December 29, 2024

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, December 28th, 2024, 4:58 pm

টেস্ট ক্রিকেট: মরণদশা থেকে বাঁচানোর উপায় কী

আগামীর দুনিয়ায় টেস্ট ক্রিকেট বাঁচিয়ে রাখার উপায় আছে কি?

নিজস্ব প্রতিবেদক:

‘আউট অব নাথিং’ নামে একটি প্রোডাকশন স্টুডিও আছে ইংল্যান্ডে। বৈশ্বিকভাবে ক্রিয়েটিভ ব্র্যান্ডগুলো নিয়েও কাজ করে। পেশাজীবীদের প্ল্যাটফর্ম লিংকডইন বলছে, হ্যাম্পশায়ারভিত্তিক প্রতিষ্ঠানটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক স্টুয়াট রবার্টসন।

ক্রিকেট থেকে অনেকটা দূরে থাকা বয়স ৫০ পেরোনো এই মানুষই গত দুই যুগের ক্রিকেট–দুনিয়ায় সবচেয়ে বড় পরিবর্তনের আসল ‘মাস্টারমাইন্ড’। ২০০১ সালে রবার্টসন ছিলেন ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ডের (ইসিবি) মার্কেটিং ম্যানেজার।

ইসিবির প্রথম শ্রেণীর ঘরোয়া প্রতিযোগিতা কাউন্টিতে দর্শক ক্রমাগত কমে যাওয়ায় সমাধান খুঁজতে খুঁজতে একটা পর্যায়ে টি-টুয়েন্টি আবিষ্কার করে বসেন তিনি। ঠিক আবিষ্কার নয়, অপেশাদারদের মধ্যে এমন ছোট দৈর্ঘ্যের খেলার প্রচলন আগে থেকেই ছিল। রবার্টসন যেটি করেছেন, সেটি হচ্ছে সংক্ষিপ্ত ধারার ক্রিকেটকে পেশাদার ও বাণিজ্যিক রূপ দেওয়া।

২০০৮ সালে মেইল স্পোর্টসকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে রবার্টসন জানিয়েছিলেন, ঠিক কী করতে গিয়ে তিনি ও তাঁর দল টি-টুয়েন্টিকে বাজারজাত করার সিদ্ধান্তে আসতে পেরেছিলেন। অনেক কথার ভিড়ে একটা কথা ছিল এ রকম, ‘আমরা শুধু কারা কাউন্টি দেখতে আসে, সেটিই দেখিনি, বুঝতে চেয়েছি কারা আসে না, কেন আসে না।’

এখনকার সময়ে টেস্ট নিয়েও হয়তো সবচেয়ে বেশি দরকার এই প্রশ্ন দুটির উত্তর অনুসন্ধান। টেস্ট কারা দেখেন না, কেন দেখেন না। টম মুডির মতে, মানুষের সময় নেই।

অস্ট্রেলিয়ার এই সাবেক ক্রিকেটার ও বর্তমানে কোচ চলতি বছরের শুরুর দিকে এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন, ‘দর্শক ও খেলোয়াড়েরা এখন ক্রিকেটের ছোট সংস্করণের প্রতি বেশি আকর্ষণ বোধ করে। আমার মতে, এটা সমাজেরই প্রতিফলন। অনেক বছর আগে মানুষের হাতে যেমন প্রচুর সময় ছিল, এখন সেটা নেই।’

৪০ ওভারের টি–টোয়েন্টি ম্যাচে গ্ল্যামার আছে, দর্শক আগ্রহও বিপুল৪০ ওভারের টি–টুয়েন্টি ম্যাচে গ্ল্যামার আছে, দর্শক আগ্রহও বিপুল বিসিসিআই

মুডি যখন কথাগুলো বলছিলেন, তখন সংযুক্ত আরব আমিরাতে আইএলটি-টুয়েন্টির একটি দলকে কোচিং করাচ্ছেন। বিশ্বজুড়ে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে কোচিং করিয়ে বেড়ানো মুডি অবশ্য এখনো টেস্টের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ দেখেন, ‘আমার মতে, টেস্টের জায়গা এখনো আছে। গত কিছুদিনেই তো আমরা দুর্দান্ত কিছু টেস্ট দেখলাম। এখন টেস্ট ক্রিকেট টিকে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা থাকলেও কিছু দেশের জন্য এটা কঠিন। কারণ, চারপাশেই এখন ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেট হচ্ছে। খেলোয়াড়েরাও সেদিকেই বেশি মনোযোগ দিচ্ছে।’

মুডির কথায় মোটামুটি পরিষ্কার, টেস্ট ক্রিকেটের আসল চ্যালেঞ্জটা কোন জায়গায়। মনোযোগ সরে যাচ্ছে ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে। টি-টুয়েন্টিতে, টি-টেনে। সমস্যা চিহ্নিত, কিন্তু সমাধান কোথায়?

এ বছরের শুরুর দিকে বিপিএল খেলতে বাংলাদেশে এসেছিলেন ওয়েস্ট ইন্ডিজের জেসন হোল্ডার। মাত্র ২৩ বছর বয়সে অধিনায়কত্ব পাওয়া এই অলরাউন্ডারকে আধুনিক ক্রিকেটের অন্যতম ক্ষুরধার মস্তিষ্কের খেলোয়াড় বলে বিবেচনা করা হয়। কেন করা হয়, তার একটি উদাহরণ আছে ঢাকায় বসে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে। তাঁর পর্যবেক্ষণে ‘টেস্ট এখন যে কাঠমোয় চলছে, তা টিকবে না’।

এ জন্য সমাধান হিসেবে কয়েকটি উপায়ের কথা বলেছেন তিনি। একটি হচ্ছে ‘ইন্টারন্যাশনাল উইন্ডো’। এই শব্দ দুটি সবচেয়ে বেশি ব্যবহৃত হয় ফুটবলে। সারা বছর খেলা চলে লিগ পর্যায়ে, ক্লাবে। বছরে চার-পাঁচ দফায় ১০-১২ দিনের জন্য খেলা বন্ধ থাকে। এ সময়ের মধ্যে হয় জাতীয় দলগুলোর আন্তর্জাতিক ফুটবল। আর দুটি মৌসুমের মাঝের দুই মাসে (জুন-জুলাইয়ের) হয়ে থাকে ফিফা ‍টুর্নামেন্ট। ফুটবলে এটিকে ‘ফিফা উইন্ডো’ বলে।

টেস্টপ্রেমী জেসন হোল্ডারও বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলে বেড়ান। ছবিটি দশম বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের হয়ে খেলার সময়ের।টেস্টপ্রেমী জেসন হোল্ডারও বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি টুর্নামেন্ট খেলে বেড়ান। ছবিটি দশম বিপিএলে খুলনা টাইগার্সের হয়ে খেলার সময়ের।

হোল্ডারের মতে, বিশ্বজুড়ে ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগ জনপ্রিয়তার হাত ধরে যেভাবে বিস্তৃত হয়ে চলেছে, তাতে ক্রিকেটের জন্য এমন একটা উইন্ডো করা যেতে পারে, ‘আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের জন্য আলাদা সময় বের করতে হবে। ধরুন, জানুয়ারি থেকে মে, পুরোটা আন্তর্জাতিক ক্রিকেট। বছরের বাকি সময় ঘরোয়া ক্রিকেট। তাহলে খেলোয়াড়েরা নিজেদের সেভাবে প্রস্তুত করবে। চিন্তা করবে, আমি বছরের প্রথম চার-পাঁচ মাস আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলব। বাকিটা ঘরোয়া।’

হোল্ডার অবশ্য উইন্ডো পদ্ধতিতে যাওয়ার আগে আরেকটা সমাধানও দেখছেন। তাঁর মতে, রাজস্ব ভাগাভাগির বর্তমান পদ্ধতি বদলাতে হবে। এখন কোনো দ্বিপক্ষীয় সিরিজে আয় করে শুধু স্বাগতিক বোর্ড, অন্য দল নিজের খরচে বিমানভাড়া দিয়ে সেখানে খেলে আসে। এর পরিবর্তন ঘটিয়ে সফরকারী দলকেও লাভের একটা অংশ দিলে বোর্ড ও ক্রিকেটার—উভয় পক্ষ লাভবান হবে। দিন শেষে যা টেস্ট ক্রিকেটের জন্যই দরকারি।

হোল্ডারের মতোই অল্প বয়সে দক্ষিণ আফ্রিকার অধিনায়কত্ব পেয়েছিলেন গ্রায়েম স্মিথ। বর্তমানে প্রোটিয়া ক্রিকেট বোর্ডের চালু করা এসএ টুয়েন্টির প্রধান কমিশনার হিসেবে কাজ করা এই সাবেক ক্রিকেটারও দিয়েছেন একই পরামর্শ, ‘সবাই বলে সূচির কথা। কিন্তু আসল চ্যালেঞ্জ আর্থিক মডেল। একজন খেলোয়াড় যদি দেখে টি-টুয়েন্টি খেললে বেশি টাকা, টেস্টে সে কেন মনোযোগ দেবে?’

তাঁদের কথায় উঠে এসেছে, সমস্যাটা টেস্ট ক্রিকেট বনাম বিপুল অর্থের হাতছানির মধ্যে একটিকে বেছে নেওয়ার। কিন্তু সেটা তো খেলোয়াড়দের দিক থেকে। ধরা যাক, টেস্টে ম্যাচ ফি বাড়িয়ে, সফরকারী দলের জন্য লাভের অংশ চালু করে এ সমস্যার একটি সমাধান করা গেল। তাতে ক্রিকেটারদের মনোযোগ বাড়ল সাদা পোশাক-লাল বলে। প্রতিদ্বন্দ্বিতা ও উত্তেজনার গ্রাফ বেড়ে বাড়ল টেস্ট ক্রিকেটের মানও। কিন্তু যাঁদের জন্য খেলা, সেই দর্শক কি তাতে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বাড়বে?

যাঁরা টেস্ট পছন্দ করেন, তাঁরা খুশি হবেন। কিন্তু কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যুগে দুনিয়ায় আসা নতুন দর্শককে (পড়ুন ভোক্তা) কি আকৃষ্ট করা যাবে?

এখানেই দরকার আরও কিছু উদ্যোগের। টেস্টে রোমাঞ্চ বাড়াতে দরকার আরও কিছু সংযোজন, সেটা মৌলিক দিক ঠিক রেখেই। এর মধ্যে কিছু আবার পরীক্ষা-নিরীক্ষাও হয়েছে গত এক দশকের মধ্যে। যেমন দিনে ৯৮ ওভার করে চার দিনের টেস্ট।

দক্ষিণ আফ্রিকা–ভারত ম্যাচের ছবি। জানুয়ারি, ২০২৪।দক্ষিণ আফ্রিকা–ভারত ম্যাচের ছবি। জানুয়ারি, ২০২৪।এএফপি

আইসিসি এই ঘরানার ম্যাচকে টেস্ট হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার পর ২০১৭ সালে জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে একটি ম্যাচ খেলেছিল দক্ষিণ আফ্রিকা (যদিও তা শেষ হয়েছে দুই দিনে)। আবার ইংল্যান্ড তাদের প্রতিবেশী আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে চার দিনের টেস্ট খেলেছে দুটি। তবে বিচ্ছিন্ন এসব ম্যাচ বাদে চার দিনের ধারাটি খুব একটা জনপ্রিয় হয়নি। কিন্তু সময় কমে আসবে বলে এটি নিয়মিতভাবে চালু করা প্রয়োজন মনে করেন অনেকেই। অস্ট্রেলিয়ার সাবেক ক্রিকেটার মার্ক টেলর এ ধারার সমর্থক।

চার দিনের টেস্টের পক্ষে ব্যাট ধরে সাবেক এই অধিনায়কের প্রস্তাব, বৃহস্পতিবার থেকে রবি বা শুক্রবার থেকে সোমবার ম্যাচ আয়োজনের জন্য দিন নির্দিষ্ট করে দেওয়া যেতে পারে। যাতে দর্শক ছুটির দিনে মাঠে আসতে পারেন।

দর্শকের মাঠে আসার ‍কথা মাথায় রেখে দিবারাত্রির টেস্টও প্রবর্তন করা হয়েছে। দিনের কাজ শেষ করে সন্ধ্যায় কর্মজীবীরা মাঠে আসবেন, এমনটাই ছিল মূল ভাবনা। ২০১৫ সালে অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ডের অ্যাডিলেড দিয়ে এ ধারার শুরু। তবে গত ৯ বছরে ফ্লাডলাইটের আলোয় টেস্ট হয়েছে মাত্র ২৩টি, চলতি বছরে মাত্র ২টি (গ্যাবায় অস্ট্রেলিয়া-নিউজিল্যান্ড ও অস্ট্রেলিয়া-ভারত)।

রবি শাস্ত্রী, এবি ডি ভিলিয়ার্সের মতো কেউ কেউ অবশ্য টেস্ট জমিয়ে তুলতে তিন টেস্টের সিরিজকে গুরুত্বপূর্ণ অনুষঙ্গ মনে করছেন। দুই ম্যাচের সিরিজের বদলে তিন টেস্ট হলে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে বলে মত তাঁদের। শাস্ত্রী তো দুই টেস্টের সিরিজকে সময়ের অপচয় বলেই মনে করেন।

শাস্ত্রী অবশ্য আরও একটা প্রস্তাব দিয়েছেন—প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়ানোর জন্য টেস্ট ক্রিকেটে স্তরবিন্যাস। শক্তির বিচারে দুটি স্তর হবে। ছয় দল নিয়ে প্রথম স্তর, পরের ছয় দল নিয়ে দ্বিতীয় স্তর। প্রতিবছর বা চক্র শেষে একটি বা দুটি দল উঠবে বা নামবে। এতে দলগুলোর মধ্যে অবস্থান টিকিয়ে রাখা এবং পরের ধাপে যাওয়ার জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়বে। প্রতিটি টেস্টই হয়ে ‍উঠবে প্রাসঙ্গিক, বিচ্ছিন্ন নয়। এর অংশ হিসেবে বর্তমানে চালু টেস্ট চ্যাম্পিয়নশিপেই দলসংখ্যা বাড়িয়ে দুই স্তর চালু করে দেওয়া যেতে পারে।

তবে দুই স্তর হোক বা দিন কমানো, তিন টেস্ট, দিবারাত্রির ক্রিকেট বা অন্য কিছু—যত কিছুই আনা হোক না কেন, সবকিছুর চূড়ান্ত লক্ষ্য ওই দুটিই। খেলোয়াড়দের মধ্যে টেস্টকেই মূল ক্রিকেট হিসেবে গ্রহণ আর দর্শকের সমাগম বাড়ানো।

কিন্তু সে পথে কি এগোচ্ছে টেস্ট ক্রিকেট? দিন শেষে কাজটা ক্রিকেটের নিয়ন্ত্রক সংস্থা হিসেবে আইসিসিরই।