা বেশি মুনাফা করতে পারেন না। তিনি জানান, এবার ২০ শতাংশ জমিতে বেগুন চাষ করেছিলেন। খরচ হয়েছিল ১০ হাজার টাকা। এখন পর্যন্ত ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকার বেগুন বিক্রি করেছেন। খেতে আরও কিছু বেগুন আছে। তবে গতবারের তুলনায় এবার লাভ কম হয়েছে। ন্যায্যমূল্য পেলে আরও লাভ হতো।
কৃষকদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মেলান্দহের পূর্বপাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে পুরোনো ব্রহ্মপুত্র নদ। প্রমত্ত যমুনার সঙ্গে সরাসরি সংযোগ থাকায় একসময় নদটি প্রচণ্ড খরস্রোতা ছিল। তবে এখন যমুনার সঙ্গে সংযোগ নেই। প্রতিবছর যমুনা ও ব্রহ্মপুত্র নদের পানিতে উপজেলার বেশির ভাগ চরাঞ্চল প্লাবিত হয়। এতে উপজেলার পূর্বাঞ্চলের বালুরচর, কান্দারপাড়া, টুপকারচর, সাদুপুর, শ্যামপুর, ঝাউগড়া, দুরমুঠ, ২, ৪ ও ৫ নম্বর চর, কাজাইকাটা, মাহমুদপুরসহ বিস্তীর্ণ চরাঞ্চলে ব্যাপকভাবে পলি পড়ে। কৃষকেরা এসব চরে প্রতিবছর বেগুনের চাষ করেন। সারা দেশে এ বেগুনের চাহিদা ব্যাপক। অনেক পাইকার লোকাল ট্রেনের বগিতেও বেগুন বিভিন্ন এলাকায় নিয়ে বিক্রি করেন।
একজন পাইকারি ব্যবসায়ী বলেন, বেগুন বিক্রি প্রায় শেষের দিকে। শুরুর দিকে কৃষকেরা ভালো দাম পেয়েছেন। এখন বাজারে নানা জাতের শীতের সবজি আসছে। এখন বেগুনের চাহিদা একটু কম। এ জন্য দামও একটু কম। কৃষকদের থেকে বেগুনের প্রকারভেদে ৯ থেকে ১০ টাকা কেজি দরে কিনছেন। ঢাকাসহ বিভিন্ন জেলার আড়তে কেজিতে ৫ থেকে ১০ টাকা লাভে বিক্রি করেন। আড়তদাররা খুচরা ব্যবসায়ীদের কাছে বিক্রি করেন। খুচরা ব্যবসায়ীরাও কিছু লাভ করেন। এ জন্য খুচরা বাজারে দাম একটু বেশি হয়। প্রতিদিন শিমুলতলী বাজার থেকে দেড় হাজার মণ বেগুন সারা দেশে যাচ্ছে বলে তিনি জানান।
কৃষি কর্মকর্তা আবদুল্লাহ আল ফয়সাল বলেন, চলতি বছর মেলান্দহে ১ হাজার ৫১০ হেক্টর জমিতে শীতকালীন নানা সবজি চাষ হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার হেক্টরে শুধু বেগুনের চাষ হয়েছে। বর্তমানে প্রকারভেদে ৯ থেকে ১২ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। শুরুর দিকে দাম ভালো ছিল। বেগুন চাষে এ অঞ্চলের কৃষকেরা লাভবান হচ্ছেন।
আরও পড়ুন
তিব্বতে ভূমিকম্পে মৃতের সংখ্যা বেড়ে ৫৩
বিমানবন্দরেই দেখা ইচ্ছে মা-ছেলের
পুরানা পল্টনে ৪ তলা ভবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে