- নুরুল আমিন
ভারত সরকার যখন বাংলাদেশের রপ্তানি কার্গো তৃতীয় দেশে পাঠাতে ভারতের বিমানবন্দর ব্যবহারের ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা বাতিল করে, তখন দেশের বিভিন্ন মহল থেকে নানা মতামত ও প্রতিক্রিয়া দেখা যায়। তবে, অনেকেই এর গভীর মূল কারণটি তুলে ধরতে ব্যর্থ হয়েছেন বলে মনে করি ।
কেন আমাদের ক্রেতা ও ফ্রেইট ফরোয়ার্ডাররা এই পথটি বেছে নিয়েছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের কেবল দৃশ্যমান কারণ নয়, বরং গভীরতর অর্থনৈতিক ও লজিস্টিক বাস্তবতাকে বিবেচনায় নিতে হবে। প্রকৃতপক্ষে, ভারতের এই ট্রান্সশিপমেন্ট সুবিধা গ্রহণ ছিল কোনো পছন্দ নয়, বরং একটি অর্থনৈতিক প্রয়োজনীয়তা।
ভারতের এই সুবিধা দেওয়ার পেছনে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য থাকতে পারে, কিন্তু এটি আমাদের নিজেদের এয়ার কার্গো ব্যবস্থার দুর্বলতাও স্পষ্ট করে দিয়েছে। ঢাকা বিমানবন্দরে যেহেতু রপ্তানি কার্গো পরিচালনার বেশ কিছু সীমাবদ্ধতা ছিল, সেহেতু ভারত হয়ে পণ্য পাঠানো ছিল অনেকটাই বাধ্যতামূলক।
ঢাকা বিমানবন্দরের গত বছর প্রায় ২৮৮,০০০ টন হ্যান্ডলিং সক্ষমতার মধ্যে ব্যবহৃত হয়েছিল মাত্র ১৯৮,০০০ টন। অথচ প্রতিদিন প্রায় ৮০০ টন পণ্য পরিবহনের সক্ষমতা থাকা সত্ত্বেও, বছরে ১৫,০০০ টনের মতো রপ্তানি পণ্য ভারত হয়ে যেত। কেন? কারণ ফরওয়ার্ডার ও আমাদের পণ্য ক্রেতাদের এতে প্রতি কেজিতে $০.৮০ থেকে $১.০০ ডলার পর্যন্ত সাশ্রয় হতো, যা সড়ক পরিবহন ও সীমান্তে শুল্ক খরচ বহন করার পরও লাভজনক ছিল।
ঢাকা থেকে রপ্তানির খরচ বেশি হওয়ার প্রধান কারণগুলো হলো:
১. একক হ্যান্ডলিং এজেন্ট বিমানের চার্জ: বিমান প্রতিকেজিতে হ্যান্ডলিং বাবদ একটি ঊচ্চ চার্জ করে।
২. দ্বৈত হ্যান্ডলিং ব্যয়: এই চার্জ দেওয়ার পরও কাঙ্খিত সার্ভিস না পাওয়ার কারণে এয়ারলাইন্সগুলোকে তাদের বড় সংখ্যক স্টাফ রাখতে হয়, যার ফলে খরচ বেড়ে যায়।
৩. সরঞ্জামের অভাব: ট্রলি, ডলি বা লোডিং যন্ত্রপাতির স্বল্পতার কারণে কার্গো থাকলেও অনেক সময় ফ্লাইট খালি চলে যায়।
৪. স্ক্যানিংয়ের সমস্যা: স্ক্যানিং মেশিনের ঘাটতি বা নষ্ট হয়ে যাওয়ায় সময়মত হস্তান্তর করতে না পারার কারণে প্রায়ই বুকিং মিস হয়।
৬. অঘোষিত ব্যয়: স্ক্যানিং করাতে হয়রানিমূলক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক খরচ গুনতে হয়।
৭. জ্বালানির উচ্চ মূল্য: ঢাকা বিমানবন্দরে ফুয়েলের দাম আশপাশের দেশের তুলনায় বেশি।
৮. অত্যধিক ফ্লাইট অপারেশন চার্জ: আমাদের সিভিল এভিয়েশনের চার্জ বিশ্বে অন্যতম উচ্চ ।
৯. ডলার সংকট: এয়ারলাইন্সগুলো তাদের আয় দেশে নিয়ে যেতে পারছিল না, ফলে ফ্লাইট কমিয়ে দেওয়া বা অতিরিক্ত পরিচালনায় অনীহা।
১০. কার্গো ভিলেজে পণ্য চুরি: কার্গো ভিলেজে চুরি ও পণ্য খোয়া যাওয়ার ঘটনা নিয়মিত ঘটে।
সম্ভাব্য সমাধান ও করণীয়:
১. কার্গো হ্যান্ডলিংয়ে প্রতিযোগিতা আনা: বিমানের একচেটিয়া হ্যান্ডলিং ব্যবস্থার পরিবর্তে বেসরকারি অপারেটর অন্তর্ভুক্ত করা।
২. ইকুইপমেন্ট ও স্ক্যানিং অবকাঠামো উন্নয়ন: জরুরি ভিত্তিতে আধুনিকায়ন ও রক্ষণাবেক্ষণ।
৩. অপারেশনাল চার্জ পুনঃমূল্যায়ন: ফুয়েল ও ফ্লাইট চার্জ প্রতিবেশী দেশগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা।
৪. ডলার রেপাট্রিয়েশন সহজীকরণ: এয়ারলাইন্সগুলোর আস্থা পুনঃস্থাপন।
৫. নিরাপত্তা জোরদার: কার্গো ভিলেজে ২৪/৭ নজরদারি ও নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়ন।
৬. এক্সপ্রেস ফ্যাসিলিটেশন সেল: রপ্তানি প্রক্রিয়া দ্রুত করতে ওয়ান স্টপ সেবা চালু।
এই সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন হলে প্রতি কেজি পণ্যের রপ্তানির খরচ কমে ভারতীয় বিমানবন্দরের সঙ্গে প্রতিযোগিতামূলক হবে। তখন প্রয়োজন হলে এয়ারলাইন্স নিজেরাই তাদের সক্ষমতা বাড়াবে । আমাদের ভারত বা অন্য কোন দেশের বন্দর ব্যবহার করে রপ্তানি করতে হবে না।
আমাদের নীতিনির্ধারকদের উচিত প্রতিক্রিয়াশীল চিন্তা বাদ দিয়ে মূল সমস্যাগুলো চিহ্নিত করা। আমরা যদি অবকাঠামোগত ও প্রশাসনিক বাধাগুলো দূর করতে পারি, তবে বিদেশি ট্রান্সশিপমেন্টের ওপর নির্ভরতা ছাড়াই রপ্তানি সক্ষমতা নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। এতে শুধু ব্যয় হ্রাসই নয়, আমাদের রপ্তানি খাতও দীর্ঘমেয়াদে আরও প্রতিযোগিতামূলক হয়ে উঠবে।
লেখকঃ ব্যবস্থাপনা পরিচালক, টাওয়ার ফ্রেইট লজিস্টিকস লিমিটেড ও ভাইস – প্রেসিডেন্ট বাংলাদেশ ফ্রেইট ফরওয়ার্ডারস এসোসিয়েসন (বাফা)
আরও পড়ুন
সয়াবিন তেলের দাম ১৪ টাকা বাড়ানোর সিদ্ধান্ত মেনে নিলো সরকার
ভ্যাট অব্যাহতি, বিনিয়োগ বান্ধব করনীতি চায় বিজিএমইএ-বিকেএমইএ
পাকিস্তানের ১৪০ কোটি ডলারের রপ্তানি ঝুঁকিতে, সুযোগ বাংলাদেশের