April 13, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, April 12th, 2025, 12:41 pm

জুলাই আন্দোলনে সমন্বয়ক হওয়া তারেকের জন্য কাল

মাসুম বিল্লাহ ইমরান, খুলনা: ক্ষমতার লোভ অভ্যুত্থানের পক্ষে থাকা রাজনৈতিক দলগুলোকে মুখোমুখি অবস্থানে নিয়ে এসেছে। গত কয়েক মাসের বিএনপি, জামায়াত, গণঅধিকার পরিষদ, যুবদল-ছাত্রদলসহ অন্যান্য সংগঠনের নেতাদের ফেসবুক ওয়াল ঘুরলে আওয়ামী লীগের বিষয়ে কিছু পাবেন না। ১৬ বছরের জুলুম-নিপিড়ন, রক্তাক্ত জুলাই, শত শত ছাত্র-জনতা, শিশুর লাশ, কাছ থেকে গুলি করে হত্যার ঘটনাগুলো তারা ভুলেই গেছে।

খুলনায় ‘সমন্বয়ক’ পরিচয় শুনে যৌথ বাহিনী বেশি মেরেছে বলে অভিযোগ করেছেন এক ছাত্র। ভুক্তভোগী তারেক মোল্লা আযম খান কমার্স কলেজের ছাত্র। ছিলেন জুলাই আন্দোলনের সমন্বয়ক। বর্তমানে কমার্স কলেজ ছাত্রশিবিরের সভাপতি।

তিনি গতকাল বৃহস্পতিবার খুলনা প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে অভিযোগ করেন, ৪ এপ্রিল রাতে যৌথ বাহিনী তাঁর ওপর নির্যাতন চালিয়েছে। তখন এক পুলিশ সদস্য বলছিলেন, ‘৫ আগস্টের পর দেশটাকে জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিস। এখন আমরা মারব, আ’লীগ মারবে, বিএনপিও মারবে।’

গত দু’দিন শ্রমিক, প্রত্যক্ষদর্শী ও পুলিশের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে,  ৪ এপ্রিল রাত সাড়ে ১২টার দিকে নগরীর ঘাট এলাকায় ওবায়দুল নামের এক শ্রমিকের মোটরসাইকেল চেক করা হচ্ছিল। এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে তর্ক হয়। পরে শ্রমিকরা পুলিশের ওপর হামলা চালায়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ও ইটপাটকেল ছোড়াছুড়িতে পুলিশ-শ্রমিক উভয় আহত হন।

গভীর রাতে ২১ নম্বর ওয়ার্ড শ্রমিক দলের সভাপতি তালেব মোল্লার বাড়িতে অভিযান চালায় যৌথ বাহিনী। তাঁকে না পেয়ে ছেলে তারেক, কিশোর নাতি হৃদয় হাওলাদার এবং ওবায়দুলের ভাই শহিদুল হাওলাদারকে আটক করে। এ ঘটনায় খুলনা মেট্রোপলিটন পুলিশের গোয়েন্দা বিভাগের পরিদর্শক এবাদ আলী মামলা করেন। মামলায় তারেককে ১ নম্বর, নাতিকে ৩ নম্বর এবং তালেবকে ৫ নম্বর আসামি করা হয়। ৬ এপ্রিল জামিন পেয়েছেন তারেক ও হৃদয়।

মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়, ৪ এপ্রিল রাত ১২টা ২০ মিনিটে মামুর মাজারে মোটরসাইকেল চেক করা হচ্ছিল। অজ্ঞাতনামা তিন আসামি মোটরসাইকেল রেখে পালিয়ে যায়। পরে তারা অন্যান্য আসামিকে সঙ্গে নিয়ে বৈধ কাগজপত্র ছাড়া মোটরসাইকেল নিয়ে যেতে চায়। বাধা দিলে তারা পুলিশকে লক্ষ্য করে ইটপাটকেল নিক্ষেপ করে। দেশি অস্ত্র নিয়ে পুলিশের কাজে বাধা দেয়।

তারেক বলেন, ‘আমার বাবা ২১ নাম্বার ওয়ার্ড  শ্রমিকদল সভাপতি ও ২১ নাম্বার ওয়ার্ড বিএনপির সহ-সভাপতি। তাদের ভাষ্যমতে আমার বাবাকে বাসায় না পেয়ে প্রথমে আমার ১৭ বছরের ভাগ্নেকে ঘুম থেকে তুলে নেভী মারধোর শুরু করে। অতঃপর আমার আম্মুকে মুখে বন্দুক ঠেকিয়ে গুলি করার হুমকি দেয় এবং আমার আপুকে ধাক্কা মেরে মাটিতে ফেলে দেয়। তাদের চিৎকার শুনে আমি বাহিরে আসলে সদর থানার সেকেন্ড অফিসার নান্নু বলেন, “ও তালেব মেয়ার ছেলে এবং ছাত্রসমন্বয়ক” এই কথা শোনার পর আমার চারপাশের সোলজার গুলো প্রচন্ড ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে এবং নেভির অফিসার আবরার সাথেসাথে আমার হাতমুখ বেধে মার শুরু করে। আমি যে শিবির সভাপতি এটা বলার কোনো সুযোগ আমি পাইনি।

তাদের দু’জন আমার পা পাড়িয়ে ধরে চারজন হাত এবং একজন মাথা মাটির সাথে ঠেসে আমার বাসার সামনে ভুট করে শুইয়ে আবরার সহ অপর এক নেভী অফিসার মারতে থাকে। আশ্চর্যের ব্যপার আমি লক্ষ করলাম পুলিশের সাথে যে হাতাহাতি হয়েছে, আমি জড়িত ছিলাম কি ছিলাম না এগুলো তারা একবারের জন্যও যাচাই করার প্রয়োজন মনে করেনি। আমি কেন সমন্বয়ক- এটাই আমার অপরাধ। যদিও তারা আমাকে আমার পরিচয় প্রকাশের বিন্দুমাত্র সুযোগ দেয়নি। সমন্বয়ক বলার কারণ হলো সদর থানার সেকেন্ড অফিসার নান্নু জানতেন আমি খুলনার জুলাই অভ্যুত্থানের একজন সংগঠক ছিলাম।

অতঃপর তারা আমার হাতমুখ বেঁধে বাসার সামনে থেকে মেইন রোডে নিয়ে যায় এবং দ্বিতীয় দফা অমানবিক মারধর শুরু করে। আর তাদের মুখে একটাই কথা আমি কেন সমন্বয়ক। একপর্যায়ে আমি অজ্ঞান হয়ে গেলে আমার ভাগ্নেকে আবার মারা শুরু করে ওর চুল ধরে মুখে লাথি মারে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করে। তারপর আমার জ্ঞান ফিরলে তৃতীয় দফা তারা আমাকে মারধর শুরু করে। পূর্বের মতোই দু’জন পা পাড়িয়ে ধরে, চারজন হাত, একজন মাথা মাটির সাথে চাপটে ধরে দু’জন মারতে থাকে। এদফায় পুলিশের সদস্যরাও আমাকে চর-থাপ্পড়, কিল-ঘুষি মারে এবং অকথ্য ভাষায় গালাগালি করতে থাকে।

শেষমেশ ভোর ৪:৪৫ এর দিকে আমাকে ও আমার ভাগ্নেকে তারা পুলিশের গাড়িতে তুলে খুলনা মেডিকেল হাসপাতালের প্রিজন সেলের উদ্দেশ্যে রওনা করে। তখন সেখানে একজন পুলিশ কনস্টেবল যে দেখতে চিকন, লম্বা, চুল বড় এবং চুলে কালার করা। আমরা লোকাল ভখাটে পোলাপান বলতে যা বুঝি- তার পূর্ণ প্রতিফলন তার মাঝে ছিলো। বিষয়টি আরও পরিষ্কার হয় যখন তার মাতৃভাষা এবং পারিবারিক শিক্ষার সাথে পরিচিত হই। তার ব্যাবহারে বারবার ফুটে উঠছিলো ছাত্রলীগ কোটায় পুলিশে নিয়োগ পাবার বিষয়টি। এই কনস্টেবল আমার সাথে অত্যন্ত বাজে ব্যবহার করে।  সে বলে, ”৫ তারিখের পর দেশটা তোরা জাহান্নাম বানিয়ে ফেলেছিস। আগেই ভালো ছিলো। তোদের সমন্বয়কগিরি ছুটিয়ে দেবো। এখন থেকে আমরাও মারবো, আওয়ামীলীগও মারবে, বিএনপিও মারবে।” এমনকি গাড়ি থেকে নামার সময় ও আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দেয়। সবচেয়ে বাজে কাজ ছিলো এই মানব শয়তানটা আমার মা’কে নিয়ে ২৭ বার গালি দেয়।

মহানগর শিবিরের সভাপতি আরাফাত হোসেন মিলন বলেন পুলিশ কমিশনার জুলফিকার আলি হায়দারের সাথে যোগাযোগ করি। কেএমপি কমিশনার বলেন, “আমি খোজ নিয়েছি তারেকের কোনো সম্পৃক্ততা নেই, আমাদের মিস্টেক হয়েছে। তাকে ছেড়ে দেওয়ার প্রস্তুতি চলছে দুপুরের মধ্যে ছেড়ে দেওয়া হবে।” এই বলে আমাকে  আশ্বস্ত করা হয়। কিন্তু দুপুরে যোগাযোগ করা হলে জুম্মার পর ছাড়বে বলে জানায়। অতঃপর বিকেল ৪ টায় তারপর সন্ধ্যায়- এভাবে কাল ক্ষেপণ করতে থাকে। সন্ধ্যার পর থেকে পুলিশ কমিশনারের সাথে আর যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। অতঃপর আমরা জানতে পারি ্তারেকে আটকে রেখে পুলিশ ওদিকে মামলার প্রস্তুতি নিয়েছে। যেখানে  তারেকের সামান্যতম  সংশ্লিষ্টটা নেই, সেখানে তাকে প্রধান আসামী করে ডিবির ইনস্পেকটর এবাদ আলী বাদী হয়ে মামলা দায়ের করেন; যা দেখে আমি,  আমার সংগঠন এবং আমার জুলাই সহযোদ্ধাগন হতবাক হয়ে যাই।

মামলার বাদী ও গোয়েন্দা পুলিশের পরিদর্শক এবাদ আলী বলেন, ‘নৌবাহিনী সদস্যরা ধরার পর ওই সময় সে স্বেচ্ছায় স্বীকার করেছে মারামারিতে ছিল। আমাদের দেশের নিয়ম তো এমনই, পরে অস্বীকার করে।’বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের খুলনা মহানগর সভাপতি আল শাহরিয়ার বলেন, ‘এ নির্যাতনে জড়িত সবার শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।’

অভিযোগ অস্বীকার করে উপপরিদর্শক নান্নু মণ্ডল বলেন, ‘অভিযানে নেতৃত্ব দিয়েছিল নৌবাহিনী। মামলা করেছে ডিবি। আমি তারেককে চিনি না।’ সচেতন নাগরিক কমিটি খুলনার সাবেক সভাপতি অ্যাডভোকেট কুদরত ই খুদা বলেন, একজনের অপরাধ অন্যের ঘাড়ে চাপানোর চেষ্টা ফৌজদারি অপরাধ।