নিজস্ব প্রতিবেদক:
নিরাপদ খাদ্য নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। দেশে খাদ্য উৎপাদনে সফলতা এলেও বিভিন্ন রাসায়নিক উপাদান ব্যবহারে সরকার অনুমোদিত মাত্রা মানা হচ্ছে না। বরং প্রতিনিয়ত খাদ্য প্রস্তুতে ব্যবহৃত ভারী ধাতু ও বিভিন্ন ক্ষতিকারক উপাদান ব্যবহারের ওই ভয়াবহতা বাড়ছে। বিষ সমান ওসব উপাদান ব্যবহারে দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকিতে পড়ছে মানবশরীর। তাতে ক্যানসারের মতো মরণব্যাধি বাড়ছে। গত অর্থবছর (২০২১-২২) সারাদেশে খাদ্যের মান ও নিরাপত্তা পরীক্ষার জন্য বাংলাদেশ নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের (বিএফএসএ) তত্ত্বাবধানে বছরব্যাপী যতো পণ্য পরীক্ষা করা হয়েছে তাতেই ভয়াবহ এসব তথ্য উঠে এসেছে। তার মধ্যে বিভিন্ন ধরনের বেকারিপণ্য, কোমলপানীয়, মিষ্টিজাত পণ্য, মাছ, আচার, সস, এমনকি দুধের মধ্যেও মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদান মিলেছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ গত বছর সারাদেশ থেকে ১ হাজার ২৮২টি খাদ্যের নমুনা সংগ্রহ করে। তার মধ্যে ১৫২টি নমুনায় সরকার নির্ধারিত (অনুমোদিত) মাত্রার ওপরে ছিল ক্ষতিকারক উপাদানের মাত্রা। ওসব খাদ্য মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াচ্ছে। নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ২০২১-২২ অর্থবছরে সারাদেশ থেকে মোট ১৭৭টি পাউরুটির নমুনা সংগ্রহ করে পরীক্ষা করে ১৭১টি নমুনায় পটাশিয়াম ব্রোমেট ও ৬টি নমুনায় অনুজীবীয় দূষকের উপস্থিতি পায়। ওসব নমুনার মধ্যে ৩৮টি পাউরুটিতে ব্রোমেটের মাত্রা খুব ক্ষতিকারক পর্যায়ে ছিল। ঢাকার চেয়ে গ্রাামগঞ্জের বেকারির পাউরুটিতে ওই ক্ষতিকারক উপাদানের উপস্থিতি বেশি। ঢাকা থেকে সংগৃহীত ৯৮টি পাউরুটির মধ্যে ১৫টি নমুনায় ছিল আর সারাদেশের ৭৩টির নমুনার মধ্যে ২৩টিতে ব্রোমেট ছিল। তাছাড়া সারাদেশের বিভিন্ন স্থান থেকে কোমলপানীয়ের ১৪৬টি নমুনা পরীক্ষা করে ৩১টি নমুনায় ভয়াবহ আকারের ক্যাফেইনের উপস্থিতি পাওয়া যায়। অথচ বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ড অনুযায়ী প্রতি লিটার কোমলপানীয়ের মধ্যে সর্বোচ্চ ক্যাফেইন ১৪৫ মিলিগ্রাম থাকবে। সেখানে কোনো কোনো ব্র্যান্ডের পানীয়তে ওই মাত্রা দ্বিগুণের বেশি ছিল। তবে সবগুলো নমুনার মধ্যে ৫৩টি নমুনায় ক্যাফেইন শনাক্ত হয়নি। আর ৬২টি নমুনায় ক্যাফেইন অনুমোদিত মাত্রার নিচে ছিল।
সূত্র জানায়, সারা দেশে বিক্রি হওয়া প্যাকেটজাত ও খোলা চিনির ১৬টি নমুনা পরীক্ষায় ৩টি প্রতিষ্ঠানের উৎপাদিত ৫টি চিনির নমুনায় ম্যাগনেসিয়াম সালফেটের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাছাড়া দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে ৩১টি ও ঢাকা শহরের বিভিন্ন স্থান থেকে ১৬টি গুড়ের নমুনা পরীক্ষা করা হয়। ওই ৪৭টি নমুনার মধ্যে ২০টি নমুনায় হাইড্রোজের (হাইড্রোজেন সালফেট) উপস্থিতি পাওয়া যায়।
তার মধ্যে জেলা পর্যায় থেকে সংগৃহীত নমুনার মধ্যে ১২টি নমুনায় হাইড্রোজ পাওয়া যায় আর রাজধানীর গুড়ে তার মাত্রা আরো বেশি। ঢাকা থেকে সংগৃহীত ১৬টি গুড়ের নমুনার মধ্যে ৮টি নমুনায় ওই ক্ষতিকর উপাদান ছিল। আর ঢাকা থেকে কেকে ব্যবহৃত রঙের ২৪টি নমুনা পরীক্ষা করে ১৪টি নমুনায় মার্কারি ও ১০টি নমুনায় লেডের উপস্থিতি পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় মার্কারির উপস্থিতি না পাওয়া গেলেও ৬টি নমুনায় লেডের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাছাড়াও কেকে ব্যবহৃত রঙের ১৪টি নমুনায় ফুড গ্রেড কালার আছে কিনা তা পরীক্ষা করে ৩টি নমুনায় স্ট্যান্ডার্ডের বিপরীতে ফুড গ্রেড কালার পাওয়া যায়নি। আর ঢাকা জেলার বিভিন্ন স্থান থেকে ৬০টি বিভিন্ন প্রকারের শুঁটকি মাছের নমুনা সংগ্রহ করে ডিডিটি ও হেপ্টাক্লোর পেস্টিসাইড রেসিডিও পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষায় কোনো নমুনায় উল্লিখিত পেস্টিসাইড রেসিডিওর উপস্থিতি পাওয়া যায়নি। তবে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, সিলেট, সুনামগঞ্জ, ভোলা ও পটুয়াখালী থেকে সংগৃহীত মোট ৬১টি নমুনায় ডিডিটি, হেপ্টাক্লোর, ডায়াজিনন, প্রোফেনোফস ও ক্লোরপাইরিফস ওই পাঁচ ধরনের পেস্টিসাইড রেসিডিও বিশ্লেষণ করা হয়েছে। তখন চট্টগ্রাম থেকে সংগৃহীত একটি নমুনায় ক্লোরপাইরিফস ও পটুয়াখালী থেকে সংগৃহীত একটি নমুনায় প্রোফেনোফসের উপস্থিতি পাওয়া যায়। তাছাড়া সারা দেশ থেকে সংগৃহীত ৬২টি আচার ও সসের মধ্যে ১৪টিতে বেনজয়িক অ্যাসিডের মাত্রা অনুমোদিত মাত্রার চেয়ে অধিক পাওয়া যায়।
সূত্র আরো জানায়, মাত্রাতিরিক্ত ক্ষতিকারক উপাদানযুক্ত খাবারগুলো নিয়মিত খাওয়া মানবশরীরের জন্য মারাত্মক হুমকি। মানুষের খাদ্যচক্রে ওসব ভারী ধাতুর প্রভাব তাৎক্ষণিকভাবে দৃশ্যমান না হলেও দীর্ঘমেয়াদে তা বড় ধরনের স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। কারণ খাদ্যে ওসব ক্ষতিকারক ধাতবের উপস্থিতি সহনশীল মাত্রার ভেতরে আছে কিনা সেটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাত্রার বাইরে হলে প্রাথমিকভাবে পেটে ব্যথা, বমি, ডায়রিয়া হতে পারে। কিন্তু নিয়মিত হলে তার প্রভাব মারাত্মক। সেক্ষেত্রে লিভার ক্ষতিগ্রস্তহবে। ক্যানসারও হতে পারে। খাবারে সিসা (লেড) শিশুদের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে। মাত্রার চেয়ে বেশি সিসা শিশুদের শরীরের বৃদ্ধি ও মানসিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হয়। তাছাড়া খাবারে অরুচি, ওজন কমে যাওয়া, খিটখিটে মেজাজ হয়। আবার দীর্ঘমেয়াদে শরীরে বেশি প্রবেশ করলে তা স্নায়ু, পরিপাকতন্ত্র, কিডনি, ফুসফুস ও রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতার ক্ষতি করে। হেভি মেটাল বলে শরীরে ক্যানসারেরও সৃষ্টি করে।
এদিকে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ সংশ্লিষ্টদে মতে, কোমলপানীয়তে ক্যাফেইন মাত্রাতিরিক্ত হলে তা মাদক। আর মাদকের ক্ষতি সবার জানা। তা শরীরের পাশাপাশি মানসিক ও আর্থিক ক্ষতির কারণ। আর খাবারে ম্যাগনেশিয়াম সালফেট ও বেনজয়িক অ্যাসিডের মতো ক্ষতিকারক বিষাক্ত উপাদানও বড় স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণ। গত অর্থবছর যেসব খাবারে সমস্যা পাওয়া উৎপাদনকারীদের প্রাথমিকভাবে সেগুলোর সতর্ক করা হয়েছে। কিছুদিন বাদে আবারো তাদের সেসব খাদ্যের নমুনা পরীক্ষা করা হচ্ছে। তারপরও সমস্যা পেলে ওসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে আদালতে মামলা করা হয়। পাশাপাশি নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ ওসব ক্ষতিকারক উপাদান সম্পর্কে ভোক্তাকে জানাতে নিয়মিত গণবিজ্ঞপ্তি ও সচেতনতামূলক প্রচারণা চালায়। তবে এখন পর্যন্ত শুধু গুড়ে হাইড্রোজ মেশানোর অপরাধে ৪টি মামলা করা হয়েছে। তবে অন্য কোনো খাবারের জন্য এখনো কোনো মামলা হয়নি। তবে ওই প্রক্রিয়া চলমান।
অন্যদিকে এ প্রসঙ্গে নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষের সদস্য অধ্যাপক ড. মো. আবদুল আলীম জানান, অনেক পণ্যের নমুনার ঠিকানায় প্রতিষ্ঠান পাওয়া যায় না। আবার কোনো কোনো পণ্য আমদানিকারকের রেজিস্ট্রেশন নেই। ফলে কর্তৃপক্ষের কাছে পর্যাপ্ত তথ্য থাকে না। সেক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান শাস্তির বাইরে রয়ে যায়।
আরও পড়ুন
আগামী বিজয় দিবস গণহত্যাকারীর শাস্তির রায়ে উদ্যাপন হবে: আসিফ নজরুল
বাড়তি দামে বিক্রি হচ্ছে খাসি-মুরগি-মাছ
কাল থেকে ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়ের কাজ শুরু: উপদেষ্টা