অনলাইন ডেস্ক :
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে ধারণ করা মহাবিশ্বের কয়েকশ’ বছর কোটি আগের ছবি নিয়ে হৈ চৈ থামছেই না। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধে না পেরে পশ্চিমারা প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে কি না এ নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে। তবে বিজ্ঞানী ও বিশ্লেষকরা এ ধরনের সংশয়কে উড়িয়ে দিয়েছেন। তারা বলছেন, বিজ্ঞান তর্কের বিষয় নয় বরং যুক্তি ও প্রমাণের বিষয়। পৃথিবী সৃষ্টিরও আগের গহীন মহাশূন্যের হাজার হাজার গ্যালাক্সি বা ছায়াপথের ছবি তুলে পাঠিয়েছে নাসার ‘জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ। মহাবিশ্বের এ ছবি নিয়ে এরইমধ্যে বিশ্বজুড়ে হইচই পড়ে গেছে। পড়বেই না বা কেন? মার্কিন মহাকাশ গবেষণা সংস্থা নাসার দাবি, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ দিয়ে রঙিন যে ছবি পাওয়া গেছে তা মহাবিশ্বের সাড়ে তেরশ কোটি বছর আগের। কিন্তু প্রশ্ন হলো পৃথিবীর জন্মের এত বছর পর এসে কীভাবে হাজার কোটি বছর আগের ছবি তুলল জেমস ওয়েব? আর কীভাবেই বা কাজ করে টেলিস্কোপটি?
কী আছে নতুন ছবিতে ?
জেমস ওয়েব স্পেস টেলিস্কোপ দিয়ে মূলত মহাবিশ্বে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গ্যালাক্সিগুলোর একটি অংশকে ধারণ করা হয়েছে। ছবিতে মহাবিশ্বে ছড়িয়ে থাকা জ¦লজ¦লে আলোক রশ্মির বিচ্ছুরণ ফুটে উঠেছে। নাসার ওয়েবসাইটের দেওয়া তথ্য বলছে, মহাবিশ্বের প্রাচীনতম রূপ এটি। ছবিতে বিভিন্ন গ্যালাক্সির চারপাশে বাঁকানো গ্যালাক্সির আলো ফুটে উঠেছে। টেলিস্কোপে পৌঁছানোর আগে কয়েকশ কোটি বছর ধরে ভ্রমণ করেছে এ আলো। কয়েক হাজার ছায়াপথের ছবিকে এখন পর্যন্ত কোনো স্পেস টেলিস্কোপের তোলা মহাশূন্যের সবচেয়ে গহীন এবং সবচেয়ে ভালো মানের ইনফ্রারেড ছবি হিসেবে বিবেচনা করছে নাসা। মহাকাশ গবেষণা সংস্থাটি আরো জানিয়েছে, ছবিটি তুলেছে ওয়েব টেলিস্কোপের নিয়ার-ইনফ্রারেড ক্যামেরা। সাড়ে ১২ ঘণ্টায় বিভিন্ন তরঙ্গের ইনফ্রারেড আলো নিয়ে কম্পেজিট ছবিটি ধারণ করা হয়েছে। কয়েকশ’ কোটি বছর আগের ছবি কীভাবে এখন পাওয়া গেলো তা জানাব তার আগে জেনে নেই ইনফ্রারেড ও জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ কী?
ইনফ্রারেড রে : ইনফ্রারেড রে হলো সেই রশ্মি যেটা আমাদের দৃষ্টি সীমার মধ্যে থেকে সর্বোচ্চ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যরে অধিকারী। এই ধরনের বিকিরণ খালি চোখে দেখা যায় না। সাধারনত রিমোট কন্ট্রোলসমূহ ইনফ্রারেড রে তে কাজ করে। যার সাহায্যে বিভিন্ন ধরনের ফাংশন যেমন পাওয়ার সুইচ অন বা অফ করা, টিভি ভলিউম বেশি বা কম করা, এসি যন্ত্রের তাপমাত্রা নিয়ন্ত্রণ করা, পাখার গতি ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণ করা যায়। এছাড়াও অন্ধকারে ছবি তোলার জন্য জ্যোর্তিবিদ্যায় ব্যবহৃত হয়, সৌরচুল্লি ও সৌর হিটারে ব্যবহৃত হয়।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ : শুরুতেই বলে নেই, টেলিস্কোপ বা দূরবিক্ষণ যন্ত্র দিয়ে মূলত দূরের বস্তু পরিষ্কারভাবে দেখা যায়। আর মহাবিশ্বকে আরও বেশি সুস্পষ্ট ভাবে দেখতেই বানানো হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এটির চারটি অনন্য বৈশিষ্ট্য রয়েছে। আর তা হলো টেলিস্কোপটি যত ইচ্ছে বড় করা সম্ভব যে কারণে কোনো বস্তু থেকে সর্বোচ্চ পরিমাণ আলো এতে আপতিত হতে পারে। ফলে অতি উচ্চমাত্রার রেজুলেশনে দূরের বস্তু দেখা সম্ভব। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপকে এমনই এক স্থানে রাখতে হয় যেন পৃথিবীর বায়ুম-ল বাধা হিসেবে কাজ না করে। যতটুকু আলো আপতিত হয় তার প্রায় শতভাগ প্রতিফলিত এবং ফোকাস করে যাতে প্রয়োজনীয় তথ্য পাওয়া যায়। টেলিস্কোপটি সুনির্দিষ্ট তরঙ্গদৈরর্ঘ্যরে আলোর প্রতি সংবেদনশীল হয় যেন অনেক দূরবর্তী বস্তুও দেখা যায়। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটিকে তৈরি করা হয়েছে উচ্চ বিবর্ধক ক্ষমতা ও তাপীয় নিঃসরণ সংবেদনশীল হিসেবে। টেলিস্কোপ তৈরিতে যতগুলি প্রকৌশল চ্যালেঞ্জ ছিলো তার মধ্যে প্রধান চ্যালেঞ্জ এর আয়না নির্মান। আর এতে অনেক বেশি শক্তিশালী আয়না বসানো হয়েছে। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের মূল আয়নাটি ১৮টি হেক্সাগয়নাল সেগমেন্টে ভাগ করা, মোট দৈর্ঘ্য ২১ ফুট ৪ ইঞ্চি। মজার ব্যাপার হলো, জেমস ওয়েব টেলিস্কোপে স্থাপিত ১৮টি আয়না সোনার পাত দিয়ে মোড়ানো। সোনার পাত বসানোর মূল কারণ হলো একমাত্র স্বর্ণই সবচেয়ে বেশি ইনফ্রারেড রে প্রতিফলন করতে পারে। নাসার বিজ্ঞানীরা জানান, সিলভার ইনফ্রারেড রে প্রতিফলন করে ৯৫ ভাগ, এলুমিনিয়াম ৮৫ ভাগ আর স্বর্ণ ৯৯ ভাগ ইনফ্রারেড রে প্রতিফলন করতে পারে।
জেমস ওয়েব টেলিস্কোপের উদ্দেশ্য : এই টেলিস্কোপটি উৎক্ষেপণের অন্যতম প্রধান উদ্দেশ্য হল দৃশ্যমান মহাবিশ্বের সবচাইতে দূরতম অংশের আলো পর্যবেক্ষণ করা। গ্রহ গুলো কিভাবে তৈরী হয়েছে তাদের আদিমতম চেহারা জানা। বিজ্ঞানীদের হিসাব মতে পৃথিবী সৃষ্টি হয়েছে সাড়ে চারশ বছর আগে আর বিগ ব্যাং হয়েছে সাড়ে তের হাজার বছর আগে। কিন্তু তারও আজ্ঞে মহাকাশের কী অবস্থা ছিলো তা জানার উদ্দেশে বানানো হয়েছে জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ। এটি ইনফ্রারেড রে বা অবলোহিত বিকিরণ পর্যালোচনা করে ছায়াপথের আগের অবস্থা এবং এখনকার অবস্থার পার্থক্য বুঝাতে সাহায্য করে। পাশাপাশি এই মহাবিশ্ব কীভাবে সৃষ্টি হয়েছে তার সুস্পষ্ট ব্যাখ্যা দেয় জেমস ওয়েব। আমরা খালি চোখে যা দেখতে পাই না তাও এটার মাধ্যমে পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব। এটির মাধ্যমে বিভিন্ন গ্রহের আবহাওয়া সম্পর্কেও জানান সম্ভব। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপটি অন্যান্য গ্রহে প্রাণের সন্ধান করছে। এবার আসি কীভাবে হাজার কোটি বছর আগের মহাকাশের ছবি তুললো জেমস ওয়েব।
মহাবিশ্বের এত আগের ছবি কীভাবে তুললো জেমস ওয়েব? সাধারণত কোনো বস্তুর আলো যখন আমাদের চোখে এসে পড়ে আমরা তখন সেই বস্তুটিকে দেখতে পাই আর সাধারণ বিজ্ঞান। একইসঙ্গে আমরা দূরের বস্তু দেখতে গেলে কিছুটা জটিলতায় পড়তে হয় আমাদের। যেমন পৃথিবী থেকে চাঁদের দূরত্ব তিন লাখ ৮৪ হাজার কিলোমিটার। অন্যদিকে, আলোর গতি সেকেন্ডে প্রায় তিন লাখ কিলোমিটার। সুতরাং আমরা খালি চোখে যে চাঁদটি দেখি সেটি কিন্তু তখনকার নয়। আমরা যে চাঁদ দেখি তা আসলে এক সেকেন্ডের সামান্য কিছু আগের চাঁদ। একই রকম ভাবে সূর্য থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় আট মিনিট ১৯ সেকেন্ড। অর্থাৎ সূর্যাস্তের সময় আমরা যে সূর্য দেখি তা আসলে আট মিনিট ১৯ সেকেন্ড আগের। একইভাবে যতো দূরের বস্তু আমরা দেখি, সেগুলির আসলে তত আগের চেহারা আমরা দেখতে পাই। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ মহাকাশের যে অংশের ছবি পাঠিয়েছে সে অংশ থেকে পৃথিবীতে আলো আসতে সময় লাগে প্রায় চারশ ৬০ কোটি বছর। ফলে, টেলিস্কোপের ছবিটি আসলে চারশ ৬০ কোটি বছর আগের চেহারা দেখাচ্ছে। একই নিয়মে এখনকার অংশের চেহারা জানা যাবে চারশ ৬০ কোটি বছর পর। জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বানানোর ইতিহাস ১৯৯৬ সালে প্রথম জেমস ওয়েব টেলিস্কোপ বানানোর পরিকল্পনা করা হয়।১৭ টি দেশ মিলে এই পরিকল্পনা নেয়া হয়। যার নেতৃত্বে রয়েছে মার্কিন মহাকাশ গবেষণা প্রতিষ্ঠান নাসা। পাশাপাশি ইউরোপীয় স্পেস এজেন্সি এবং কানাডিয়ান স্পেস এজেন্সিরও এই প্রকল্পে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রয়েছে। যন্ত্রটির নামকরণ করা হয়েছে জেমস ই. ওয়েবের নামানুসারে। তিনি ছিলেন নাসার দ্বিতীয় প্রশাসক এবং অ্যাপোলো অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছেন তিনি। মহাকাশ গবেষণায় এক নতুন যুগের সূচনা ঘটিয়ে গেল বছরের ডিসেম্বরে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাশালী দূরবীক্ষণ যন্ত্র জেমস ওয়েব উৎক্ষেপণ করে নাসা।
আরও পড়ুন
উড়োজাহাজ বিধ্বস্তে ৩৮ জনের মৃত্যু, আজারবাইজানে রাষ্ট্রীয় শোক পালন
মানুষের মস্তিষ্ক কতটা দ্রুত কাজ করে
বিশ্বে ক্ষুধার্ত মানুষ বাড়ছে, কমছে ধনী দেশের সাহায্য