বাংলাদেশের সামরিক ক্রয় প্রক্রিয়ায় দীর্ঘদিনের দুর্নীতির কাহিনি প্রকাশ্যে আসতেই সামনে এসেছে এক ছায়ানায়কের নাম — তারিক আহমেদ সিদ্দিকী। সেনাবাহিনীর পোশাকধারী এই প্রভাবশালী ব্যক্তি গোপনে গড়ে তুলেছিলেন রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির এক বিশাল নেটওয়ার্ক, যার নিয়ন্ত্রণে ছিল হাজার হাজার কোটি টাকা এবং একচ্ছত্র ক্ষমতা।
১৫ বছরেরও বেশি সময় ধরে ভোটবিহীন নির্বাচনের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত আওয়ামী লীগের অবৈধ শাসন বাংলাদেশে তৈরি করেছিল একটি পূর্ণাঙ্গ মাফিয়া শাসনব্যবস্থা। শেখ হাসিনা সরকারের আনুষ্ঠানিক প্রধান হলেও, আসল ক্ষমতা ছিল দুর্নীতি, গুম, বিচারবহির্ভূত হত্যা, মতপ্রকাশ দমন ও অর্থ পাচারনির্ভর একটি অপরাধী নেটওয়ার্কের হাতে।
এই ছায়া সরকারের অদৃশ্য পরিচালনাকারী ছিলেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকী — শেখ হাসিনার সামরিক উপদেষ্টা এবং শেখ রেহানার স্বামীর ভাই। নামেমাত্র উপদেষ্টা হলেও, বাস্তবে তিনি ছিলেন সরকারের ছায়া-প্রধান।
সামরিক ক্রয়ে দুর্নীতির বিস্তার
তারিক সিদ্দিকীর সবচেয়ে কুখ্যাত অধ্যায় ছিল সেনাবাহিনীর অস্ত্র ও সরঞ্জাম কেনাকাটায় দুর্নীতি। গত ১৫ বছরে তিনি প্রায় ৬০,০০০ কোটি টাকা আত্মসাৎ করেছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। কোনো সামরিক চুক্তি তার অনুমতি ছাড়া হতো না। সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও জানতো, কোনো কাজ পাওয়ার প্রথম ধাপ ছিল তারিক সিদ্দিকীকে ১৫–২০% কমিশন প্রদান।
এই দুর্নীতি জাতীয়ভাবে আলোচনায় আসে উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলে বাংলাদেশ বিমানবাহিনীর একটি প্রশিক্ষণ বিমান বিধ্বস্ত হয়ে একাধিক শিশুর মৃত্যুতে। তদন্তে প্রকাশ পায়, বিমানটি ছিল পুরোনো ও অনিরাপদ, যা তারিক সিদ্দিকীর নির্দেশে চীনের কাছ থেকে বাজারদরের প্রায় তিনগুণ মূল্যে কেনা হয়েছিল। এ চুক্তি থেকেই তিনি একাই প্রায় ১,০০০ কোটি টাকা কমিশন নেন। আগে এমন বিমানের দুর্ঘটনায় বেশ কয়েকজন পাইলটের মৃত্যু হলেও, এবার সাধারণ নাগরিকের মৃত্যু জাতিকে নাড়িয়ে দেয়।
পুরনো অভিযোগ, নতুন প্রমাণ
তারিক সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ নতুন নয়। ১৯৯৬ সালেই তিনি জড়িত ছিলেন মিগ-২৯ (MiG-29) যুদ্ধবিমান ও বিএনএস (BNS) বঙ্গবন্ধু ফ্রিগেট কেনাকাটায় অনিয়মে। ২০০১ সালে এই অভিযোগে মামলা হয়, কিন্তু ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় ফেরার পর আদালতের মাধ্যমে মামলাটি গোপনে খারিজ হয়ে যায়।
২০১১ সাল থেকে তার নির্দেশেই বাংলাদেশ চীনের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে সামরিক সরঞ্জাম কেনায়। পশ্চিমা প্রতিষ্ঠানগুলো ঘুষ দিতে অস্বীকৃতি জানালেও চীনা কোম্পানিগুলো কমিশন প্রদানে রাজি থাকায় তারা হয়ে ওঠে দুর্নীতির ‘পছন্দের অংশীদার’। ‘জাতীয় নিরাপত্তা’ আড়ালে এসব চুক্তি গোপন রাখা হতো, যা তারিক সিদ্দিকী কৌশলে কাজে লাগাতেন। গত ১৫ বছরে সামরিক আধুনিকায়নে খরচ হয়েছে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা, যার ১৫% কমিশন হিসেবেই তার ব্যক্তিগত আয় দাঁড়ায় ১৫,০০০ কোটি টাকারও বেশি।

অবকাঠামো ও বেসামরিক প্রকল্পেও হাত
দুর্নীতি শুধু অস্ত্র কেনাকাটায় সীমাবদ্ধ ছিল না। ক্যান্টনমেন্টের ভেতরের বড় বড় অবকাঠামো প্রকল্পেও টেন্ডার জালিয়াতি ছিল নিয়মিত ঘটনা। শুধুমাত্র তারিক সিদ্দিকীর ঘনিষ্ঠ ব্যবসায়ীরাই কাজের সুযোগ পেতেন এবং ঠিকাদাররা আগে থেকেই জানতেন কারা কাজ পাবেন।
এছাড়া, সামরিক বাহিনীর নেতৃত্বে পরিচালিত অনেক বেসামরিক প্রকল্পও ছিল দুর্নীতির আখড়া। সড়ক, সেতু ও সরকারি ভবন নির্মাণের দায়িত্ব সেনাবাহিনীকে দেওয়া হলেও প্রকৃত কাজ করত তারিক সিদ্দিকীর নির্বাচিত প্রাইভেট কোম্পানি, যারা মোটা অঙ্কের ঘুষ দিত।
এই ধরনের প্রকল্প থেকেও সিদ্দিকী হাজার হাজার কোটি টাকা কমিশন নেন। সব মিলিয়ে, গত ১৫ বছরে তার অবৈধ আয় ছাড়িয়ে গেছে ৬০,০০০ কোটি টাকা, যার একটি বড় অংশ বিদেশে পাচার হয়েছে বলে ধারণা করা হয়।
বাংলাদেশের সামরিক ও অবকাঠামো আধুনিকায়নের নামে, যা জনগণের সামনে উন্নয়নের সাফল্য হিসেবে প্রচারিত হয়েছিল, তা আসলে ছিল রাষ্ট্রীয় দুর্নীতির সুপরিকল্পিত রূপ।
পর্দার আড়ালে ছিলেন তারিক আহমেদ সিদ্দিকী — বছরের পর বছর জবাবদিহিতার বাইরে, অদৃশ্যভাবে এবং অনায়াসে দেশের সম্পদ লুটে নেওয়া এক ছায়াশাসক।
তার রেখে যাওয়া দুর্নীতির উত্তরাধিকার আজ দৃশ্যমান। বিধ্বস্ত বিমান, লুণ্ঠিত রাষ্ট্রীয় সম্পদ, এবং দেশের গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতি জনগণের আস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার পেছনে আওয়ামী লীগের লুটেরা তারিক আহমেদ সিদ্দিকী অন্যতম দায়ী।
এনএনবাংলা/আরএম
আরও পড়ুন
এক ট্রলারে ধরা পড়ল ৬০ মণ ইলিশ, বিক্রি সাড়ে ৩৫ লাখ
বিমানবন্দরের চারপাশে ২৬৩টি অনুমোদনহীন উঁচু ভবন, জানানো হয়েছে রাজউককে
চাকরি পাওয়া মুক্তিযোদ্ধার সন্তানদের তথ্য নিচ্ছে সরকার: মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক উপদেষ্টা