মোঃ জসিম উদ্দিন:
বাংলাদেশের আনাচে কানাচে প্রতি বছর যে পরিমাণ ওয়াজ মাহফিল হয় তা বিশ্বের হয়তো অনেক মুসলিম দেশেই হয় না। ওয়াজ মাহফিল আরো বেশি হোক এতে দোষের কিছু নাই। এসব মাহফিলে এসে অনেক মানুষ হেদায়েতের দিশা খুঁজে পায়। নিজেকে পরিবর্তন করে আপাদমস্তক একজন খাঁটি মুসলিম হবার প্রেরণা পায়। কিন্তু কিছু বক্তার ওয়াজ তাদের গুণগত মান যোগ্যতা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন রয়েছে।
ওয়াজ বাংলায় প্রচলিত অতি পরিচিত একটি আরবি শব্দ। এর অর্থ উপদেশ, আবেদন, প্রচার, সতর্কীকরণ ইত্যাদি। তারা কুরআনের বাণীতে উদ্বুদ্ধ হয়েই এ কাজটি করে থাকেন। এক্ষেত্রে আল্লাহ পাক বলেন, আর যেন তোমাদের মধ্যে এমন একটি দল হয়, যারা কল্যাণের প্রতি আহবান করবে, ভাল কাজের আদেশ দেবে এবং মন্দ কাজ থেকে নিষেধ করবে। আর তারাই সফলকাম। (সূরা আলে ইমরান: ১০৪)
ওয়ায়েজিন কিংবা ইসলামী বক্তাদের সমালোচনা করার মতো যথেষ্ট জ্ঞান বুদ্ধি আমার নেই। ভুলের ঊর্ধ্বে আমরা কেউ নই। তবে বক্তাদের অভিনয় ভঙ্গিমা ও গানের সুরে ওয়াজ মাহফিল যারা করেন এজাতীয় বক্তার সমালোচনা করতে খুব বেশি জ্ঞানের প্রয়োজন নেই। এজন্য সাধারণ জ্ঞানটায় যথেষ্ট। বাংলাদেশের মানুষ মুসলিম তাদেরও ইসলাম সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান আছে। এমনকি মাহফিলে এমন শিক্ষিত বিজ্ঞ মুফতি আলেম ফকিহ মুহাদ্দিস থাকেন যিনি বক্তার চেয়ে অনেক বেশি জানেন এবং অধিক যোগ্য। তারা নিজেদেরকে আড়ালেই রাখতে পছন্দ করেন।
বাংলাদেশে বেশ কিছু আন্তর্জাতিক মানের ইসলামি স্কলার তথা বক্তা আছেন। তাদের বক্তব্য উপস্থাপনা কৌশল সুর এককথায় অপূর্ব মনোমুগ্ধকর। অপরদিকে কিছু বক্তার বক্তব্য যথেষ্ট অর্বাচীন ও অপরিপক্ব বলে মনে হয়। পবিত্র কুরআন হাদিসের মাহফিলে যে ভাবগাম্ভীর্য পরিবেশ থাকা প্রয়োজন তাদের মাহফিলে সেটি পুরোপুরি অনুপস্থিত। তার নিজেদেরকে সেলিব্রিটি বানাতে ব্যস্ত বেশী, তাই ইসলামের নামে অপব্যাখ্যা দিয়ে নিজেদেরকে আলোচনায় সমালোচনায় রাখতে বেশি পছন্দ করেন।
শুধু তাই নয় তাদের অঙ্গভঙ্গি রসিকতা, যাত্রা পালা, সার্কাস সিনেমার ভাঁড় ও জোকারদের হার মানায়। তাদের অতি কথন, গানের টান, জিকিরের স্টাইল দূর থেকে যে কারো কাছে কোন শিল্পীর কনসার্ট মনে হবে। কুরআনের মাহফিলে লোক সমাগম হবে কুরআনের টানে, ইসলামকে ভালবেসে, কিন্তু কিছু বক্তা হাসি তামাশার অভিনয় করে লোকজনদের ধরে রাখার প্রয়াস চালায়। এতে ইসলামের মূল সৌন্দর্য বিনষ্ট হচ্ছে। যুবক তরুণদের মনে ইসলামের মূল বার্তার পরিবর্তে একটি মিশ্র জগাখিচুড়ি অনৈসলামিক বিষয় মনে বদ্ধমূল হচ্ছে। আজ দেশে বক্তার অভাব নেই কিন্তু আমল আখলাক ও কুরআন হাদিসের বিশুদ্ধ জ্ঞান কয়জনের আছে তা কিন্তু ভাববার বিষয়। কেউ ওয়াজ করে পেশায়, কেউ নেশায়।
কিন্তু আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের আকাঙ্ক্ষা আছে কয়জন ওয়ায়েজিনের? আজ বাংলাদেশে হুজুরদের বিভাজন, দলাদলি ও তরিকার শেষ নেই। কিন্তু হাক্কানি সহিহ তরিকা ও সিলসিলার বক্তা আজ সংখ্যায় খুবই নগণ্য। যে কয়জন আছেন তারাও বিভিন্ন কারণে কোণঠাসা অবস্থায় থাকেন। কেননা তাদের সত্য বচন ও কথন অনেকের গা জ্বালা করে। আসলে সত্যের পক্ষে অবিচল মানুষের পথটি হয় খুব জটিল।
হাদিসে এসেছে ওলামারা হচ্ছেন নবীদের উত্তরসূরি। আমরা অল্প শিক্ষিত,অর্ধ শিক্ষিত, অশিক্ষিত মানুষ এদেশের আলেমদের কাছ থেকে শেখে উপকৃত হবার চেষ্টা করি। তাদের অন্ধের মতো ভালোবাসি। কিন্তু তাদের চরিত্র লেনদেন কথাবার্তা দেখে তাদের প্রতি যে শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা থাকার কথা সেটি আর অবশিষ্ট থাকে না। কিছু আলেমের ভ্রান্ত আকিদা অসংযত আচরণ দিনদিন সাধারণ মানুষকে তাদের থেকে বিকশিত করছে।তাদের কারণে কিছু মানুষ গোমরাহীর দিকে পা বাড়াচ্ছে।
যখন নাচ গান করে মাহফিলে জিকির করা করা হয় তখন সেখানে প্রকৃত ইসলামের উপস্থিতি কতটুকু থাকে? যেখানে জিকির অর্থ আল্লাহকে স্মরণ করা সেখানে এসব জিকির কি ইঙ্গিত বহন করে? আল্লাহ পাক বলেন, ‘আর সকাল-সন্ধ্যায় তোমার প্রভুকে স্মরণ করতে থাকো মনে মনে একান্ত বিনয়ের সঙ্গে, ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এবং অনুচ্চ স্বরে (এমন স্বরে, যা চিৎকার করে বলা অপেক্ষা কম) আর তুমি উদাসীন হয়ো না’। (সুরা আরাফ, আয়াত: ২০৫)
যখন মাহফিলে ওয়াজ জিকির হয় বসেন বসেন বইসা যান। উচ্চ স্বরে গান গাওয়া হয় সেখানে ইসলামের কি চর্চা হয়? অথচ জিকির সম্বন্ধে আল্লাহ পাক বলেন, তোমরা নিজ পালনকর্তাকে ডাকো বিনীতভাবে ও সংগোপনে। নিশ্চয়ই আল্লাহ সীমা অতিক্রমকারীদের পছন্দ করেন না। (সুরা আরাফ, আয়াত : ৫৫)\
শেষ করছি কবি কাজী নজরুল ইসলামের কবিতার কয়েকটি পংক্তি দিয়ে,
বিশ্ব যখন এগিয়ে চলেছে,
আমরা তখনও বসে-
স্ত্রী তালাকের ফতোয়া খুঁজেছি,
ফিকাহ ও হাদিস চষে।
(লেখক প্রবাসী সাংবাদিক, নিউ ইয়র্ক, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র)
আরও পড়ুন
অপবিত্র অবস্থায় গ্লাভস পরে কোরআন ধরা যাবে?
পশুপাখির প্রতি দয়া ও ভালোবাসা
নতুন বছরের শুরুতে যে দোয়া পড়বেন