December 18, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Thursday, October 30th, 2025, 1:05 am

জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ব্যাপক প্রাণহানির জন্য ক্ষমা চাইবেন না শেখ হাসিনা

 

গত বছর দেশে ঐতিহাসিক জুলাই গণঅভ্যুত্থানকালে ব্যাপক প্রাণহানি, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দমনপীড়ন ও মারণাস্ত্র ব্যবহারের ঘটনায় ক্ষমা চাইবেন না ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

বুধবার আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা রয়টার্স, এএফপি ও ব্রিটিশ গণমাধ্যম দ্য ইন্ডিপেনডেন্টে দেওয়া সাক্ষাৎকারে তিনি এ কথা জানান। সাক্ষাৎকারগুলো ই-মেইলে নেওয়া।

গত বছরের জুলাইয়ে সরকারি চাকরিতে কোটা বাতিলের দাবিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মাধ্যমে বিক্ষোভ শুরু হয়। এটি ক্রমশ সরকার-বিরোধী আন্দোলনে রূপ নেয়। সর্বস্তরের মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। নিরাপত্তা বাহিনী নৃশংস ও প্রাণঘাতী বলপ্রয়োগের মাধ্যমে এর জবাব দেয়। প্রথম দফা মৃত্যুর পর ছাত্র নেতারা ঘোষণা করেন, শেখ হাসিনার অপসারণ ছাড়া তারা আর কিছু মেনে নেবেন না। এসময় প্রায় ১,৪০০ জনের মৃত্যু হয়েছে বলে জাতিসংঘের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে গত বছরের ৫ আগস্ট হেলিকপ্টারে চড়ে ভারতে পালিয়ে যান শেখ হাসিনা। এরপর থেকে তিনি দিল্লিতে অনেকটা আত্মগোপনে বাস করছেন। নেতাকর্মীদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি নিয়মিত যোগাযোগ করেন। তবে কারো সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন না। সশরীরে প্রকাশ্য কোনো অনুষ্ঠানেও তাকে দেখা যায়নি। সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতেও তাকে দেখা যায়নি। ক্ষমতাচ্যুতির পর এই প্রথম সংবাদমাধ্যমের সঙ্গে কথা বলেছেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী।

বাংলাদেশে গত বছরের পাঁচ ডিসেম্বর এক আদেশে শেখ হাসিনার সব ধরনের ‘বিদ্বেষমূলক বক্তব্য’ গণমাধ্যম ও সামাজিক মাধ্যমে প্রচারে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল (আইসিটি)। একই সঙ্গে আগের সব বিদ্বেষমূলক বক্তব্য সব মাধ্যম থেকে সরিয়ে ফেলতে আদেশ দেওয়া হয়েছে।

শহীদ পরিবারের কাছে ক্ষমা চাইবেন কিনা? দ্য ইন্ডিপেনডেন্টের এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘জাতি হিসেবে আমরা যে সব সন্তান, ভাই-বোন, চাচাতো-মামাতো-খালাতো-ফুফাতো ভাই-বোন এবং বন্ধুকে হারিয়েছি, তাদের প্রত্যেকের জন্য আমি শোকাহত। আমার সমবেদনা থাকবে।’

জুলাই আন্দোলনে প্রাণহানির ঘটনায় বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে (আইসিটি) তার বিচার চলছে। প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম আন্দোলনে ‘সব অপরাধের কেন্দ্রবিন্দু’ হিসেবে শেখ হাসিনাকে অভিযুক্ত করেছেন। দোষী সাব্যস্ত হলে মৃত্যুদণ্ড চেয়েছেন। এ বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন, মৃত্যুদণ্ড দিলে ‘বিস্মিত বা ভীত হবো না’। একে তিনি রাজনৈতিক প্রতিশোধের ‘সাজানো বিচার’ বলে উল্লেখ করেন।

তিনি বলেন,‘আইসিটি হলো আমার রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ নিয়ে গঠিত অনির্বাচিত সরকারের পরিচালিত সাজানো আদালত। সেই বিরোধীদের অনেকে আমাকে ক্ষমতা থেকে সরাতে যেকোনো কিছু করতে প্রস্তুত ছিল। পারিবারিক ও রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আমার চেয়ে বেশি আর কেউ জানে না। আইসিটির এই পদক্ষেপ সেই জঘন্য রীতির অংশ।’

গত বছর বিক্ষোভের সময় নেওয়া পদক্ষেপের পক্ষে সাফাই গেয়েছেন শেখ হাসিনা। একে তিনি ‘সহিংস বিদ্রোহ’ হিসেবে আখ্যা দিয়ে এই হত্যাকাণ্ডের জন্য ব্যক্তিগত দায় অস্বীকার করেন। তিনি বিপুল সংখ্যক হতাহতের জন্য ‘মাঠে থাকা নিরাপত্তা বাহিনীর মধ্যে শৃঙ্খলার অভাবকে দায়ী করেন।’

তিনি আরও বলেন,‘নেতা হিসেবে আমি চূড়ান্ত দায়িত্ব নিচ্ছি। কিন্তু নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার ওপর গুলি চালানোর নির্দেশ দিয়েছি বা তা চেয়েছি— এই দাবি মিথ্যা।’

গত বছর বিক্ষোভকারীদের ওপর যে দমন-পীড়ন চলেছিল, তা বিশ্বকে হতবাক করেছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের ডেপুটি আঞ্চলিক পরিচালক বাবু রাম পান্ত সে সময় বলেছিলেন, ‘নিহতের ক্রমবর্ধমান সংখ্যা প্রতিবাদ ও ভিন্নমতের প্রতি বাংলাদেশি কর্তৃপক্ষের অসহিষ্ণুতার নজির।’

জাতিসংঘের মানবাধিকার প্রধান ভলকার তুর্ক সে সময় বলেছিলেন, ‘ছাত্রদের ওপর হামলা মর্মান্তিক ও অগ্রহণযোগ্য।’

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে মৃত্যুর সংখ্যা নিয়ে শেখ হাসিনা আপত্তি জানান। তিনি বলেন, ‘১ হাজার ৪০০ সংখ্যাটি আইসিটির প্রচারণা। এটা অতিরঞ্জিত।’

শেখ হাসিনা বলেন, বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ার সময় সরকার ‘সদিচ্ছার সঙ্গে… জীবনহানি কমাতে’ পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার ব্যবস্থা করেছিল।
আইসিটির প্রধান প্রসিকিউটর তাজুল ইসলাম মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য শেখ হাসিনাকে ‘মূল পরিকল্পনাকারী এবং প্রধান স্থপতি’ হিসাবে বর্ণনা করেছেন।

তবে শেখ হাসিনা দাবি করেন, এই সহিংসতা তার সরকারের নির্দেশ থেকে নয়। বরং মাঠপর্যায়ের কর্মকর্তাদের সিদ্ধান্তের ফলে উদ্ভূত হয়েছিল। তিনি বলেন, ‘অভিযোগগুলো অনির্বাচিত সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য পূরণ করার জন্য বিকৃত সাক্ষ্য-তথ্য নির্ভর। মাঠপর্যায়ের নিরাপত্তাকর্মীরা মূল সিদ্ধান্তগুলো নিয়েছিল, তাদের নির্দেশিকা অনুসরণ করার কথা ছিল। সেই নির্দেশিকাগুলো নির্দিষ্ট পরিস্থিতিতে আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহারের অনুমোদন দেয়। উত্তপ্ত পরিস্থিতিতে কিছু সিদ্ধান্ত ভুল ছিল।’

গত বছরের ৫ আগস্ট দেশ ছেড়ে পালানোর সিদ্ধান্তের পক্ষে তিনি বলেন, ‘প্রয়োজনের তাগিদে দেশ ছাড়ি। থেকে গেলে শুধু আমার জীবন নয়, আশপাশের মানুষের জীবনও বিপন্ন হতো।’

এএফপিকে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে নিরাপত্তা বাহিনীকে জনতার উপর গুলি করার নির্দেশ দিয়েছিলাম— এই অভিযোগটি মিথ্যা।’ তবে তিনি স্বীকার করেন, ‘চেইন অব কমান্ডে কিছু ভুল ছিল। সামগ্রিকভাবে ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তাদের নেওয়া সিদ্ধান্তগুলো অপরাধের মাত্রা অনুযায়ী স্বাভাবিক ছিল, তাদের সদিচ্ছা ছিল এবং প্রাণহানি কমানোর উদ্দেশ্য ছিল।’

দ্য ইন্ডিপেনডেন্টকে তিনি বলেন, ‘গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে সহিংস আন্দোলনের মুখে দেশ রক্ষা করার সাংবিধানিক দায়িত্ব পালন করা নিয়ে বিচার হওয়া উচিত নয়।’

প্রাণঘাতী অস্ত্র ব্যবহার করতে নির্দেশ দেওয়ার অডিওগুলো নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ‘এগুলো সম্পাদিত’।

অন্তর্বর্তী সরকার গত মে মাসে সন্ত্রাসবিরোধী আইনে আওয়ামী লীগের কার্যক্রম নিষিদ্ধ করে। আগামী বছরের ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিতব্য নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ অনিশ্চিত। এ বিষয়ে শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আওয়ামী লীগের ওপর নিষেধাজ্ঞা শুধু অন্যায্য নয়, আত্মঘাতী।’

রয়টার্সকে তিনি বলেন, ‘আওয়ামী লীগ সহ সব প্রধান দলের সরাসরি অংশগ্রহণ ছাড়া নির্বাচন বিশ্বাসযোগ্য হতে পারে না।’

এএফপিকে তিনি আরও বলেন,‘আওয়ামী লীগের অংশগ্রহণ ছাড়া তিনি (ইউনূস) দেশের ভবিষ্যৎ বিভেদের বীজ বুনছেন। বাংলাদেশের নাগরিকদের পছন্দ বাছাইয়ের জন্য ইউনূসকে অবশ্যই আওয়ামী লীগকে পুনর্বহাল করতে হবে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য প্রতিযোগিতা, সব দলের সমান সুযোগ এবং বিকল্পগুলোর মধ্যে থেকে ভোটারদের বেছে নেওয়ার অধিকার প্রয়োজন। নির্বাচন হল প্রতিযোগিতা। নীতি অপছন্দ হওয়ায় আপনি একটি দলকে বাদ দিতে পারেন না।’

ভবিষ্যতে রাজনীতিতে ফেরার কোনো পরিকল্পনা আছে কিনা এএফপির এমন প্রশ্নের জবাবে শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমার অগ্রাধিকার হল বাংলাদেশের কল্যাণ ও স্থিতিশীলতা।’

রয়টার্সকে শেখ হাসিনা বলেছেন, আগামী বছরের নির্বাচনে অংশ নিতে না দিলে আওয়ামী লীগ এই নির্বাচন বয়কট করবে।

শেখ হাসিনা জানান, তার দলকে বাদ দিয়ে হওয়া নির্বাচনের মাধ্যমে যেই সরকারই হোক তাদের সময়ে তিনি দেশে ফিরবেন না। তিনি ভারতেই অবস্থান করবেন।

তিনি বলেছেন, ‘পরবর্তী সরকারের অবশ্যই নির্বাচনী বৈধতা থাকতে হবে। আওয়ামী লীগের কয়েক লাখ সমর্থক এমন পরিস্থিতি থাকলে ভোটে অংশ নিবে না। একটি কার্যকর রাজনৈতিক সিস্টেম চাইলে আপনি লাখ লাখ মানুষকে ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত করতে পারেন না।’

শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমরা আওয়ামী লীগের ভোটারদের অন্য দলকে সমর্থন করতে বলছি না। আমরা এখনো আশা করি, শুভবুদ্ধির উদয় হবে। আমরা নির্বাচনে অংশ নেওয়ার সুযোগ পাবো।’

তবে তিনি বা তার পক্ষে কেউ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের অংশ নেওয়ার সুযোগের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে নেপথ্যে আলোচনা করছেন কি-না সে বিষয়ে শেখ হাসিনা কিছু বলেননি।

ড. ইউনূসের মুখপাত্ররা শেখ হাসিনার মন্তব্যের বিষয়ে প্রতিক্রিয়ার অনুরোধে রয়টার্সকে তাৎক্ষণিক জবাব দেননি।

ফেরার পরিকল্পনা নিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, রাজনৈতিক অস্থিরতা সত্ত্বেও আওয়ামী লীগ দেশের ভবিষ্যৎ ভূমিকা পালনে ফিরে আসবে, সেটা সরকারে হোক আর বিরোধী দলে হোক। এক্ষেত্রে তার পরিবারের নেতৃত্ব দেওয়ার প্রয়োজন নেই।

তিনি বলেন,‘এটা আসলে আমার বা পরিবারের ব্যাপার না। বাংলাদেশের জন্য আমরা সবাই যা চাই, সেখানে সাংবিধানিক শাসন ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরতে হবে। কোনো ব্যক্তি বা পরিবার দেশের ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করতে পারে না।’

(প্রতিবেদনটি দৈনিক সমকাল থেকে নেওয়া)