অনলাইন ডেস্ক:
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে বাহিনীর বিতর্কিত কর্মকাণ্ডের জন্য ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ পুলিশের পোশাক নিয়ে অস্বস্তির কথাও জানিয়েছিলেন। অস্বস্তির থেকে পুলিশের অনেক সদস্যও একই দাবি তুলেছিলেন গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে রাজারবাগের বিদ্রোহে।
শেষমেশ শুধু পুলিশ নয়, র্যাব ও আনসার বাহিনীর পোশাকেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, পুলিশের নতুন পোশাক হতে যাচ্ছে ‘আয়রন’ রঙের, র্যাবের ‘অলিভ’ আর আনসার বাহিনীর পোশাক হতে যাচ্ছে ‘গোল্ডেন হুইট’ রঙের।
সোমবার (২০ জানুয়ারি) সচিবালয়ে আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত উপদেষ্টা পরিষদ কমিটির সভা শেষে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী।
জানা গেছে, পুলিশ, র্যাব ও আনসার বাহিনীর জন্য যে তিন রঙের পোশাক বেছে নেওয়া হয়েছে তা প্রধান উপদেষ্টা অনুমোদন দিলেই আনুষ্ঠানিকভাবে দেওয়া হবে মাঠ পর্যায়ের পুলিশকে।
২০২০ সাল থেকেই পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টি নিয়ে আলোচনা চলছিল। ২০২১ সালের শুরুর দিকে পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের জন্য বেশ কয়েকটি পোশাকের ট্রায়ালও হয়। তবে নানা কারণে সেই নতুন পোশাক আর পাননি পুলিশ সদস্যরা। এখন পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন পোশাক পেতে যাচ্ছেন বাহিনীটির সদস্যরা।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাহিনীর সেবা মান ও মানসিকতায় পরিবর্তন আনা না গেলে শুধু পোশাক পরিবর্তন খুব বেশি কাজে আসবে না। আগেও অনেকবার পোশাক পরিবর্তন হয়েছে কিন্তু পুলিশের কোনো পরিবর্তন হয়নি। পোশাক পরিবর্তনের পরপরই পুলিশের মনোভাব পরিবর্তন জরুরি।
পোশাক পরিবর্তন কেন জরুরি হলো
একাদশ ও দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহৃত পুলিশ পতিত আওয়ামী লীগের রক্ষাকবচ হয়ে উঠেছিল। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে ২৮ অক্টোবর পল্টনে ডাকা বিএনপির সমাবেশ পণ্ড, পরে পার্টি অফিসে কথিত অভিযান ছাড়াও অতীতের নজির ভেঙে নির্বাচনের ঠিক আগে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরসহ প্রায় সব দলের প্রথম সারির নেতাদের রাজনৈতিক মামলায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ। যদিও বিরোধী অধিকাংশ দল বয়কট করেছিল জাতীয় নির্বাচন।
২৮ অক্টোবরের পর বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীসহ অধিকাংশ প্রথম সারির রাজনৈতিক দল পুলিশি নিষেধাজ্ঞায় ঢাকায় সভা-সমাবেশের অনুমতি পায়নি। পতিত আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক হাতিয়ার হয়ে ওঠা সেই পুলিশ বাহিনী তোপের মুখে পড়ে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে।
সরকারি চাকরিতে কোটার সংস্কার চেয়ে গত জুলাইয়ের শুরুতে মাঠে নেমেছিল শিক্ষার্থীদের নিয়ে গড়া বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলন দমাতে শুরু থেকেই মারমুখী ছিল পুলিশ। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ব্যাপক দমন-নিপীড়ন আর ধরপাকড়ে ছাত্রদের সেই আন্দোলন গণআন্দোলনে রূপ নেয়। কোটার আন্দোলন গিয়ে ঠেকে এক দফার আন্দোলনে। সেই আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা দেশ ছেড়ে পালালে ভেঙে পড়ে পুলিশের চেইন অব কমান্ড।
তারপর অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নিয়ে পুলিশকে স্বাভাবিক কার্যক্রমে ফেরাতে উদ্যোগ নেয়। এর মধ্যেই রাজারবাগে পুলিশের একাংশ বিদ্রোহ করে। সেখান থেকে পোশাক পরিবর্তনের দাবিও উত্থাপন করা হয়। তখন থেকে পোশাক পরিবর্তন নিয়ে জোর আলোচনা শুরু হয়। পোশাক পরিবর্তনকে পুলিশ সদস্য ও সাধারণ মানুষের ট্রমা কাটানোর প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা।
আগে যেমন ছিল পুলিশের পোশাক?
পুলিশের প্রথম পোশাক ছিল খাকি, তা ব্রিটিশ আমলের সঙ্গে জড়িত। ব্রিটিশ শাসনামলের প্রথম দিকে পুলিশের নির্ধারিত কোনো পোশাক ছিল না। পরে তাদের জন্য সাদা পোশাক নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু এ পোশাক নিয়ে একটি সমস্যা দেখা দেয়– পুলিশ সদস্যরা সাদা ইউনিফর্ম পরে ডিউটি করায় খুব তাড়াতাড়ি এটি নোংরা হয়ে যেত। এতে ব্রিটিশ পুলিশের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা খুবই বিচলিত হয়ে পড়তেন।
১৮৪৭ সালে ব্রিটিশ অফিসার স্যার হ্যারি লুমসডেনের পরামর্শে পুলিশের ইউনিফর্ম হালকা হলুদ এবং বাদামি রঙে রাঙানো হয়েছিল। তারপর চা পাতা, পানি ব্যবহার করে সুতির কাপড়ের রং রঞ্জকের মতো তৈরি করে ইউনিফর্মের ওপর লাগানো হতো। যার ফলে পোশাকের রং খাকি হয়ে যায়। সেই বছরই পুলিশে খাকি রঙের পোশাক গৃহীত হয়।
মহান মুক্তিযুদ্ধের সময়ও বাঙালি পুলিশ সদস্যরা খাকি রঙের পোশাক ব্যবহার করেন। অনেকে অবশ্য সাদা পোশাকেও লড়াই করেছেন পাক সেনাদের বিরুদ্ধে।
তবে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পুলিশের পোশাকে সবচেয়ে বড় পরিবর্তন আসে ২০০৪ সালে। সেই বছর পুলিশের পোশাক পরিবর্তন করে মহানগরগুলোয় হালকা জলপাই রঙের করা হয়। জেলা পুলিশকে দেওয়া হয় গাঢ় নীল রঙের পোশাক। র্যাবের কালো ও এপিবিএনের পোশাক তৈরি করা হয় খাকি, বেগুনি আর নীল রঙের মিশ্রণে। এমনকি ২০০৯ সালেও কিছুটা পরিবর্তন আসে পুলিশ বাহিনীর পোশাকে।
পোশাক পরিবর্তন নিয়ে সমালোচনা
পুলিশ র্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন হচ্ছে– এমন খবর চাউর হওয়ার পর অনেকেই সমালোচনা করেছেন। বলছেন, পোশাক পরিবর্তনের চেয়ে বেশি জরুরি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর খাসলতের পরিবর্তন, সেবা মানে উন্নতি।
এ ব্যাপারে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের অন্যতম সমন্বয়ক ও জাতীয় নাগরিক কমিটির মুখ্য সংগঠক সারজিস আলম ভেরিফায়েড ফেসবুক প্রোফাইলে দেওয়া এক পোস্টে লিখেছেন, ‘স্বভাব, চরিত্র, খাসলত পরিবর্তন না করে পোশাক পরিবর্তনে কোনো লাভ নাই। সমস্যা পোশাকে না, পুরো সিস্টেমে।’
প্রবাসী অনুসন্ধানী সাংবাদিক জুলকারনাইন সায়ের ফেসবুকে লিখেছেন, নতুন ইউনিফর্মের পেছনে শত কোটি টাকা খরচ না করে র্যাব, পুলিশ, আনসার সদস্যদের উন্নত প্রশিক্ষণ ও কাঠামোগত উন্নয়নে পর্যায়ক্রমে অর্থ বিনিয়োগ করুন। সংস্থাগুলোর সদস্যদের দুর্নীতি প্রতিরোধ এবং মানবিক পুলিশিং নিশ্চিত করতে বিশেষ অভ্যন্তরীণ ইউনিট গঠন করে জনসেবামূলক কার্যক্রমে তাদের নিয়োজিত করুন।
পোশাকে নয়, সেবা মান ও মনোবল বাড়াতে হবে
এ ব্যাপারে সাবেক আইজিপি নুরুল হুদা বলেন, পোশাক তো একাধিকবারই পরিবর্তন হয়েছে। কিন্তু খাসলত কি পরিবর্তন হয়েছে? হয়নি। আমার মনে হয় না, বাহ্যিক পরিবর্তনে সেবা মানে পরিবর্তন আসবে।
তিনি বলেন, পোশাকের ধরন বা রঙের সঙ্গে তার কার্যকলাপের কোনো প্রত্যক্ষ সম্পর্ক নেই। এ ব্যাপারে কোনো স্টাডি আমার জানা নেই। শ্রীলঙ্কায় এখনো পুলিশ খাকি পোশাক পরে, প্যান্ট-শার্ট পরে। আমার জানা মতে, তাদের সেবা মানে বা কার্যক্রমে কোনো সমস্যা হয়নি। তারাও বলেনি। কখনো তারা এটা বলেছে শুনিনি। শ্রীলঙ্কার মানুষ অনেক জানাশোনা পড়াশুনা করা লোক। তাদের বিদ্যার স্ট্যান্ডার্ড যেমন ভালো তেমনি পাবলিক সার্ভিসের স্ট্যান্ডার্ডও ভালো। তারা তো কখনো পোশাক পরিবর্তনের চিন্তা করেনি।
সাবেক এই আইজিপি বলেন, পুলিশ সংস্কার কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে সেখানে বেশি মনোযোগ দেওয়া উচিত। যেখানে মূল সমস্যা, সেখানে কাজ করা উচিত। মনোবল বৃদ্ধিসহ মৌলিক কাজে বিনিয়োগ ও মনোযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
পোশাক পরিবর্তন ‘কসমেটিকস চেঞ্জ’
পুলিশের পোশাকের বিষয়ে জানতে চাইলে প্রবাসে থাকা নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, পোশাক পরিবর্তন তো কসমেটিকস চেঞ্জ। এটাতে কিছু আসে যায় না। মৌলিক কি পরিবর্তন হচ্ছে সেটা জরুরি।
তিনি বলেন, পুলিশের ট্রেনিং, মানসিকতা, কোড অব কন্ডাক্ট এগুলো বেসিক ইস্যু। ইউনিফর্ম কোনো ইস্যু না। স্মার্ট ইউনিফর্মকে সবসময় স্বাগতম। সেটা হতে হবে মেড ইন বাংলাদেশ। তবে পোশাক বদলানোতে কখনো বাহিনীর গুণগত পরিবর্তন হয় না।
পোশাক বদলানো পরিবর্তনের প্রাথমিক পদক্ষেপ : নাজমুস সাকিব
তবে পুলিশের পোশাক পরিবর্তনের বিষয়টিকে ইতিবাচকভাবে দেখছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্রিমিনোলজি বিভাগের সহকারী অধ্যাপক এ বি এম নাজমুস সাকিব। তিনি বলেন, প্রথম যখন পুলিশের পোশাক পরিবর্তন নিয়ে আলোচনা হলো তখন আমি ব্যক্তিগতভাবে এটাকে সমর্থন করে পক্ষেই বলেছি। তার কিছু কারণও ছিল।
তিনি বলেন, ৫ আগস্টে পুলিশের বিতর্কিত ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে পুলিশের পোশাক সাধারণ জনগণের মধ্যে এক ধরনের ট্রমা তৈরি করেছে। কেউ ভিকটিম হলে আগের পোশাক পরিহিত কোনো পুলিশের কাছে যাবে কি না সেটা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। কারণ এটা তো মোটিভেশনাল ও মানসিকতার বিষয়। ট্রমার কারণে সেই ভিকটিম পুলিশের কাছে যাবে না। জনগণের মধ্যে আস্থা ফেরাতে এটা প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে নিলে বিষয়টি ইতিবাচক।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এই সহকারী অধ্যাপক এও বলেন, সংস্কার কমিশনও অনেক সুপারিশ করেছে। কিন্তু পোশাকের মতো বাহ্যিক পরিবর্তনে কি পুলিশের মানসিকতায় পরিবর্তন আসবে? এমন প্রশ্ন কিন্তু উঠছে। আসলে এটা তো কালচারের ব্যাপার। দীর্ঘসময়ের ব্যাপার, যেটা রাতারাতি সম্ভব নয়। এটার জন্য একটা ফুল প্যাকেজ থাকতে হবে, গাইডেন্স, সাইকোলজিক্যাল ট্রেনিং, সাইকোলজিক্যাল পেশেন্ট, সামাজিক অবস্থা ও মানসিকতাও পরিবর্তন জরুরি, যা সময় সাপেক্ষ।
পুলিশ, র্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, সবার মন-মানসিকতা পরিবর্তন করা জরুরি। সেজন্য পুলিশ, র্যাব ও আনসারের পোশাক পরিবর্তন করা হচ্ছে। পুলিশকে জনবান্ধব করতে হলে বাহিনীর প্রশিক্ষণেও পরিবর্তন আনতে হবে।
এ বি এম নাজমুস সাকিব আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, আমি মনে করি পরিবর্তন আসবে। কমিশন যেসব সুপারিশ করেছে সেগুলো বাস্তবায়নে পদক্ষেপ জরুরি। তাহলে পুলিশ জনমানুষের পুলিশে পরিণত হবে। সেখানে পোশাক পরিবর্তন প্রাথমিক ইতিবাচক পদক্ষেপ মনে করি। কিন্তু মাথায় রাখতে হবে, সুইচ টিপ দেওয়ার মতো পরিবর্তন আশা করা যাবে না, ধৈর্য ধারণ করতে হবে। সময় দিতে হবে। সহযোগিতা করতে হবে। বাহিনীর পাশাপাশি নিজেদের মানসিকতায়ও পরিবর্তন আনতে হবে।
আরও পড়ুন
৪৭তম বিসিএসে আবেদনের সময় বাড়লো এক মাস
‘আপনাদের মন বলতে কিছু নেই’
৭ দিনের মধ্যে প্রত্যাহার হবে রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা