গাজী আজম হোসেন, বেরোবি প্রতিনিধি
শর্ত অনুযায়ী চাকরিতে আবেদন করার যোগ্যতা না থাকলেও রংপুরের বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে (বেরোবি) ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মো. ইউসুফ দাপিয়ে বেড়াচ্ছে। এক সময়ের আওয়ামী পন্থী শিক্ষকদের সংগঠন নীল দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করা এ শিক্ষক এখন বোলপাল্টে বিএনপি পন্থী শিক্ষকদের সাথে সখ্যতা বাড়াচ্ছেন। চাকুরি বাচাতে ছাত্রদলের একাংশকে বিভিন্ন আর্থিক সুবিধা দিয়ে হাতে রেখেছেন। অভিযোগ রয়েছে বিএনপি পন্থী শিক্ষক ও ছাত্রদলের সাথে সখ্যতা বাড়িয়ে নিজের তদন্ত আটকিয়ে রেখেছেন।
তার বিরুদ্ধে নিয়োগ জালিয়াতি অভিযোগে গঠিত তদন্ত কমিটি ১০ মাসেও প্রতিবেদন জমা দেয়নি। এ শিক্ষকের সার্টিফিকেট থেকে জানা যায়, তিনি এসএসসি পরীক্ষায় জিপিএ-৩.৫০ ও এইচএসসিতে পেয়েছেন ৩.০১ পেয়েছেন। তবে তার এইচএসসির রোল এবং রেজিষ্ট্রেশন দিয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে অনুসন্ধান করলে দেখা যায় তিনি ২.৯০ পেয়েছেন। ইংরেজিতে তার গ্রেড ‘ডি’। এছাড়াও এসএসসিতে গণিতে পেয়েছেন ‘সি’। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন জায়গায় ও বিশ্ববিদ্যালয়ের বাহিরেও ছাত্রদল নেতা তুহিন রানা এবং রিফাত রাফির সাথেও দেখা যায় এই শিক্ষককে ।
এ বিষয়ে তুহিন রানার কাছে জানতে চাইলে তিনি জানান, ইউসুফ স্যার ছাত্র জীবনে ছাত্রদল করতেন৷ উনি জাতীয়তাবাদী আদর্শ লালন করেন। সৈয়দপুরে ওনার একটা পদও ছিল। আর উনি আওয়ামী লীগ আমলে নিয়োগ পাওয়া ওই সময় সবাইকে কমবেশি এসব সংগঠন করতে হয়। কিন্তু উনি তো এসব প্রোগ্রামে যেতেন না। ওনার ছবি নাই। সেজন্য ওনার সাথে আমাদের ছাত্রদলের ভালো যোগাযোগ। তদন্ত কমিটির ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় রেজিস্ট্রার বলেন, প্রতিবেদন প্রায় রেডি টেকনিক্যাল কারণে প্রকাশ করতে পারছি না৷
বি এন পি পন্থী শিক্ষকদের ছত্রছায়ার ব্যাপারে জানতে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিএন পি পন্থী শিক্ষক মজনু বলেন, এ বিষয়ে আমি আর কি বলব। তোমরা তো সব দেখতে পারতেছো। আর ইউসুফ আবার আমার সহকর্মী। এখনে কি আর বলার আছে। আরেক বিএনপি পন্থী শিক্ষক ড. ফেরদৌস রহমান বলেন, ক্যাম্পাসে সকল ধরনের রাজনীতি নিষিদ্ধ। তাই এখন কারো রাজনীতি করার সুযোগ নেই।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ১৫ ফেব্রুরারি বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয় একটি শিক্ষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করা হয় (স্মারক নং- বেরোবি/রেজিঃ/শিঃনিয়োগ/২০১১/৭৭৪।) ওই বিজ্ঞপ্তির পদের বিবরণীর ‘খ’ তে ইতিহাস বিভাগে (বর্তমানে ইতিহাস ও প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ) প্রভাষক/সহকারী অধ্যাপক (স্থায়ী) একটি পদে নিয়োগের কথা বলা হয়। বিজ্ঞপ্তির শর্তাবলীর (গ) নং শর্তে উল্লেখ করা হয়, ‘এস.এস.সি ও এইচ.এস.সি পরীক্ষার যেকোনো একটিতে ন্যূনতম ‘A’ (৫.০০ পয়েন্ট ভিত্তিক গ্রেড সিস্টেমে সিজিপিএ/জিপিএ ন্যূনতম ৪.০ থাকতে হবে।’ কিন্তু ওই পদে নিয়োগ দেওয়া হয় মো. ইউসুফে নামের একজনকে। যার এস.এস.সি (২০০১) এবং এইচ.এস.সি (২০০৩) পরীক্ষায় দু’টির একটিতেও সিজিপিএ/জিপিএ ৪.০০ ছিল না। নিয়োগ পাওয়া এই শিক্ষক এস.এস.সিতে জিপিএ ৩.৫০ এবং অংকে সি গ্রেড ও এইচএসসিতে ৩.০১ এবং ইংরেজিতে ডি গ্রেড পেয়েছেন।
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তির পদের বিবরণের ১ (খ) তে ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক নিয়োগের যে বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়েছে তাতে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়, রংপুর এর ২০০৯ সালের ২৯ নং আইনের প্রথম সংবিধির ১১(৮) ও (৯) লংঘিত হয়েছে। এই আইনের ৩৯ এর (২) নং ধারায় বলা আছে ‘তফসিলে বর্ণিত সংবিধি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সংবিধি হবে’। উক্ত সংবিধির [ধারা ৩৯(২) দ্রষ্টব্য] ১১ (৮) এ উল্লেখ আছে বিভাগের মোট শিক্ষক সংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ শিক্ষক সমন্বয়ে জ্যেষ্ঠতার ভিত্তিতে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি গঠিত হবে তবে শর্ত থাকে যে, উক্ত কমিটির সদস্য সংখ্যা অন্যূন তিনজন হতে হবে।
কিন্তু অনুসন্ধানে দেখা যায়, ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের সময়কালে বিভাগে তিনজন শিক্ষক কর্মরত ছিলেন। তারা হলেন- ড. আবু মো. ইকবাল রুমী শাহ, মো. গোলাম রব্বানী ও আরা তানজিয়া। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আইনের ব্যত্যয় ঘটিয়ে প্ল্যানিং কমিটি গঠন না করেই এই বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনের সংবিধির ধারা ১১(৯) এ উল্লেখ আছে ‘প্ল্যানিং কমিটি নিম্নবর্ণিত কার্যাবলী সম্পাদন করবে, যথা- (ক) বিভাগের সম্প্রসারণ, (খ) শিক্ষক, অন্যান্য কর্মকর্তা ও কর্মচারী নিয়োগ।” কিন্তু এই আইন অমান্য করে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি গঠন ব্যতিরেকেই ইতিহাস বিভাগ শিক্ষক নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করেছিল।
অনুসন্ধানে আরও উঠে আসে, ওই নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখিত একটি স্থায়ী পদের বিপরীতেই ২০১২ সালের ২৮ জুন আবেদনপত্র যাছাই-বাছাই ছাড়াই নিয়োগ বাছাই বোর্ডে তিনজন প্রার্থীকে স্থায়ীভাবে নিয়োগের সুপারিশ করা হয়। তারা হলেন- মো. ইউসুফ, মো. মনিরুজ্জামান ও মো. আকতারুল ইসলাম। এখানেও সংবিধির ধারা ১১(৯) লঙ্ঘন করা হয়। অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মো. ইউসুফের আবেদনের যোগ্যতা না থাকলেও ইতিহাস বিভাগের প্রভাষক পদে নিয়োগ বাছাই বোর্ড তাদের সুপারিশের কারণ হিসেবে বলেন ‘ আবেদনকারীদের শিক্ষাগত যোগ্যতা, অভিজ্ঞতা, প্রকাশনা এবং সাক্ষাৎকারের দক্ষতার ভিত্তিতে সর্বসম্মতিক্রমে তাদেরকে প্রভাষক পদে জাতীয় বেতন স্কেলে ২০০৯ অনুসরণে স্থায়ী একটি প্রভাষক পদের নিয়োগ করার সুপারিশ করা হয়।’ বিজ্ঞপ্তির শর্তানুযায়ী মো. ইউসুফের ওই পদে আবেদনের যোগ্যতাই ছিল না। কিন্তু তাকে ভাইভা কার্ড ইস্যু করা হয়। নিয়োগ বাছাই বোর্ডে ছিলেন তৎকালীন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. মাহবুবর রহমান, বাংলাদেশ বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের সদস্য ড. আতফুল হাই শিবলী, রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান ও কলা অনুষদের ডিন হিসেবে ড. আবু মো. ইকবাল রুমি শাহ এবং ভিসি প্রফেসর ড. আব্দুল জলিল মিয়া।
নজীরবিহীন এই নিয়োগ জালিয়াতির বিষয়টি স্পষ্ট হয় বিশ্ববিদ্যালয়টির ২০১৩ সালের ৪ অক্টোবর অনুষ্ঠিত ৩৬তম সিন্ডিকেট সভায়। সিন্ডিকেট সভার আলোচ্যসূচি ৮ এ ইতিহাস বিভাগের শিক্ষক নিয়োগে যাছাই বাছাই বোর্ডের সুপারিশ এবং পর্যালোচনা ও নিয়োগের অনুমোদন এজেন্ডা আলোচনার সময় স্পষ্ট হয় শুভংকরের ফাঁকি। সিন্ডিকেট সদস্যরা এ বিষয়ে তাদের লিখিত সিদ্ধান্তে বলেন, ‘ইতিহাস ও প্রত্নতত্ব বিভাগের বাছাই বোর্ডের সুপারিশ অনুযায়ী যে তিনজন প্রার্থীকে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়েছে তাদের মধ্য দ্বিতীয় প্রার্থী মো. ইউসুফের এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষায় বি-গ্রেড ও স্নাতক (সম্মান) পরীক্ষায় দ্বিতীয় শ্রেণি থাকায় নিয়োগের জন্য উপযুক্ত বিবেচিত হতে পারে না। অতএব সিন্ডিকেট সভায় উপস্থিত সব সদস্যের সর্ব সম্মতিক্রমে পদ পুনঃবিন্যাসের মাধ্যমে সৃষ্ট দুটি প্রভাষকের স্থায়ী পদে বাছাই বোর্ডের সুপারিশকৃত প্রথম ও তৃতীয় প্রার্থী মনিরুজ্জামান ও মো. আকতারুল ইসলামকে নিয়োগ প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়।’
অসুন্ধানে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনলঙ্ঘন করে একটি প্রভাষকের পদ বিজ্ঞাপিত করলেও দুইজন প্রার্থীকে এবং অধ্যাপক পদের বিপরীতে একজনসহ মোট তিনজনকে নিয়োগ প্রদানের সুপারিশ করা হয়েছে। যদিও অনুমোদিত ( স্থায়ী) পদ ছিল কেবল ১ টি। তবুও তিন জনকেই স্থায়ী পদে নিয়োগের জন্য সুপারিশ করা হয়। যা আইনের স্পষ্ট লঙ্ঘন।
অনুসন্ধানে বলছে, নিয়োগের পুরো লেখাটি টাইপ করা থাকলেও ‘স্থায়ী একটি প্রভাষক পদ’ এর জায়গায় ‘এক’ শব্দটি কলম দিয়ে কেটে ‘০৩ (তিন)’ হাতে লিখে দেওয়া হয়। আবেদনের যোগ্যতা না থাকা মো. ইউসুফকে বাছাই বোর্ড নিয়োগের সুপারিশকৃত তিনজনের মধ্যে প্রথম হিসেবে উল্লেখ করেন। কিন্তু তার নামের আাগে ক্রমিক নং ২ লেখা হয়। অনুসন্ধানে আরও জানা যায়, উদ্দেশ্য প্রণোদিতভাবে এটা লিখে তাকে আইনগত সুবিধা নেওয়ার পথ তৈরি করেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়টির আইনের ৩৪ (৩) এ বলা হয়েছে, বাছাই বোর্ডের সুপারিশের সহিত সিন্ডিকেট একমত না হইলে বিষয়টি চ্যান্সেলরের নিকট প্রেরণ করিতে হইবে এবং এই ব্যাপারে তাহার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত হইবে। কিন্তু তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. একেএম নুর উন নবী মো. ইউসুফের নিয়োগের সুপারিশ সিন্ডিকেট বাতিল করার পর চূড়ান্ত সিদ্ধান্তটি আনুষ্ঠানিকভাবে চ্যান্সেলরকে জানানোর নিয়ম থাকলেও তিনি তা কৌশলে জানাননি।
অনুসন্ধানে দেখা গেছে, মো. ইউসুফ তার নিয়োগ সিন্ডিকেট সর্বসম্মতভাবে বাতিল করার পর আইনী কৌশল খুঁজতে থাকেন। সহযোগিতা নেন তৎকালীন বিভাগীয় প্রধান ইকবাল শাহ রুমি ও তৎকালীন ভিসি প্রফেসর একেএম নুর উন নবীর। তাদের সহযোগিতায় এসময় অবৈধ পন্থায় মো. ইউসুফ নিয়োগ বাছাই বোর্ডের সুপারিশসহ তার নিয়োগ সংক্রান্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের সিদ্ধান্তের গোপন সব নথি কালেক্ট করেন এবং ২০১৪ সালে হাইকোর্টে রিট পিটিশন (নং ৩৫৭২) দায়ের করেন। রিট পিটিশনে মো. ইউসুফ তার নিয়োগ সিন্ডিকেট কেন বাতিল করলো সেটি উল্লেখ করেননি। গত ২০১৯ সালের ৯ জুলাই হাইকোর্ট মো. ইউসুফের পক্ষে রায় দেন। কিন্তু তৎকালীন ভিসি ড. নাজমুল আহসান কলিম উল্লাহ ওই রায়ের বিপক্ষে আপিল না করায় মো. ইউসুফ ওই বিভাগে ১৪ জুলাই ২০১৯ তারিখে প্রভাষক শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। এরপর বাগিয়ে নিয়েছেন প্রমোশন, হয়েছেন সহকারী অধ্যাপক। হাইকোর্টে এই মামলার বিষয়ে অজ্ঞাত কারণে তৎকালীন ভিসি প্রফেসর ড. একেএম নুর উন নবী এবং প্রফেসর ড. নাজমুল আহসান কলিমউল্লাহ’র প্রশাসন সেরকমভাবে লড়াই করেনি
গাজী আজম হোসেন
আরও পড়ুন
বেরোবি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রফেসর ড. মোঃ রশীদুল ইসলাম সাময়িক বরখাস্ত
শিশুদের প্রিয়‘ইনটেলিজেন্স বই’ এক নতুন সম্ভাবনার দ্বারপ্রান্তে
বেরোবিতে দেয়ালে ‘জয় বাংলা লেখা’, অর্ধ মাসেও প্রতিবেদন জমা পড়েনি,শিক্ষার্থীদের ক্ষোভ