March 3, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Monday, March 3rd, 2025, 11:14 am

দুর্বল অবস্থা থেকে পূবালী ব্যাংক যেভাবে শীর্ষ পর্যায়ে

নিজস্ব প্রতিবেদক:
শুরুতে বেসরকারি খাত থেকে জাতীয়করণ। এরপর আবার বেসরকারি খাতে যাত্রা। জন্মের পর থেকে এমন নানা রূপান্তরের মধ্য দিয়ে গেছে পূবালী ব্যাংক। একসময় আর্থিক সংকটে পড়া পূবালী ব্যাংক এখন দেশের শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকগুলোর একটি। ভালো গ্রাহক, কম খেলাপি ঋণ ও ব্যবস্থাপনা দক্ষতার কারণে দেশের ব্যাংক খাতে মুনাফায় শীর্ষে থাকা ব্যাংকগুলোর একটি এটি। তবে সমস্যা কাটিয়ে রাতারাতি ব্যাংকটির এ উত্তরণ ঘটেনি। এ জন্য সময় লেগেছে প্রায় ২১ বছর।

১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির খেলাপি ঋণ ছিল ৫৪ শতাংশ। সর্বশেষ গত বছরের ডিসেম্বরে খেলাপি এ ঋণ কমে ৩ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। শুধু খেলাপি ঋণ নয়, নানা উদ্যোগ ও সুশাসনের মাধ্যমে আর্থিক বিভিন্ন সূচকে ব্যাংকটিকে শীর্ষস্থানীয় ব্যাংকে পরিণত করা হয়েছে। ব্যাংকটি এখন তার কর্মীদের সর্বোচ্চ সুবিধা দেওয়ার পাশাপাশি মৌলিক চাহিদার পাঁচ খাতে ঋণ বিতরণে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে। এ কারণে আর্থিক খাতের নানা অনিয়মের মধ্যেও নিজেদের শক্তিশালী অবস্থান ধরে রাখতে পেরেছে। গত বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়েছে প্রায় ১৪ হাজার কোটি টাকা। আর বছর শেষে পরিচালন মুনাফা করেছে ২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। এখন নিরীক্ষা শেষে হাজার কোটি টাকা প্রকৃত মুনাফা হবে বলে আশা করছে ব্যাংকটি।

দুর্বল ব্যাংক থেকে ভালো ব্যাংকে রূপান্তরের গল্প জানান ব্যাংকটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) মোহাম্মদ আলী। তিনি বলেন, ‘আমাদের ব্যাংকে কোনো ঋণ আমার কিংবা শীর্ষ পর্যায়ের কোনো কর্মকর্তার পরামর্শে কখনো দেওয়া হয় না। আমরা কখনো এ ধরনের নির্দেশনাও দিই না। শাখা ও আঞ্চলিক কার্যালয়গুলো ঋণ প্রস্তাবের বিপরীতে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন করে যদি তারা সন্তুষ্ট হয় তবেই ঋণ অনুমোদন করা হয়। নিয়ম মেনে ঋণের সীমা অনুযায়ী কোনো কোনো ক্ষেত্রে এমডিও পরিদর্শনে গেছেন। এভাবে নিয়ম মেনে ঋণ দেওয়ায় পূবালী ব্যাংকে কোন ব্রিফকেস বা অস্তিত্বহীন কোম্পানির ঋণ নেই। এতেই ব্যাংকটি শীর্ষে উঠে এসেছে। আর সুশাসনের কথা আমরা শুধু মুখে বলি না, বাস্তবে প্রয়োগ করি।’

হাতবদল যেভাবে

বাঙালি মুসলিম উদ্যোক্তাদের হাত ধরে ১৯৫৯ সালে এ ব্যাংকের যাত্রা শুরু হয়। তখন নাম ছিল ইস্টার্ন মার্কেন্টাইল ব্যাংক। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার পর জাতীয়করণ করা হয়, নাম রাখা হয় পূবালী ব্যাংক। জাতীয়করণের পর বিভিন্ন সরকারের মেয়াদে ব্যাংকটিতে নানা ঋণ অনিয়মের ঘটনা ঘটে। তাতে ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির বিতরণ করা ঋণের ৫৪ শতাংশ খেলাপি হয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতিতে ব্যাংকটিকে আবার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেয় সরকার। ১৬ কোটি টাকায় ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটির শেয়ার বেসরকারি খাতে ছেড়ে দেওয়া হয়। তাতে স্বাধীনতার আগে বেসরকারি খাতের উদ্যোক্তাদের অনেকে আবার যুক্ত হন ব্যাংকটির সঙ্গে। তাঁদের অনেকেই বা তাঁদের পরিবারের সদস্যরা এখনো ব্যাংকটির সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন।

বেসরকারি খাতে আসার পর উদ্যোক্তারা ব্যাংকটির সংস্কারে হাত দেন। এরই অংশ হিসেবে শুরুতে কর্মীদের মধ্যে সেবা দেওয়ার মানসিকতার উন্নতি ঘটানো হয়। পাশাপাশি জোর দেওয়া হয় ঋণ আদায়ে। এর অংশ হিসেবে ঋণের টাকা আদায়ে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশন (বিএডিসি) ভবন ও বাংলাদেশ দুগ্ধ উৎপাদনকারী সমবায় ইউনিয়ন লিমিটেডের (মিল্ক ভিটা) ভবন নিলামে তোলা হয়। পরে ভবন দুটি রক্ষায় সরকার বাধ্য হয়ে টাকা পরিশোধ করে। এ সময় ব্যাংকটি যেকোনো ধরনের অনিয়মে শূন্য সহনশীলতার নীতি নেয়।

নতুন পর্ব

২০০৫ সালে পূবালী ব্যাংক সমস্যাযুক্ত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। তাই ২০০৭ সালে ব্যাংকটি থেকে পর্যবেক্ষক সরিয়ে নেয় বাংলাদেশ ব্যাংক। তখন পূবালী ব্যাংক একজন গ্রাহককে তাঁর পুরো জীবনে সেবা দেওয়ার লক্ষ্য নির্ধারণ করে। পাশাপাশি কোনো গ্রাহক ব্যাংক ছেড়ে চলে গেলে এর জন্য শাখা ব্যবস্থাপককে জবাবদিহির আওতায় আনা হয়। ২০০৯ সালে কোর ব্যাংকিং সফটওয়্যার (সিবিএস) চালু করে ব্যাংকটি। এর পর থেকে প্রযুক্তি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে থাকে পূবালী ব্যাংক। একই সময়ে ভিসা, মাস্টারকার্ড, কিউ ক্যাশ কার্ড সেবা, নিজস্ব এটিএম, সিআরএম সেবা চালু করা হয়। সেই সঙ্গে গ্রাহকদের জন্য নতুন নতুন সেবা চালু করে। পরিবর্তন আনা হয় ব্যাংকের সাজসজ্জায়ও। কর্মীদের প্রত্যেককে কম্পিউটার দেওয়া হয়। নিশ্চিত করা হয় সুশাসন। এভাবে ধীরে ধীরে ব্যাংকটি পৌঁছে যায় শীর্ষে।

গেমচেঞ্জার

১৯৭৭ সালে পূবালী ব্যাংকে যোগদান করে ২০০৬ সালে ব্যাংকটির এমডির দায়িত্ব পান হেলাল আহমেদ চৌধুরী। তিনি ২০১৪ সাল পর্যন্ত এমডির দায়িত্ব পালন করেন। তার আগের ছয় বছর ব্যাংকটির এমডি ছিলেন প্রয়াত ব্যাংকার খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ। ব্যাংকটির গতিমুখ পরিবর্তনে তাদের গেমচেঞ্জার বলা হয়।

হেলাল আহমেদ চৌধুরী বর্তমানে বেসিক ব্যাংকের চেয়ারম্যান। তিনি বলেন, সরকারি খাতে থাকার সময় ব্যাংকটিতে সুশাসনের অনেক ঘাটতি ছিল। ওই সময় সরকারি–বেসরকারি অনেক ঋণ খারাপ হয়ে যায়। ১৯৮৪ সালে ব্যাংকটি বেসরকারি খাতে যাওয়ার পর নতুন পর্ষদ অনেক পরিপক্ব সিদ্ধান্ত নেওয়া শুরু করে।

প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে কর্মী নিয়োগ শুরু হয়। সব কর্মীকে যথাযথভাবে প্রশিক্ষিত করে তোলা হয় প্রশিক্ষণের মাধ্যমে। কর্মীরা যাতে যথাযথভাবে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেন, সে জন্য তাঁদের সুযোগ-সুবিধাও বাড়ানো হয়। এ ছাড়া বেসরকারি খাতে যাওয়ার কোনো অলিগার্ককে বড় অঙ্কের কোনো ঋণ দেওয়া হয়নি। বর্তমান এমডি ২০০৮ সালে ব্যাংকে যোগ দিয়ে প্রযুক্তির ব্যবহারে বড় পরিবর্তন নিয়ে আসেন। এর ফলে ব্যাংকটি এখন শীর্ষ পর্যায়ে পৌঁছেছে।

৬৫ বছরে ১৩ এমডি

ব্যাংক সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, ১৯৫৯ সালে ব্যাংকটির এমডি ছিলেন এম মাহমুদ। তিনি ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। এরপর ১৯৬৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্ত এমডির দায়িত্বে ছিলেন এম খালেদ। ১৯৮২ থেকে ১৯৮৩ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এমডি ছিলেন আশরাফুল হক। এরপর ১৪ মাস এমডির দায়িত্ব পালন করেন আবদুল মতিন খান। বেসরকারি খাতে যাওয়ার পর ১৯৮৫ থেকে ১৯৮৯ সাল পর্যন্ত এমডির দায়িত্বে ছিলেন শেখ আমিনুল ইসলাম। শেখ আমিনুলের পর আবারও ব্যাংকটির হাল ধরেন আবদুল মতিন খান। ১৯৯২ সাল থেকে একে একে ব্যাংকটির এমডির দায়িত্ব পালন করেন যথাক্রমে কাজী আবদুল মজিদ, কামরুল হুদা, খোন্দকার ইব্রাহিম খালেদ, হেলাল আহমেদ চৌধুরী, আবদুল হালিম চৌধুরী, সাইফুল আলম খান চৌধুরী ও মোহাম্মদ আলী। এর মধ্যে কামরুল হুদা ও ইব্রাহিম খালেদ ৬ বছর করে, হেলাল আহমেদ চৌধুরী ৮ বছর ও আবদুল হালিম চৌধুরী ৭ বছর করে এমডির দায়িত্ব পালন করেন।

ধারাবাহিক উন্নতি

ব্যাংকটির নথিপত্র অনুযায়ী, ১৮৯৪ সালে ব্যাংকটির আমানত ছিল ৫৪১ কোটি টাকা। আর ঋণ ছিল ৪৩৩ কোটি টাকা। ওই বছরে পরিচালন মুনাফা করে ৫৫ লাখ টাকা। আর প্রকৃত মুনাফা দাঁড়ায় ১২ লাখ টাকা। ২০০০ সালে আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৩ হাজার ১০ কোটি টাকায়। আর ঋণের স্থিতি ছিল ২ হাজার ১৫৭ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণ কমে ৩৫ শতাংশে নেমে আসে। ওই বছর ব্যাংকটির প্রকৃত মুনাফা ছিল ৩২ কোটি টাকা।

ধারাবাহিক এ উন্নতির ফলে ২০০৫ সালে পূবালী ব্যাংক সমস্যাযুক্ত ব্যাংক থেকে বেরিয়ে আসে। ওই বছর ব্যাংকটির আমানত বেড়ে দাঁড়ায় ৪ হাজার ৪৫০ কোটি টাকায়। আর ঋণ ছিল ৩ হাজার ২৬৪ কোটি টাকা। খেলাপি ঋণের হার কমে ১৪ দশমিক ৩০ শতাংশে নেমে আসে। ২০০৫ সালে ব্যাংকটির প্রকৃত মুনাফা ছিল ৫৭ কোটি টাকা। এরপর ব্যাংকটিকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি।

সর্বশেষ ২০২৪ সালে পূবালী ব্যাংকের আমানত বেড়ে হয়েছে ৭৪ হাজার ৫২৩ কোটি টাকা। এ সময়ে ঋণ বেড়ে দাঁড়ায় ৬২ হাজার ৯২৫ কোটি টাকা। আর খেলাপি ঋণের হার কমে নেমে এসেছে ২ দশমিক ৬৭ শতাংশে। গত বছর ব্যাংকটি পরিচালন মুনাফা করেছে ২ হাজার ৩২৯ কোটি টাকা। ব্যাংকটির পরিশোধিত মূলধন এখন ১ হাজার ১৫৬ কোটি টাকা। আর কর্মীর সংখ্যা ১০ হাজার ৬৭৮ জন। সারাদেশে ৫০৮টি শাখা ও ২২৭টি উপশাখা রয়েছে ব্যাংকটির। বর্তমানে বেসরকারি খাতে সবচেয়ে বেশি নেটওয়ার্ক পূবালী ব্যাংকের।

ব্যাংকটির এমডি মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘মানুষের মৌলিক চাহিদা পূরণ করে এমন খাতের বাইরে ঋণ দেয় না পূবালী ব্যাংক। ব্যবসায় আমাদের যত ঋণ আছে, এর সবই খাদ্য ও খাদ্যসামগ্রী খাতে। এ ছাড়া বস্ত্র ও বস্ত্রসংশ্লিষ্ট খাতে আমাদের বড় বিনিয়োগ আছে। বাসস্থানের মধ্যে যারা সাশ্রয়ী আবাসন করে, আমরা তাদের অর্থায়ন করেছি। হাসপাতাল খাতেও আমাদের বিনিয়োগ সবচেয়ে বেশি। শিক্ষার মধ্যে ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেককে আমরা অর্থায়ন করেছি। ফলে আমাদের খেলাপি ঋণ কমে এসেছে। ভবিষ্যতে পূবালী ব্যাংককে বহুজাতিক ব্যাংকে রূপ দেওয়া যায় কি না, সে চেষ্টা করব আমরা। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ডিজিটাল ব্যাংকের যেসব সেবা চালু হচ্ছে, আমরাও তা চালু করতে চাই।’

সাম্প্রতিক সময়ে যেসব ব্যাংক নানা অনিয়মের কারণে সমস্যায় পড়েছে, তাদের বিষয়ে মোহাম্মদ আলী বলেন, ‘আমরা যেসব উদ্যোগের মাধ্যমে আজকের পর্যায়ে এসেছি, একই পদ্ধতি ব্যবহার করে সমস্যায় পড়া ব্যাংকগুলো ঘুড়ে দাঁড়াতে পারে। এ জন্য খেলাপি ঋণ আদায়ে সর্বোচ্চ জোর দিতে হবে। টাকা আদায়ে মামলার পাশাপাশি আলোচনাও চালিয়ে যেতে হবে। এ জন্য প্রয়োজনে ছাড়ও দিতে হবে। মামলা লড়তে গঠন করতে হবে শক্তিশালী টিম। সবদিক থেকে চাপ দিলে যারা প্রকৃত অসহায় তারা ছাড়া সবাই টাকা ফেরত দেবে।’