October 5, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Tuesday, June 14th, 2022, 9:25 pm

গ্যাস উৎপাদনে পিছিয়ে পড়ছে দেশীয় কোম্পানিগুলো

ফাইল ছবি

নিজস্ব প্রতিবেদক:

দেশে প্রাকৃতিক গ্যাসের ক্রমবর্ধমান চাহিদা পূরণে গ্যাস উৎপাদনকারী বিদেশি কোম্পানিগুলোর ওপর নির্ভরশীলতা যেমন বাড়ছে, একইসঙ্গে তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) আমদানির দিকেও ঝুঁকছে দেশ। এর অন্যতম কারণ হলো নিজেদের গ্যাসক্ষেত্রগুলো থেকে উৎপাদন বাড়ানোয় অনেকাংশেই পিছিয়ে দেশীয় কোম্পানিগুলো। যেখানে দুই থেকে আড়াই দশক আগেও দেশে গ্যাস উৎপাদনের পুরোটাই ছিল দেশি কোম্পানিগুলোর হাতে। কিন্তু দুই দশকের ব্যবধানে এ খাতের অর্ধেকেরও বেশি দখলে নিয়েছে বিদেশি বিভিন্ন কোম্পানি। গ্যাস উৎপাদনে এই বিদেশনির্ভরতা নিকট ভবিষ্যতেই ঝুঁকির কারণ হতে পারে বলে আশঙ্কা জ¦ালানি বিশেষজ্ঞদের। জানা গেছে, বাংলাদেশে গ্যাসের প্রকৃত চাহিদা বর্তমানে দৈনিক চার হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। কিন্তু নিজস্ব উৎপাদন ও আমদানি মিলিয়ে জোগান দেওয়া হচ্ছে মাত্র তিন হাজার মিলিয়ন ঘনফুট। এতে বিদেশ থেকে অনেক টাকায় গ্যাস আমদানি করেও চাহিদা পূরণ যাচ্ছে না। বড় একটি অংশ ঘাটতি থেকেই যাচ্ছে। কিন্তু গ্যাস ক্ষেত্রগুলোর ওপর গবেষণা করে যথাযথ প্রক্রিয়ায় উত্তোলন করা গেলে, নিজস্ব উৎপাদনের মাধ্যমেই শতভাগ গ্যাসের চাহিদা মেটানো সম্ভব। বর্তমানে নিজেদের উৎপাদন সক্ষমতা থেকে চাহিদা পূরণের সক্ষমতার ৭৫ শতাংশ মেটানো হচ্ছে। এটিকে দ্বিগুণ করার মাধ্যমে শুধু সক্ষমতা নয়, ঘাটতিও মেটানো যেতে পারে। সংশ্লিষ্টদের মতে, দেশে মোট চাহিদার মধ্যে বাপেক্স ১০৫ মিলিয়ন, বিজিএফসিএল ৬৪০ মিলিয়ন আর সিলেট দিচ্ছে ৭৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। এসব রাষ্ট্রীয় গ্যাসফিল্ডগুলো থেকে ৮১৫ মিলিয়ন ঘনফুটের মতো গ্যাস পাওয়া যাচ্ছে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক ফিল্ডগুলো যেমন শেভরন দিচ্ছে ১ হাজার ৪১৫ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। নিজস্ব সক্ষমতার মাধ্যমে দেশীয় গ্যাস ফিল্ডগুলোর উৎপাদন বাড়াতে পারলে দৈনিক চাহিদা পূরণে আমদানিনির্ভর হতে হবে না। জানা গেছে, গত আড়াই দশকে বিদ্যমান গ্যাস উৎপাদনের ৬৩ ভাগ চলে গেছে বিদেশী কোম্পানিগুলোর দখলে। আর দেশীয় কোম্পানিগুলো উৎপাদন করছে ৩৭ শতাংশ। অথচ ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত শতভাগ উৎপাদন করত দেশীয় কোম্পানি। গ্যাস উৎপাদনে পেট্রোবাংলার এক পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, ১৯৯৮ সালের আগ পর্যন্ত চাহিদার পুরো গ্যাস উৎপাদন করত জাতীয় তিন কোম্পানি। কিন্তু ১৯৯৮ সালে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন এনার্জির মাধ্যমে গ্যাস সরবরাহে বিদেশী কোম্পানির কার্যক্রম শুরু হয়। ওই বছর সমুদ্র্রবক্ষে আবিষ্কৃত সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন শুরু করে কোম্পানিটি। ২০০৪ সালে গ্যাস উৎপাদনে ৭৬ শতাংশ অবদান ছিল দেশীয় কোম্পানিগুলোর। তখন ২৪ শতাংশ গ্যাস উৎপাদন করত বিদেশী কোম্পানি। আড়াই দশকের ব্যবধানে গ্যাস উৎপাদনে দেশীয় কোম্পানিগুলোর অবদান ৩৭ শতাংশে নেমে এসেছে। পেট্রোবাংলার সর্বশেষ পরিসংখ্যান মতে, গত ২২ ফেব্রুয়ারিতে ২৩৪ কোটি ৮৫ লাখ ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন হয়েছে। এর মধ্যে বিদেশী দুই কোম্পানি উৎপাদন করেছে প্রায় ১৪৮ কোটি ঘনফুট, যা মোট উৎপাদনের ৬৩ শতাংশের বেশি। আর ওই দিন দেশী তিন কোম্পানি উৎপাদন করেছে ৮৫ কোটি ৮৬ লাখ ঘনফুট, যা মোট উৎপাদনের ৩৭ শতাংশের কম। পরিসংখ্যান বিশ্লেষণ করলে আরো দেখা যায়, ২০১১-১২ অর্থবছরে দেশে তিনটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করত। এর মধ্যে যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি কেয়ার্ন সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্র থেকে, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক কোম্পানি শেভরন জালালাবাদ, মৌলভীবাজার ও বিবিয়ানা গ্যাসক্ষেত্র থেকে এবং যুক্তরাজ্যভিত্তিক কোম্পানি তাল্লো বাংগোরা থেকে গ্যাস উত্তোলন করত। ওই অর্থবছরে উৎপাদিত গ্যাসের ৫২ শতাংশ উৎপাদন করে এ তিনটি বিদেশী কোম্পানি। কিন্তু অতিরিক্ত গ্যাস উত্তোলন করায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে সাঙ্গু গ্যাসক্ষেত্রে গ্যাস উৎপাদন বন্ধ হয়ে যায়। ওই বছর থেকে দুটি বিদেশী কোম্পানি গ্যাস উত্তোলন করছে। এর মধ্যে বেশির ভাগ করছে শেভরন। এ বিষয়ে পেট্রোবাংলার একটি দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, দেশীয় কোম্পানিগুলোর উৎপাদন কমে যাওয়ায় বাড়তি চাহিদা মেটাতে বিদেশী কোম্পানিগুলোকে অতিরিক্ত গ্যাস উৎপাদন করতে বলা হচ্ছে। যেখানে উৎপাদনক্ষমতার ৫০ থেকে ৬০ শতাংশ উৎপাদন করার কথা, সেখানে কোনো কোনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে উৎপাদন করা হচ্ছে প্রায় শতভাগ। এর ফলে একদিকে বিদেশী কোম্পানিগুলো স্বল্পসময়ে বাড়তি উৎপাদন করে অতিরিক্ত অর্থ তুলে নিচ্ছে, অন্য দিকে গ্যাসের মজুদও দ্রুত ফুরিয়ে আসছে, যা আমাদের জন্য হুমকিজনক। বিশ্বজুড়েই গবেষণা বলছে, প্রাথমিক পর্যায়ে সর্বোচ্চ ৫০ শতাংশ গ্যাস উত্তোলন সম্ভব হয়। পরবর্তী আরও দুটি ধাপে উত্তোলন করলে ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত গ্যাস উত্তোলন করা যেতে পারে। কিন্তু বাংলাদেশের কোম্পানিগুলো এরকম কোনো চেষ্টা কখনো করেনি। জ¦ালানি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ইউরোপে প্রায় ৬০ শতাংশ গ্যাস আমদানি হয় রাশিয়া থেকে। রাশিয়া- ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে এখন এ গ্যাস মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য দেশ থেকে আমদানি হওয়ার শঙ্কা দেখা দিয়েছে। এতে এলএনজির দাম অস্বাভাবিক হারে বেড়ে যেতে পারে। ধারণা করা হচ্ছে, প্রতি ইউনিট ৫০ ডলারে পৌঁছতে পারে, যা এখন স্পট মার্কেট থেকে ২৮ ডলারে পাওয়া যাচ্ছে। জ¦ালানি নিরাপত্তা বাড়ানোর জন্য দেশীয় গ্যাস উৎপাদন বাড়ানোর দিকে বেশি জোর দিতে হবে, অন্যথায় সঙ্কট আরো বেড়ে যেতে পারে।