জয়পুরহাট প্রতিনিধি:
থরে থরে সাজানো রুই, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, বিগ্রেড,বোয়াল, বাঘাইরসহ হরেক রকমের মাছ। সারি সারি দোকান। চলছে হাঁকডাক, দরদাম। এক কেজি থেকে শুরু করে ৩৫ কেজি ওজনের মাছ। লোকজনও উৎসাহ নিয়ে দেখছেন, কেউবা কিনছেন।
অগ্রাহায়ণ মাস। শুরু হয়েছে গ্রামঞ্চলে প্রাণের নবান্ন উৎসব। কৃষকদের ঘরে উঠেছে নতুন ধান। পিঠা-পায়েসের সাথে নানা আয়োজনে পালিত হচ্ছে কৃষকের কাঙ্খিত নবান্ন উৎসব। এ উৎসবকে ঘিরে মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের নিয়ে জয়পুরহাটের কালাই পৌরশহরের পাঁচশিরা বাজারে বসেছে এক দিনের ঐতিহ্যবাহী মাছের মেলা। ভোর ৪টা থেকে দিনব্যাপী চলে মাছ কেনা-বেচার উৎসব। এই দিনের অপেক্ষার প্রহর গুনেন এ জেলার প্রত্যক গ্রামের লোকজন। আর মেলায় ভিড় জমিয়েছেন জামাই ছাড়াও সব বয়সী মানুষ। সরকারি ক্যালেন্ডার নয়, পুঁথিগত প্রথা পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রাহয়ণ মাসের প্রথমদিনে পাঁচশিরা বাজারে প্রতিবছর বসে বৃহত এ মাছের মেলা।
জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার পাঁচশিরা বাজারে নবান্ন উৎসবে প্রতি বছর এখানে মাছের মেলা বসে। পঞ্জিকা অনুসারে অগ্রহায়ণ মাসের প্রথমদিনে পাঁচশিরা মেলা বসে। এই দিনে নতুন ধান কাটার উৎসবে কৃষকদের প্রস্ততকৃত চালে প্রথম রান্না উপলক্ষ্যে এই নবান্ন উৎসব। এইদিনে কৃষকরা সারাদেশে বসবাসরত মেয়ে-জামাই ও স্বজনদের আমন্ত্রন করেন। তাদের নিয়ে পাড়া-মহল্লায় বয়ে যায় উৎসবের আমেজ। সাথে চলে পিঠা-পুলি, পায়েস, ক্ষীর, খই ও মুড়ি খাওয়ার ধুম। এই দিনটি পাঁচশিরা বাজারে বসে জেলার বৃহৎ মাছের মেলা। মেলায় অংশ নেয় উপজেলার মাত্রাই, হাতিয়র, মাদারপুর, হাটশহর, হারুঞ্জ, পুনট, বেগুনগ্রাম, পাঁচগ্রামসহ ২৫ থেকে ৩০ গ্রামের মানুষ। নদী, দীঘি ও পুকুরের স্বাভাবিক বেড়ে ওঠা দেশীয় প্রজাতির টাটকা মাছে ভরপুর ছিল এই মেলা। এই উৎসবে প্রতি বাড়িতে মেয়ে জামাইসহ স্বজনদের আগে থেকে দাওয়াত দেয়া হয়। বিভিন্ন এলাকা থেকে শত শত মানুষ মেলায় আসে। রীতি নয়, প্রথা অনুযায়ী প্রতি বছর নবান্ন উৎসব পালন করতে আসেন সারাদেশে বসবাসরত তাদের জামায়-মেয়ে, বিয়াই-বিয়ানসহ নিকট আত্মীয়-স্বজনরা। মুলত প্রতিযোগীতা করে মেলা থেকে জামাইরা মাছ ক্রয় করে শ্বশুর বাড়ীতে নিয়ে যান। তাইতো মেলার প্রতিটি দোকানে সাজানো ছিল দেশীয় জাতের রুই, মৃগেল, কাতলা, চিতল, সিলভার কার্প, পাঙ্গাস, ব্রিগেট, বাঘাইরসহ নানা ধরনের মাছ। মেলায় বিশালাকৃতির একটি মাছ মাথার ওপর তুলে ক্রেতা আকর্ষণের চেষ্টা করছেন মাছ বিক্রেতারা। মেলায় সর্বোচ্চ ৩৫ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ বিক্রি হয়েছে ৪২ হাজার টাকায় এবং ১৯ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ২৫ হাজার টাকায়। ৩০০ থেকে ৬০০ টাকা কেজি দরে বিগ্রেড ও সিলভার কার্প মাছ বেশি বিক্রি হয়েছে। রুই ও কাতলা মাছ বিক্রি হয়েছে ৪০০ থেকে ১৩০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
এলাকার প্রবীণদের ভাষ্যমতে, মাছ ব্যবসায়ীরা কয়েকদিন আগে থেকেই তাদের আড়ৎ ঘরে নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করেন। মেলায় বিভিন্ন শ্রেনী-পেশার মানুষরা উচ্চ মুল্যে এসব মাছ ক্রয় করেন। এ বছর ৩ কেজি থেকে ৩৫ কেজি ওজনের মাছের সমাগম চখে পড়েছে মেলায়। আগের তুলনায় এ বছর মেলায় লোকজনের উপস্থিতিও ছিল বেশী। ক্রয়-বিক্রয়ও হয়েছে প্রচুর। কাউকেই খালি হাতে মেলা থেকে ফিরে যেতে চখে পড়েনি। সাধ্যমত সবাই মাছ ক্রয় করেছেন। তবে ব্যবসায়ীরা বলছেন ভিন্ন কথা। গত বছরের তুলনায় এবার বেঁচা-কেনা কম। তারা লোকশানের সঙ্কায় রয়েছেন।

মাছ ব্যবসায়ী আব্দুল লতিফ বলেন, নানান জাতের বড় বড় মাছ সংগ্রহ করা হয়েছে। কাতলা, রুই, মৃগেল ৭’শ থেকে দেড় হাজার টাকা কেজিতে এবং বাঘাআইর ও চিতল মাছ ১৩শ থেকে ২ হাজার টাকায় বিক্রি হয়েছে। মাঝারি আকারের মাছ ৩০০ টাকা থেকে ৪০০ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে। এবার ক্রেতা কম থাকায় এখন পর্যন্ত মাছ বিক্রি তেমন হয়নি। মাছ নিয়ে হয়তো এবার বিপাকে পড়তে হবে।
নবান্ন উৎসবে আঁওড়া মহল্লায় শ^শুর মকবুল হোসেনের বাড়িতে দাওয়াত খেতে এসেছেন বগুড়ার শিবগঞ্জ উপজেলার বিহার গ্রামের জামাই মিজানুর রহমান। তিনি বলেন, শশুর প্রতিবছরই দাওয়াত করেন। এই মেলা জামাই-মেয়ে উপলক্ষ্যেই আয়োজন করা হয়, সে কারনে মাছ একটা কিনতেই হয়। ১২ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ কিনেছি। এবার মাছের দাম একটু বেশী। তারপরও ভাল লাগছে।
পৌরশহরের মুলগ্রাম মহল্লার সতেন চন্দ্র বর্মণ বলেন, প্রতিবছর মেয়ে-জামাই, নাতি-নাতনি ও স্বজনরা এই দিনের অপেক্ষায় চেয়ে থাকে। কষ্ট হলেও আয়োজন করতে হয়। প্রায় ২৬ হাজার টাকায় ১৪ কেজি ওজনের একটি কাতলা মাছ এবং ১৮ কেজি ওজনের একটি সিলভার কার্প মাছ কিনেছি। বাড়িতে গেলে নাতি-নাতনিরা খুব খুশি হবে।
কালাই হাট ইজারাদার আব্দুল আলিম সরকার বলেন, আসলে এই মেলায় আয়োজন করতে হয়না। প্রতিবছর এইদিনে মেলা অটোম্যাটিক বসে। বেঁচা-কেনাও হয় প্রচুর। গত বছরের চেয়ে এবার মেলায় মাছের আমদানি বেশী। যে যেভাবে পারছেন মাছ ক্রয় করছেন। মেলায় কমপক্ষে এক কোটি টাকার মাছ ক্রয়-বিক্রয় হবে বলে আমি আশা করছি।
জয়পুরহাট জেলা মৎস্য কর্মকর্তা মাসুদ রানা বলেন, মেলায় ছোট বড় বিভিন্ন প্রজাতির মাছ ওঠেছে। বড় বড় মাছ দেখে এ এলাকার চাষীদের আগ্রহ বাড়ছে। মৎস্য বিভাগ চাষীদের সবসময় মাছ চাষে পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে।

আরও পড়ুন
শেখ হাসিনার ফাঁসির রায় : মিষ্টি বিতরণকে কেন্দ্র করে বাবুগঞ্জে ছাত্রদলের দুই গ্রুপে সংঘর্ষ নিহত -১,আহত-৮
ভাঙ্গুড়ায় দ্বিতীয় শ্রেণির ছাত্রী ব্লাড ক্যান্সারে আক্রান্ত : চিকিৎসা সহায়তা চাইলেন ভূমিহীন পিতা
ষষ্ঠ বাংলাদেশি হিসেবে ‘আমা দাবলাম’ জয় করলেন পাবনার তৌকির