এস এ শফি, সিলেটঃ
বিগত পনের বছরে ধ্বংস হয়ে যাওয়া সিলেটের আবাসন খাত নিয়ে নতুন করে স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন সিলেটের কোটি কোটি টাকা বিনিয়োগকারিরা। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সিলেটে গড়ে উঠা শতাধিক হাউজিং কোম্পানীগুলো আবারও তাদের তৎপরতা শুরু করেছে।
আবাসন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, ২০০১ সালের দিকে হঠাৎ করে সিলেটের আবাসন সেক্টর রমরমা হয়ে উঠে। প্রবাসী বিনিয়োগে গড়ে উঠা এসব হাউজিং কোম্পানীর ৬০ থেকে ৭০ শতাংশই ছিলেন দেশের বাইরে অবস্থানরত বাংলাদেশীরা। ব্যাপক হুলুস্থুল পড়ে যায় দেশে বিদেশে। একের পর এক কোম্পানী হতে থাকে। ২০১০ সালে সিলেটে একটি মেলা হয়েছিলো। সে মেলার নাম ছিলো বিডিরেড আবাসন মেলা। সে সময় ১১০টি কোম্পানী ছিলো হাউজিং ফ্ল্যাট ব্যবসায়ীদের এ সংগঠনে। ২০১১ সালে অনুষ্ঠিত মেলায় অংশ নেয় ৭১টি কোম্পানী সময়ের ব্যবধানে ২০১৩ সালে অনুষ্ঠিত সিলেটের আবাসন মেলায় সে সংখ্যা দাড়ায় ৫৮টিতে। আর ২০২৩ সালে সিলেটে অনুষ্ঠিতমেলায় মাত্র ২০টি কোম্পানী অংশ নেয়। তাও আবাসন সরাসরি হাউজিং কোম্পানী বলতে যা বোঝায় সে ধরনের প্রতিষ্ঠান ছিলো মাত্র ১০টি। আর বাকীগুলো ছিলো ইন্টেরিয়র এবং নির্মাণ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন কোম্পানী। এ মেলায় চরম হতাশা ব্যক্ত করেন সিলেটের ব্যবসায়ীরা। তারা জানান মাত্র ১৩ বা ১৫ বছরে ৯০ টি কোম্পানী হাওয়া হয়ে গেছে। কোনো অবস্থাতেই দাড়াতে পারছেনা।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সর্বশেষ ২০২৩ সালে সারেগ আয়োজিত মেলায় যে সব কোম্পানী অংশ নেয় তাদের মধ্যে সিলকো হোম,আল ফালাহ, হিলভিউ, হিল সাইড হলি আরবান,ড্রিমল্যান্ড এবং আপন এসোসিয়েট । সোনার গাঁ আবাসিক প্রকল্প, বোরহান মডেল টাউন, রয়েল সিটিসহ কিছ‚ কোম্পানী আবাসন বাজারে থাকলেও তারা কেউ এ মেলায় অংশ নেয়নি। এর পেছনেও রয়েছে নানা কারণ। সুন্দরবন, লালমাটিয়া,শ্যামল ছায়া. ড্রিমসিটি, অপরূপা, সানরাইজ হাউজিংসহ এমন সব চালু কোম্পানী এখন প্রায় বিলুপ্ত। গত ১৫ বছরে সিলেটে একচেটিয়া ব্যবসা করেছে আর্ক রিয়েল এস্টেট গ্রæপ। তারা ছাড়া সিলেটে তেমন কোনো প্রতিষ্টান বড় অগ্রগ্রতিতে যেতে পারেনি।
বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, তিন কারণে সিলেটের আবাসন ব্যবসায় ধ্বস নেমেছে। সিলেটের বিনিয়োগকারীদের সঙ্গে আলাপকালে জানা গেছে, প্রথমতঃ ওয়ান ইলেভেনের সময়কার সরকারের প্রশাসনিক নানা হয়রানীর কারণে হাউজিং ব্যবসায় ধ্বস নামে। তখনকার সময়ে স্বচ্ছতা আনয়নের নামে হাউজিং কোম্পানীল পরিচালকদের অনেকেই হয়রানীর শিকার হয়েছেন। হাউজিং প্রকল্পের নামে গড়া কোম্পানীগুলোর নানা অনিয়ম দূর্নীিিত ধরা পড়ে তখনকার প্রশাসনিক কর্মকর্তাদের কাছে। ফলে প্রশাসনিক জটিলতায় পড়ে অনেক কোম্পানী।
দ্বিতীয়তঃ আবাসন খাতে বিনিয়োগকারী অধিকাংশ প্রবাসী প্রতারণার শিকার হয়েছেন। অনেক বিনিয়োগকারী সংবাদ সম্মেলন কিংবা মামলা মোকদ্দমা করে তাদের ক্ষয়ক্ষতির কথা জানিয়েছেন। ফলে প্রবাসীরা মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন সেখান থেকে। আর প্রবাসীরা মুখ ফিরিয়ে নেয়ায় যারা কোম্পানী পরিচালনায় থাকতেন তারা পড়েছেন বিপাকে। ফলে অনেক অফিসই গুটিয়ে নিতে হয়েছে। সিলেট নগরের একেকটি হাউজিং কোম্পানীর অফিসের আয়তন ছিলো চার থেকে পাঁচ হাজার ফুট আয়তনের। সাজ সজ্জাও ছিলো ‘সেই রকম’। কিন্তু বিনিয়োগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় ‘ধরা’ খেয়েছেন এসব প্রতিষ্ঠানে জড়িতরা।
তৃতীয়তঃ যে কারণে বর্তমানে সিলেটের আবাসন খাতে গতি ফিরছেনা তা হলো,রড সিমেন্ট ইট বালুসহ নির্মাণ সামগ্রীর অত্যধিক মুল্য বৃদ্ধি এবং আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকা অন্যতম কারণ। অনেকেই বলছে যে দামে বিনিযোগ করে লাভের আশা করেছিলেন তা এখন স্বপ্ন। কারণ তাদের পরিকল্পনাকালীন ক্রয় মুল্য আর এখনকার বিক্রয়মুল্যের মধ্যে আকাশ পাতাল ফারাক। যে কারণে নতুন কোনো প্রকল্প বা চলমান প্রকল্পের উন্নতিকল্পে কোনো কাজ হাতে নিতে পারছেন না হাউজিং ব্যবসায়ীরা। গ্যাস সংযোগ বন্ধ থাকায় নির্মানাধীন অনেক বাসা বাড়ি এবং ফ্য¬াটে গ্যাস সংযোগ মিলছেনা ফলে অনেকেই নিরুৎসাহিত হচ্ছেন এ খাতে বিনিয়োগে।
এদিকে প্রশাসনিক এবং আমলাতান্ত্রিক জটিলতার কারণে চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত সিলেটের আবাসন খাত। এমনটি দাবী সিলেটের হাউজিং ব্যবসায় জড়িত ব্যবসায়ীরা। তারা বলছেন অনিয়ম যতটা না হয়েছে তার চেয়ে বেশী ক্ষতি করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। জমির দাম বৃদ্ধি, জেলা বা উপজেলা প্রশাসনের অনুমতি কিংবা পরিবেশের ছাড়পত্র দেয়ার নামে দিনের পর দিন ‘ঘোরানো’ হচ্ছে। আর সে জটিলতায় পড়ার কারণে শত চেষ্টা করেও সিলেটের আবাসন খাতকে আগের অবস্থায় ফেরাতে পারছেন না উদ্যেক্তারা। তবে সিলেটের আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘সারেগ’ এর নেতারা বর্তমান সময়ে আবারও আশার আলো দেখছেন এ খাতে। আবারও নতুন করে ঘুরে দাড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন বিনিয়োগকারীরা। তাদের মতে বিগত ১৫ বছরটাই হলো সিলেটের আবাসন ব্যবসায়ীদের জন্য‘কাল’। কারণ হিসেবে আবাসন ব্যবসায়ীদের সংগঠন ‘সারেগ’ এর সদস্য হিলভিউ এর পরিচালক মাওলানা খলিলুর রহমান এ প্রতিবেদককে বলেছেন, সিলেটের হাউজিং সেক্টরে মন্দা চলছে ২০০৭ সাল থেকে। যেসব জমি হাউজিং কোম্পানীর নামে রেজিস্ট্রেশন হয়েছে, সেগুলোর নামজারী করতে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অথবা জেলা প্রশাসকের অনুমোদন গ্রহণ বাধ্যতামুলক করা হয়েছে।
এরপর থেকে সিলেটের হাউজিং কোম্পানীগুলোর কর্মকর্তারা জেলা প্রশসকের কার্যালয় আর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের কার্যালয়ে শুধুই ঘুরেছেন। সরাসরি তারা ‘দেবেন না’ সে কথাও বলেননি। আর ফাইলও ছাড়েনি। যেন অদৃশ্য এক সুতোয় বাধা পড়ে হাউজিং কোম্পানীগুলোর নামজারী অনুমোদন। কারণ হাউজিং এর নামে জমি থাকলে জেলা প্রশাসকের বা ইউএনও’র অনুমতি লাগে। অপরদিকে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের আওতায় আসা জমিগুলোর সরকার নির্ধারিত মুল্য সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতার বাইরে চলে গেছে। যে জমি হাউজিং কোম্পানী লাভসহ লাখ টাকা ডেসিমেল বিক্রি করার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছিলো সে জমির সরকার নির্ধারিত মুল্য ডেসিমেল প্রতি এখন দুই লাখ টাকা। ফলে হুট করে নগর এলাকায় ঢুকে পড়া কৃষি জমিগুলো এখন মহা মুল্যবান হয়ে উঠেছে। যাচাই বাছাই ছাড়াই সরকার প্রত্যেকটি মৌজার জন্য আলাদা মুল্য নির্ধারণ করে দেয়ায় এখন আর কেউ হাউজিং কোম্পানীর জমি কিনতে আগ্রহী হচ্ছেননা। এছাড়া বিক্রিও করা যাচ্ছেনা নামজারীতে প্রশাসনে অনুমতি না থাকায়। প্রায় একই ধরণের জটিলতা দেখা দিয়েছে সিলেটের ফ্লাট বা এপার্টমেন্ট ব্যবসায়। সেখানেও বিকিকিনি আগের মতো নেই।
এ ব্যাপারে সারেগ এর সাধারন সম্পাদক দেলোয়ার হোসেন এর বরাত দিয়ে আবাসন ব্যবসায়ী সাহেদ আহমদ বলেন, তারা উভযেই বর্তমানে সৌদি আরবে অবস্থান করছেন। গত কয়েক বছর কঠিন সময় পার করেছে এ খাত। তাদের সংস্থায় সর্বশেষ ঠিকে থাকা কয়েকটি কোম্পানীর মধ্যে আর্ক, প্রিজম, হলি আরবান উল্লেখযোগ্য। তবে আগামীতে আবারও পরিবেশ ফিরে পাবে আবাসন খাত এমনটি আশা হলি আরবানের পরিচালক সাহেদ আহমদের।
এ ব্যাপারে সারেগ এর সভাপতি খয়রুল হোসেন বলেন,প্রায় শতাধিক কোম্পানী তাদের সংস্হার সদস্য ছিলো। বর্তমানে তা ১৫টির অধিক নয়। বিগত দিনগুলোতে সিলেটের আবাসন খাতে বিনিযোগকারীরা নানা কারণে হতাশ ছিলেন। নানা প্রতিবন্ধকতা ছিলো। সাম্প্রতিক সময়ে লক্ষ্য করছি কিছুটা পরিবর্তন এসেছে। অল্প জমির একটি কোম্পানী জেলা প্রশাসনের ছাড় পেয়েছে। তারা এখন বাধা হচ্ছেন না। পরিবেশ অধিদপ্তর কিছুটা বাধাগ্রস্ত করছে কোম্পানীগুলোকে। তবে বৈষম্য বিরোধী আন্দোলনের পর অনেকটা ইতিবাচক পরিবর্তন লক্ষ্য করছি। এ ধারা অব্যাহত থাকলে সিলেটের আবাসন খাতকে আমরা আবারও শক্ত ভিত্তির উপর দাড় করাতে পারবো ইনশাআল্লাহ।
আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের সাথে রংপুর পুলিশ সুপারের মতবিনিময়
অগ্নিকান্ডে মিঠাপুকুরের নয়ন একমাত্র উপার্জনকারীর মৃত্যুতে দিশেহারা পরিবার
সাবেক মন্ত্রী কায়কোবাদের সঙ্গে তুর্কী এমপির সাক্ষাৎ