December 19, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, December 18th, 2025, 6:53 pm

খুলনায় ৫ম উপকূলীয় শিশু সম্মেলনের বক্তারা জলবায়ু সহনশীল ও নিরাপদ শিশুবান্ধব উপকূল গঠনে সম্মিলিত উদ্যোগ জরুরি

খুলনায় অনুষ্ঠিত পঞ্চম উপকূলীয় শিশু সম্মেলনে বক্তারা বলেছেন, “শিশুদের সাথে থাকুন, শিশুদের অধিকারের কথা বলুন এবং শিশুদের দাবিকে অগ্রাধিকার দিন- আজ, আগামীকাল ও সর্বদা।” জলবায়ু সহনশীল ও নিরাপদ শিশুবান্ধব উপকূল গঠনে রাষ্ট্র, সমাজ ও সকল অংশীজনের সম্মিলিত উদ্যোগ অপরিহার্য বলে মত দেন তারা।

বৃহস্পতিবার (১৮ ডিসেম্বর) সকালে উপক‚লীয় শিশু ফোরামের আয়োজনে নগরীর সিএসএস আভা সেন্টারে এ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।

সম্মেলনে বক্তারা বলেন, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের জীবনযাত্রা জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির সঙ্গে গভীরভাবে সম্পর্কিত। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, বন্যা, নদীভাঙন এবং পর্যাপ্ত আশ্রয়কেন্দ্রের অভাব-এসব চ্যালেঞ্জ শিশুদের প্রতিনিয়ত মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এই বাস্তবতা আমাদের আরও সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে বাধ্য করে, যাতে উপকূলীয় শিশুদের সুরক্ষা, নিরাপত্তা ও অধিকার নিশ্চিত করা যায়। বক্তারা মনে করেন, শিশুদের মতামত যদি জাতীয় ও স্থানীয় পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হয়, তবে সেই পরিকল্পনা আরও ন্যায্য, টেকসই ও কার্যকর হবে।

শিশু ফোরামের প্রতিনিধিরা বলেন, ঘূর্ণিঝড়ের শব্দ শুধু বাতাসের শব্দ নয়- এটি একটি শিশুর বুকে জমে থাকা ভয় ও আর্তনাদ। জলোচ্ছ¡াসের পানি কেবল পানি নয়, এটি একটি শিশুর স্বপ্ন, বাড়ি ও স্কুল ভাসিয়ে নেওয়ার নিষ্ঠুর বাস্তবতা। দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক আঘাত শিশুদের মনে দীর্ঘমেয়াদি ক্ষত সৃষ্টি করে, যা অনেক সময় দৃশ্যমান না হলেও অত্যন্ত গভীর। তারা রাতে ঘুমাতে পারে না, উচ্চ শব্দে ভয় পায়, একা থাকতে চায় না এবং মনোযোগ হারায়- যা পোস্ট ট্রমাটিক স্ট্রেস ডিজঅর্ডার (পিটিএসডি)-এর লক্ষণ।

শিশু প্রতিনিধিরা আরও বলেন, সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয় হলো- উপকূলীয় এলাকায় দুর্যোগ-পরবর্তী মানসিক স্বাস্থ্য সেবার জন্য কার্যকর কোনো ব্যবস্থা নেই। কোনো স্বাস্থ্যকেন্দ্রে মানসিক স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ নেই, কোনো স্কুলে প্রশিক্ষিত কাউন্সিলর নেই। শিক্ষক ও অভিভাবকদের মধ্যেও সচেতনতার ঘাটতি রয়েছে। ফলে শিশুরা নিজের কষ্ট নিজের মধ্যেই চেপে রাখে, যা ভবিষ্যতে তাদের আচরণ, আত্মবিশ্বাস, সামাজিকতা ও শিক্ষাজীবনে দীর্ঘস্থায়ী নেতিবাচক প্রভাব ফেলে।

বক্তারা আরও বলেন, জলচ্ছাস ও ঘূর্ণিঝড় শুধু ঘরবাড়ি ধ্বংস করে না- এগুলো শিশুদের শৈশব, আনন্দ, খেলা ও সামাজিক পরিবেশও কেড়ে নেয়। খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক কার্যক্রম ও পাড়ার বন্ধুদের সঙ্গে কাটানো সময় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় শিশুরা শারীরিক সক্রিয়তা, সৃজনশীলতা ও মানসিক শক্তি বিকাশের মৌলিক সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। এক অর্থে দুর্যোগ উপকূলীয় শিশুদের রঙিন শৈশবকে ধুয়ে নিয়ে যাচ্ছে। বক্তারা বলেন, নীতি-নির্ধারণে শিশুদের কণ্ঠহীনতা হলো সবচেয়ে বড় জলবায়ু অন্যায়।

শিশু প্রতিনিধিরা বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় শিশুরা- তাদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য, নিরাপত্তা ও শৈশব বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে। অথচ জলবায়ু পরিবর্তন বা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনার নীতি-নির্ধারণে শিশুদের অংশগ্রহণ প্রায় অনুপস্থিত। আশ্রয়কেন্দ্রের নকশা, পানি ও স্যানিটেশন, স্বাস্থ্যসেবা কিংবা স্কুল পুনর্গঠনের পরিকল্পনায় শিশুদের বাস্তব চাহিদা উপেক্ষিত থাকে। স্থানীয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা কমিটি কিংবা উপজেলা ও জেলা পর্যায়ের পরিকল্পনা প্রক্রিয়ায় শিশুদের অংশগ্রহণ নেই বললেই চলে।

জলবায়ু ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে শিশুদের অংশগ্রহণকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃতি দেওয়ার ওপর জোর দেন বক্তারা। তারা বলেন, “শিশুরা কেবল দুর্যোগের ভুক্তভোগী হতে চায় না- তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের অংশ হতে চায়।”

জাগ্রত যুব সংঘ-জেজেএস-এর নির্বাহী পরিচালক এটিএম জাকির হোসেনের সভাপতিত্বে সম্মেলনে সম্মেলনের উদ্বোধনীপর্বে প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন লেখক, গবেষক ও শিক্ষা পরামর্শক ড. রেজা মাহমুদ আল হুদা এবং নগর পরিকল্পনাবিদ আবেদ ফেরদৌস হোসেন।

বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য দেন খুলনা প্রেসক্লাবের আহ্বায়ক এনামুল হক, জেলা মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের উপপরিচালক সুরাইয়া সিদ্দিকা, জেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা সাইদুর রহমান এবং খুলনা সিটি কর্পোরেশনের স্থাপতি রেজবিনা খাতুন রিক্তা।

অনুষ্ঠান পরিচালনা করেন সিনিয়র ডিরেক্টর (প্রোগ্রাম) এমএম চিশতি। সম্মেলনের উদ্বোধনী পর্বে ধন্যবাদ জ্ঞাপন করেন শিশু প্রতিনিধি সাহারা রহমান ও স্নেহা।

দিনব্যাপী এ উপক‚লীয় শিশু সম্মেলনের সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তৃতা করেন, খুলনা বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম। এসময় কপ-৩০ এর অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেন, এ্যাওসেড-এর নির্বাহী পরিচালক শামীম আরেফীন এবং ব্রাকের জলবায়ু পরিবর্তনজনিত হাবের ডেপুটি চীফ ড. গোলাম রব্বানী।

অন্যান্যের মধ্যে বক্তৃতা করেন, খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের (কুয়েট) অধ্যাপক ড. আনজুম তাসনুভা, সমাজসেবা অধিদপ্তরের পিএইচটি সেন্টারের তত্ত¡াবধায়ক মোঃ শফিকুল ইসলাম, খুলনা জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা আব্দুল করিম প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তৃতায় খুবি ভিসি অধ্যাপক ড. রেজাউল করিম বলেন, দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে অগাদ সম্পদ থাকলেও জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে জীবিকা নির্বাহে বেশ চ্যালেঞ্জ নিয়ে চলতে হচ্ছে। অথচ উপক‚লীয় অঞ্চলের ২৩টি জেলায় দেশের মোট জনগোষ্ঠীর ২৩ শতাংশ মানুষের বাস।

 

সম্মেলনে উপক‚লীয় শিশুরা ১৭ দফা দাবিনামা তুলে ধরেন। এগুলো হলো- উপকূলীয় অঞ্চলের ঝুঁকিতে থাকা সকল শিশুর জন্য নিরাপদ আতশ্রয়ের ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, নারী ও বিশেষ চাহিদাসম্পন্ন শিশু ও মানুষের জন্য আশ্রয়কেন্দ্রে বিশেষ ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, দুর্যোগপ্রবণ (বন্যা ও ঝড়) এলাকায় জরুরি অবস্থাতেও বিদ্যালয়ের ক্লাস চালু রাখার জন্য বিকল্প ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, উপকূলীয় অঞ্চলের জনগণের আয় ও জীবিকা সুরক্ষিত রাখা, সবার জন্য নিরাপদ পানীয় জলের নিশ্চয়তা দেওয়া, উপকূলীয় অঞ্চলের শিশুদের শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বিশেষ তহবিল প্রতিষ্ঠা করা, দুর্যোগকালীন ও পরবর্তী সময়ে শিশুদের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য নিশ্চিত করা, প্রত্যন্ত উপকূলীয় অঞ্চলে মানসম্মত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তনে ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর জন্য যথাযথ ক্ষতিপূরণ নিশ্চিত করা, জলবায়ু-বাস্তচ্যুত মানুষদের নগর এলাকায় শিক্ষা ও সামাজিক সুরক্ষার আওতায় অন্তর্ভুক্ত করা, জরুরি পরিস্থিতিতে সহিংসতা থেকে শিশুদের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, বিশেষ করে কিশোরীদের ক্ষেত্রে বিশেষ নজর দেওয়া, জরুরি পরিস্থিতিতে মানসিক স্বাস্থ্যসেবার ব্যবস্থা নিশ্চিত করা, জলবায়ু পরিবর্তন ও দুর্যোগ ঝুঁকি হ্রাস (ডিআরআর) পরিকল্পনা ও আলোচনায় শিশুদের অন্তর্ভুক্ত করা, জলবায়ু পরিবর্তন ও ডিআরআর পরিকল্পনা ও আলোচনায় শিশু নেতৃত্বকে অগ্রাধিকার দেওয়া, সুন্দরবন, নদনদী ও পরিবেশের সুরক্ষা নিশ্চিত করা, নদী, খাল, জলাশয় এবং বঙ্গোপসাগরকে প্লাস্টিক ও দখলমুক্ত রাখা এবং ভেড়ী বাঁধ ভাঙ্গন ও লবণাক্ততার কারণে বাস্তচ্যুত পরিবারগুলোর জন্য নিরাপদ আবাসনের ব্যবস্থা করা।