নিজস্ব প্রতিবেদক:
দেশের খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় এক দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে দ্বিগুণেরও বেশি। দেড় দশক আগেও ওসব ব্যবসায় পুরুষের একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল। আর তাতে নারীদের অংশগ্রহণ দেড় শতাংশেরও নিচে ছিল। কিন্তু এখন খুচরা ও পাইকারি ব্যবসায় নারীদের অংশগ্রহণ ৮ শতাংশে পৌঁছেছে। খুচরা ও পাইকারি ব্যবসা দেশের অর্থনীতিকে সচল রাখতে অন্যতম প্রভাবক। সেজন্যই এ খাতের বার্ষিক মূল্যসংযোজন ৩ লাখ ২৯ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। মোট দেশজ উৎপাদনের বা জিডিপির হিসাবের ক্ষেত্রে ২১টি প্রধান খাতকে বিবেচনা করা হয়। ওসব খাতের মধ্যে অন্যতম পাইকারি ও খুচরা ব্যবসা-বাণিজ্য। ওই খাতে উদ্যোক্তাদের শ্রেণী বিভাজন ও অবদান মূল্যায়নে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) এক জরিপ পরিচালনা করে। আর ওই জরিপের প্রতিবেদনেই ওসব তথ্য উঠে এসেছে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরো (বিবিএস) সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, সরকারের কোনো না কোনো মাধ্যমে নিবন্ধন রয়েছে এমন উদ্যোক্তাদের তথ্যই শুধু বিবিএসের জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিগত ২০১৯-২০ অর্থবছরে দেশে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টি নিবন্ধিত খুচরা ও পাইকারি প্রতিষ্ঠান ছিল। ওসব প্রতিষ্ঠানে পুরুষ উদ্যোক্তা ছিলেন ১ কোটি ৩৯ লাখ ১ হাজার ৫৬৪ জন আর নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা ছিল ২০ লাখ ৩ হাজার ১৮৯ জন। তবে পুরুষের তুলনায় এখনো নারী উদ্যোক্তার সংখ্যা কম হলেও এক দশকে তা ১২৬ শতাংশ বেড়েছে। ২০০৯-১০ অর্থবছরে নারী উদ্যোক্তা ছিলেন ৮৯ হাজার ৮৪৮ জন। ওই সংখ্যা ২০০২-০৩ অর্থবছরে ছিল মাত্র ২১ হাজার ৮৬৭ জন। অর্থাৎ দেড় দশকে নারী উদ্যোক্তা বেড়েছে ৮২৯ শতাংশ।
সূত্র জানায়, উইমেন অ্যান্ড ই-কমার্স ফোরাম (উই) বিগত ২০১৭ সাল থেকেই অনলাইনভিত্তিক উদ্যোক্তা কার্যক্রম পরিচালনা করছে। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাদের সদস্য সংখ্যা ছাড়িয়েছে ১২ লাখ। তবে সংগঠনটিতে প্রায় ৪ লাখ নারী উদ্যোক্তা ই-কমার্সের মাধ্যমে ব্যবসা পরিচালনা করছে। তাদের অনেকেই হয়তোবা সরকারের নিবন্ধন কাঠামোর মধ্যে নেই। কভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে ব্যবসা পরিচালনার মাধ্যমে ওসব উদ্যোক্তারা স্বাবলম্বী হয়ে উঠছে। গ্রাম পর্যায়ে উদ্যোক্তাদের পণ্য ভোক্তা পর্যায়ে পৌঁছানোর ক্ষেত্রে উই বড় ধরনের প্লাটফর্ম হিসেবে কাজ করছে। সম্পূর্ণ দেশীয় পণ্যকেন্দ্রিক উদ্যোক্তাদের ওই প্লাটফর্ম এখন সারা দেশের গ-ি ছাড়িয়ে বিদেশেও বাংলাদেশীদের কাছে জনপ্রিয় হয়ে উঠছে।
সূত্র আরো জানায়, খুচরা ও পাইকারি ব্যবসার মাধ্যমে মূল্যসংযোজন বাড়ছে। ২০০২-০৩ অর্থবছরে যেখানে মাত্র ১৩ হাজার ৬২৭ কোটি টাকার মূল্যসংযোজন হয়েছিল, সেখানে ২০০৯-১০ অর্থবছরে তা বেড়ে ৩৮ হাজার ৫৩০ কোটি এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩ লাখ ২৯ হাজার ৫২০ কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। ফলে ওই খাতে নারীদের অবদান সর্বোচ্চ ৮ শতাংশ হিসাবে নিলেও তাদের মাধ্যমে অর্থনীতিতে প্রায় ২৬ হাজার কোটি টাকার মূল্যসংযোজন হচ্ছে। ফলে নারীদের স্বাবলম্বিতা যেমন বাড়ছে, তেমনি নারীর ক্ষমতায়ন এগিয়ে যাচ্ছে। বিগত ২০০২-০৩ অর্থবছরে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায় মোট ১৫ লাখ ৭৪ হাজার ৩৩৪টি অর্থনৈতিক ইউনিট ও প্রতিষ্ঠানে নিয়োজিত ছিলেন ২১ লাখ ২৬ হাজার ১৭৭ জন নারী ও পুরুষ। ২০০৯-১০ অর্থবছরে ২৬ লাখ ৫০ হাজার ১২৩টি প্রতিষ্ঠানে ৫২ লাখ ৬৪ হাজার ৯০০ জন এবং ২০১৯-২০ অর্থবছরে ২৫ লাখ ৪০ হাজার ৮৯৭টিতে নিয়োজিত ছিল ১ কোটি ৪১ লাখ ৪ হাজার ৭৫৩ জন। নারী উদ্যোক্তাদের মূলত ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প হিসেবে কৃষি ও মৎস্য খাত ছাড়াও খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পর্যটন, ফ্যাশন ও সৌন্দর্য পণ্য, স্বাস্থ্যবিষয়ক পণ্য এবং অনলাইন ব্যবসায় বেশি আগ্রহ রয়েছে। পাশাপাশি গার্মেন্ট ও অ্যাকসেসরিজ, বিউটি পার্লার, টেইলারিং, রিটেইল শপ, আইটি, ইলেকট্রনিকস, সফটওয়্যার, পাটজাত পণ্য ও হ্যান্ডিক্র্যাফটস খাতেও নারী উদ্যোক্তা বাড়ছে।
এদিকে ই-কমার্সভিত্তিক নারী উদ্যোক্তাদের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের বিষয়ে উইয়ের সভাপতি নাসিমা আক্তার নিশা জানান, আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট, সুযোগ-সুবিধা ও পরিবারের প্রয়োজনে প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করেই নারীরা উদ্যোক্তা হচ্ছে। তবে কভিড-১৯ মহামারী পরিস্থিতি নারীদের জন্য নতুনভাবে উদ্যোক্তা হওয়ার সুযোগ তৈরি করেছে। যদিও ই-কমার্সভিত্তিক ব্যবসা পরিচালনার জন্য নারীরা বেশ প্রতিবন্ধকতার মধ্যে রয়েছে। প্রথমত, নারীদের ডেলিভারি সিস্টেম ও পরিবহন সমস্যায় ভুগতে হচ্ছে। গ্রাম ও উপজেলা পর্যায়ে ওই দুটি ব্যবস্থা সম্প্রসারণ করা সম্ভব হলে নারীদের আরো বেশি উদ্যোক্তা হওয়ার সম্ভাবনা তৈরি হবে। পাশাপাশি ইন্টারনেট সুবিধা আরো সাশ্রয়ী ও ভোক্তাবান্ধব করা প্রয়োজন। অর্থায়ন ও সনদায়ন প্রক্রিয়ায় নারীরা যেন অংশগ্রহণ করতে পারে সে ব্যবস্থাটাও আরো সহজ করা দরকার। উই প্লাটফর্মে ৪ লাখের বেশি নারী উদ্যোক্তা থাকলেও অনেকেরই ট্রেড লাইসেন্স নেই। ফলে অনেক নারী উদ্যোক্তা সরকারের হিসাবের মধ্যে আসতে পারছে না। পাশাপাশি তারা সরকারের সুযোগ-সুবিধা থেকেও বঞ্চিত হচ্ছেন।
অন্যদিকে এ বিষয়ে উইমেন অন্ট্রাপ্রেনিউর অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ওয়েব) সভাপতি নাসরিন ফাতেমা আউয়াল জানান, অর্থনীতিতে নারীর অবদান বাড়াতে হলে নারী শ্রমশক্তিকে অর্থনৈতিক ও বাণিজ্যিক কাজে নিয়োজনের পথ সুগম করা জরুরি। অর্থনৈতিক কর্মকা-ে অংশগ্রহণকারী নারীদের জন্য সরকারি ও বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থায় বিশেষ হেল্প ডেস্ক থাকলেও সেগুলোতে তেমন হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায় না। আর্থিক সুবিধার পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের পরিচালনগত অসুবিধাগুলো অপসারণ করা প্রয়োজন। কেননা ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার ক্ষেত্রে নারী উদ্যোক্তারা প্রতিবন্ধকতার শিকার হচ্ছে। আর লাইসেন্স জটিলতার কারণে অনেক নারী ব্যাংক থেকে ঋণ পাওয়া থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এসব সমস্যা থেকে উত্তরণের জন্য নারীদের ঋণ ও ট্রেড লাইসেন্স পাওয়ার প্রক্রিয়াটি সহজ করা জরুরি। নারীদের এলসি খোলা, নগদ সুবিধা ও সনদ পেতে নারী উদ্যোক্তাদের সাধারণত পুরুষের চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করতে হয়। এমন ধরনের বৈষম্যগুলো দূর করা প্রয়োজন। সেজন্য ব্যবসা শুরু থেকে বিপণনের সব পর্যায়ে প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি নীতিসহায়তা বাড়াতে হবে। দেশের নারী উদ্যোক্তাদের অধিকাংশই ক্ষুদ্র, ছোট ও মাঝারি। ফলে বাজেটে নারীদের জন্য করমুক্ত আয়সীমা বাড়ানো প্রয়োজন। পাশাপাশি নারী উদ্যোক্তাদের জন্য বিশেষ বরাদ্দ রাখা এবং ওই অর্থ উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছানো নিশ্চিত করাও জরুরি।
এ প্রসঙ্গে অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকার্স বাংলাদেশের (এবিবি) সাবেক চেয়ারম্যান ও মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংকের ব্যবস্থাপনা পরিচালক সৈয়দ মাহবুবুর রহমান জানান, নারী উদ্যোক্তাদের জন্য ব্যাংকগুলো অনেক বেশি আন্তরিক। ব্যাংকিং সিস্টেমের মাধ্যমে নারী উদ্যোক্তা তৈরি ও সম্প্রসারণের আরো সুযোগ রয়েছে। কিন্তু জামানত ও কিছু প্রাতিষ্ঠানিক নথিপত্র সরবরাহের ক্ষেত্রে নারীরা পিছিয়ে থাকে। ফলে ব্যাংক চাইলেও সেক্ষেত্রে অর্থায়ন করতে পারে না। তবে ওই ধরনের বাধা যত দূর সম্ভব দূর করার চেষ্টা করা হচ্ছে। ইতিমধ্যে নারীদের জন্যই শুধু শাখা চালু করা হয়েছে। তাছাড়া ব্যাংকিং চ্যানেলে নারীদের অর্থায়নের জন্য নতুন নতুন ধারণাও চালু করা হয়েছে।
আরও পড়ুন
রংপুরে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন মহানগর ও জেলা শাখার দ্বিবার্ষিক সম্মেলন
র্যাব রংপুরে ৩৫১.৩৮ গ্রাম হেরোইন সহ স্বামী-স্ত্রী আটক করেছে
দুর্নীতির ফাইল নষ্ট করতেই সচিবালয়ে আগুন: রংপুরে রিজভী