নিজস্ব ডেস্ক:
গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনে অভিযুক্ত ব্যক্তিদের নির্বাচন থেকে দূরে রাখতে একটি বিশেষ আইনের খসড়া তৈরি করছে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন। খসড়ায় বিচারবহির্ভূত হত্যা, গণহত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতনের মতো মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্ত হলেই জাতীয় সংসদ নির্বাচন থেকে বিরত রাখার বিধান রাখা হচ্ছে।
সংস্কার কমিশন সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংস্কার কমিশন তাদের সুপারিশের যে সারসংক্ষেপ প্রকাশ করেছে, সেখানেও এ–সংক্রান্ত সুপারিশ রয়েছে। এখন তারা এ বিষয়ে একটি আইনের খসড়া তৈরি করে তা সরকারকে দেবে। তবে এখন পর্যন্ত এই আইনের খসড়া চূড়ান্ত হয়নি। কমিশন খসড়া তৈরির কাজ করছে। ৩১ জানুয়ারির মধ্যে সরকারকে এই খসড়া প্রস্তাব দেওয়া সম্ভব হবে বলে কমিশন আশা করছে।
এ ধরনের আইন হলে জুলাই গণ–অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি বড় অংশ আগামী নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যেতে পারেন। অবশ্য অভিযুক্ত হলেই কাউকে নির্বাচনের অযোগ্য করা হলে ভবিষ্যতে এই সুযোগের অপব্যবহার হওয়ার আশঙ্কা করেন আইন অঙ্গনের কেউ কেউ।
বর্তমান বিধানে যা আছে
বিদ্যমান সংবিধানে জাতীয় সংসদ সদস্য হওয়ার যোগ্যতা–অযোগ্যতার শর্ত সম্পর্কে বলা আছে। সেখানে কয়েকটি অযোগ্যতার একটি হচ্ছে, কোনো ব্যক্তির নৈতিক স্খলনজনিত ফৌজদারি অপরাধে ন্যূনতম দুই বছরের কারাদণ্ডে দণ্ডিত হলে এবং মুক্তিলাভের পর পাঁচ বছর পার না হওয়া পর্যন্ত তিনি সংসদ সদস্য হতে পারবেন না। আরেকটি অযোগ্যতা হলো, ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যোগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে কোনো অপরাধের জন্য দণ্ডিত ব্যক্তিও নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। সংবিধানের ওই অনুচ্ছেদে বলা আছে, কোনো আইনে দণ্ডিত ব্যক্তিও নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য বিবেচিত হবেন। এই ধারাটির ওপর ভিত্তি করে সংস্কার কমিশন একটি নতুন বিশেষ আইন প্রস্তাব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
বিদ্যমান বিধানে সাজা না হওয়া পর্যন্ত কেউ নির্বাচনের অযোগ্য হবেন না। আবার নিম্ন আদালতে সাজাপ্রাপ্ত হলেও উচ্চ আদালতে আপিল করে নির্বাচনে প্রার্থী হওয়ার নজির আছে। সংস্কার কমিশন মনে করছে, স্বৈরাচারী শাসনের পতনের পর গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য অপরাধীদের বিচারের পাশাপাশি রাজনৈতিক অঙ্গন থেকেও দূরে রাখা দরকার। তা না হলে ক্ষত পুরোপুরি দূর হবে না। এই বিবেচনায় সংস্কার কমিশন বিশেষ আইনের খসড়া তৈরি করছে। যাতে দণ্ড হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না হয়।
সংস্কার কমিশনের অবস্থান হলো—তারা যে আইন প্রস্তাব করবে, সেখানে মানবতাবিরোধী অপরাধে কেউ অভিযুক্ত হলেই সেই ব্যক্তিকে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণা করার ক্ষমতা দেওয়া হবে। যদি কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থার তদন্তে বিচারবহির্ভূত হত্যা, গুম, অমানবিক নির্যাতনের মতো গুরুতর মানবতাবিরোধী অপরাধের প্রমাণ মেলে এবং তিনি অভিযুক্ত হন, তাহলে তিনি নির্বাচনের অযোগ্য হবেন। এ ক্ষেত্রে আদালতের রায় বা সাজার জন্য অপেক্ষা করতে হবে না।
পরিবর্তনের চিন্তার পেছনে যুক্তি কী
সংস্কার কমিশনের একাধিক সদস্য বলেছেন, এ ক্ষেত্রে তাঁদের যুক্তি হলো মানবতাবিরোধী অপরাধ বিশেষ ধরনের অত্যন্ত গুরুতর অপরাধ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে পরিচালিত হয়। ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা অভিযোগের সত্যতা পাওয়ার অর্থ হচ্ছে, অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের যথেষ্ট তথ্য–প্রমাণ আছে। তাই বিশেষ আইনের খসড়ায় এ বিষয় রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
কমিশন সূত্র জানায়, অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন করা গুম কমিশনের তদন্তে যাঁরা অভিযুক্ত হবেন, তাঁদেরও অযোগ্য ঘোষণার বিধান রাখার নীতিগত সিদ্ধান্ত আছে। একই সঙ্গে গুরুতর দুর্নীতি ও অর্থ পাচারের অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশনের প্রাথমিক তদন্ত শেষে অভিযুক্ত হলেও সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান রাখার কথা ভাবা হচ্ছে। কিন্তু এটি শেষ পর্যন্ত রাখা যাবে কি না, তা নিয়ে কমিশনের মধ্যে এখনো সংশয় আছে। এটি নিয়ে আরও পর্যালোচনা চলছে। এ ক্ষেত্রে সাজা হওয়ার পর তাঁদের অযোগ্য ঘোষণা করার বিধান রাখা হতে পারে।
এ ছাড়া কোনো আদালত কাউকে ফেরারি আসামি ঘোষণা করলে তিনিও নির্বাচনের অযোগ্য হবেন, এমন বিধানও সেখানে রাখার চিন্তা আছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন মনে করছে, এই বিশেষ আইনটি করা হলে রাজনীতি থেকে দুর্বৃত্তায়ন ও ক্ষমতার অপব্যবহার কমে আসবে।
অবশ্য এভাবে শুধু অভিযুক্ত হলেই কোনো ব্যক্তিকে নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠার সুযোগ রয়েছে। নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশন সূত্র জানায়, তারাও বিষয়টি গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেছে। এটি নিয়ে তারা দেশি ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কয়েকজন আইন ও মানবাধিকারবিশেষজ্ঞের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে তাঁরা মনে করছেন, এ ধরনের বিধানে সমস্যা হবে না। কারণ, আইনে যেসব অপরাধের কথা বলা হবে, সেগুলো বিশেষ ধরনের গুরুতর অপরাধ। প্রাথমিক একটি তদন্তে সত্যতা পেলেই তাঁদের অভিযুক্ত করা হবে।
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রধান বদিউল আলম মজুমদার বলেন, বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা ও গবেষণা করে তাঁরা এ–সংক্রান্ত সুপারিশ করেছেন। মানবতাবিরোধী অপরাধ গুরুতর অপরাধ। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কারও বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হলে তাঁকে এবং গুম কমিশনের তদন্তে যাঁদের বিরুদ্ধে প্রমাণ পাওয়া যাবে, তাঁদের নির্বাচনে অযোগ্য ঘোষণা করা—এ রকম একটি বিশেষ আইন করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের নির্বাচনের অঙ্গন থেকে দূরে রাখা যায়। এ বিষয়ে তাঁরা একটি আইনের খসড়া দেবেন, যাতে সরকার এটিকে আইনে পরিণত করতে পারে।
শেষ পর্যন্ত যদি এ ধরনের আইন করা হয়, তাহলে পতিত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, তাঁর মন্ত্রিসভার সদস্য ও দলের জ্যেষ্ঠ নেতাদের একটি বড় অংশ আগামী নির্বাচনে অযোগ্য হয়ে যেতে পারেন। ইতিমধ্যে শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দুটি মামলা হয়েছে। আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী ও দলটির জ্যেষ্ঠ নেতাদের অনেকের বিরুদ্ধেও ট্রাইব্যুনালে মামলা আছে। এগুলোর তদন্ত চলছে। যদি তদন্ত শেষে চার্জশিট হয়, আর বিশেষ আইনটি কার্যকর হয়—তখন তাঁরা নির্বাচনের অযোগ্য বলে বিবেচিত হবেন।
নির্বাচনব্যবস্থা নিয়ে সংস্কার প্রস্তাব তৈরির জন্য গত ৩ অক্টোবর কমিশন গঠন করে সরকার। ১৫ জানুয়ারি কমিশন তাদের সুপারিশের সারসংক্ষেপ প্রকাশ করে। সেখানে কোনো আদালত থেকে ঘোষিত ফেরারি আসামিদের নির্বাচনে প্রার্থী হওয়া থেকে বিরত রাখা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে দোষী সাব্যস্ত হওয়ার শুরু থেকেই প্রার্থী হওয়ার অযোগ্য করা এবং গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনকারীদের বিশেষ আইনে নির্বাচনের অযোগ্য ঘোষণার সুপারিশ করা হয়। এখন তারা এ–সংক্রান্ত বিশেষ আইনের খসড়া করছে।
তবে দণ্ডিত হওয়ার আগেই নির্বাচনে অযোগ্য করা যৌক্তিক হবে কি না, এই প্রশ্নও কেউ কেউ তুলছেন। অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এম এ মতিন বলেন, সরকার চাইলে আইন করতে পারে। কিন্তু যতক্ষণ পর্যন্ত আদালতে সাক্ষ্যপ্রমাণের ভিত্তিতে কেউ দণ্ডিত না হন, ততক্ষণ পর্যন্ত তাঁকে নির্বাচনের অযোগ্য করা উচিত হবে না।
আরও পড়ুন
অতিরিক্ত চুলকানি হলে দ্রুত যা করবেন
চাকরির বয়সসীমা ৩৫ করার দাবিতে শাহবাগে সমাবেশ
সাজাপ্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতির ক্ষমার ক্ষমতা চ্যালেঞ্জ করে রিট