নিজস্ব প্রতিবেদক:
করোনাভাইরাসের মহামারির পরিপ্রেক্ষিতে অর্থনীতিকে সচল রাখতে সরকার ঘোষিত প্রণোদনার আওতায় ঋণ বিতরণের গতি কমেছে। জানা গেছে, চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে দেয়া হয়েছে মাত্র ১৭ হাজার কোটি টাকা, যা মোট তহবিলের ২৬ শতাংশ। বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি প্রতিবেদন থেকে জানা গেছে, বড় শিল্প ও সেবা গ্রাহকদের জন্য ৩৩ হাজার কোটি টাকার তহবিল রয়েছে। সেখান থেকে গত বছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৯ হাজার কোটি টাকা। সুবিধা পেয়েছে ৯১৭টি শিল্প প্রতিষ্ঠান। অন্যদিকে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের জন্য ২০ হাজার কোটি টাকার তহবিল আছে। গত বছরের ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত বিতরণ হয়েছে ৫ হাজার কোটি টাকা। মূলত, প্রণোদনার আওতায় ঋণ বিতরণে ব্যাংকের অনীহা আছে। তার ওপর টাকার একটি অংশ আদায় হয়নি। তারপরও বাংলাদেশ ব্যাংক সময়মতো ব্যাংকের হিসাব থেকে পুনঃঅর্থায়নের টাকা কেটে নিচ্ছে।
এদিকে ঋণ বিতরণের ক্ষেত্রে রয়েছে বৈষম্যের অভিযোগও। করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে তৈরি হওয়া সংকটে টিকে থাকতে সরকার গ্রাহকের ঋণের সুদে ভর্তুকি দেওয়ার মাধ্যমে যে প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে, তাতে বড় শিল্প ঋণ নিতে ব্যাপক আগ্রহ দেখায় এবং তারা ঋণও পায়। কিন্তু তবে ছোট ও মাঝারি শিল্পের ক্ষেত্রে চিত্রটি বিপরীত। ছোট উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পাননি। আবার একটি অংশ প্রণোদনার ঋণ সম্পর্কে বিস্তারিত জানে না। কিছু প্রতিষ্ঠান বন্ধও হয়ে গেছে। এসব কারণে ছোট আকারের ঋণ বিতরণ হচ্ছে খুব কম।
সংশ্নিষ্টরা জানান, বড়রা যে করেই হোক টিকে থাকার চেষ্টায় কারখানা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে ছোট অনেক প্রতিষ্ঠান এরইমধ্যে বন্ধ হয়ে গেছে। আবার ঋণ নেওয়ার আগে পরিশোধ বিষয়ে বেশ উদ্বিগ্ন থাকে। বড় গ্রাহকদের অনেকের মধ্যে সে তুলনায় উদ্বেগ কম। আর বাংলাদেশে এ যাবৎ বিশেষ ছাড়ে ঋণ পুনর্গঠন ও পুনঃতফসিলের সুবিধার বেশিরভাগই বড় গ্রাহকরা পেয়েছেন। অন্যদিকে, বরাবরের মতো ব্যাংকারদের মধ্যেও ক্ষুদ্র গ্রাহকদের ঋণ দিতে অনীহা রয়েছে। এসএমই উদ্যোক্তাদের অনেকে ব্যাংকে গিয়ে ঋণ পাননি এমন অভিযোগ পেয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। ব্যাংকারদের অনেকে অবশ্য বলছেন, উপযুক্ত গ্রাহক না পাওয়ায় তারা ঋণ দিতে পারছেন না। বিশ্বব্যাংকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান আইএফসির সাম্প্রতিক এক জরিপে দেখা গেছে, ৬৩ শতাংশ এসএমই উদ্যোক্তা প্রণোদনার তহবিল বিষয়ে জানেন না। এ অবস্থায় গ্রাহকদের সচেতন করতে সিএমএসএমই তহবিল বিষয়ে বিভিন্ন পত্রিকায় বিজ্ঞাপনও দেয় বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংকের কর্মকর্তারা জানান, প্রণোদনার আওতায় ঋণ বিতরণের জন্য নিয়মকানুন শিথিল করা হয়েছে। বিশেষ করে ছোট উদ্যোক্তাদের ঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোকে নানা ছাড় দেওয়া হয়েছে। সব মিলিয়ে মোট ৫৯ হাজার ২৫০ কোটি টাকার পুনঃঅর্থায়ন তহবিল গঠন করা হয়েছে। এর পরও কোনো ব্যাংক যেন তারল্য সংকটে না পড়ে সে জন্য আমানতের বিপরীতে বাংলাদেশ ব্যাংকে নগদ জমা সংরক্ষণ বা সিআরআরের হার দেড় শতাংশ কমানো হয়েছে। অবশ্য প্রণোদনার টাকা আদায় হোক বা না হোক, ব্যাংকগুলোকে তা যথাসময়ে ফেরত দিতে হবে। কোনো ব্যাংক ফেরত দিতে ব্যর্থ হলে বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে রক্ষিত হিসাব থেকে কেটে সমন্বয় করা হবে। এসব কারণে অনেক ব্যাংক এ তহবিল থেকে ঋণ বিতরণে হয়তো অনীহা দেখাচ্ছে।
রাষ্ট্রীয় মালিকানার অগ্রণী ব্যাংকের চেয়ারম্যান ড. জায়েদ বখত বলেন, বড় ঋণের তুলনায় ছোট ঋণের চাহিদা কম। এর অন্যতম কারণ হতে পারে, অনেকে এই প্রণোদনার ঋণ বিষয়ে জানেন না কিংবা ব্যাংকের সঙ্গে তাদের আগে থেকে যোগাযোগ না থাকায় ব্যাংকও হয়তো সেভাবে সহযোগিতা করছে না। আবার অনেক ক্ষেত্রে জামানত দেওয়ার মতো অবস্থা না থাকায় ঋণ নিতে আসেন না। এসব কারণে ছোট উদ্যোক্তারা কম ঋণ পাচ্ছেন।
এদিকে, জেলা পর্যায়ের উদ্যোক্তারা বলছেন, প্রান্তিক উদ্যোক্তাদের অনেকেই ব্যবসা ছোট করে এনেছেন। পণ্য বিক্রি না হওয়ায় কেউ কেউ ব্যবসা গুটিয়ে ফেলেছেন। যাঁরা অনলাইন মাধ্যমে পণ্য বিক্রি করতে পারছেন, তাঁরা এই সময়ে ভালো করছেন। ঝরে পড়া উদ্যোক্তাদের ঘুরে দাঁড়াতে সরকারের বিশেষ উদ্যোগ প্রয়োজন। তাঁরা বলছেন, সিএমএসএমই খাতের জন্য বরাদ্দ করা ঋণ প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে পৌঁছাতে পারেনি। মূলত শহরকেন্দ্রিক উদ্যোক্তারা এই ঋণ পেয়েছেন। নথিপত্রের ঘাটতি থাকায় ব্যাংকগুলো তাঁদের ঋণ দিতে আগ্রহ দেখাচ্ছে না। করোনা সংক্রমণের দুই বছরের মাথায় জেলা পর্যায়ের ব্যবসায়ীরা প্রশ্ন তুলেছেন, প্রণোদনার টাকা গেল কোথায়? সরকার ব্যবসা-বাণিজ্য সচল রাখতে যে সোয়া লাখ কোটির বেশি টাকা প্রণোদনা হিসেবে ঘোষণা করেছে, তার ছিটেফোঁটাও তাঁরা পাননি। তাঁরা ক্ষোভের সঙ্গে বলছেন, প্রণোদনার টাকা কে কাকে দিল, কখন দিল তাঁরা কিছু জানেন না।
জানা যায়, করোনাভাইরাসের প্রকোপ শুরু হলে সরকার কম সুদের বিভিন্ন প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করে। এর মধ্যে ২০ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজ দেওয়া হয় সিএমএসএমই খাতের জন্য। এই ঋণের সুদহার ৯ শতাংশ হলেও গ্রাহকদের দিতে হচ্ছে ৪ শতাংশ। ৫ শতাংশ সুদ ভর্তুকি দিচ্ছে সরকার। এই তহবিলের প্রায় ১৫ হাজার কোটি টাকা ঋণ পেয়েছেন ৯৪ হাজার উদ্যোক্তা। এদিকে নিম্ন আয়ের পেশাজীবীদের জন্য কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে ৩ হাজার কোটি টাকা প্যাকেজ দিয়েছিল, তার প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা বিতরণ হয়েছে। ক্ষুদ্রঋণ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করা এই ঋণের সুদহারও ৯ শতাংশ। ঋণ পেয়েছেন প্রায় সাড়ে ৩ লাখ পেশাজীবী। তবে দেশে প্রান্তিক পর্যায়ের যে উদ্যোক্তা শ্রেণি রয়ে গেছে, তাদের বেশির ভাগ এখনো অর্থায়নের বাইরে রয়েছে। এজন্য বেসরকারি সংস্থার (এনজিও) মাধ্যমে ১০ হাজার কোটি টাকা ঋণ দেওয়ার উদ্যোগ নিয়েছিল সরকার, যা এখনো তা আলোর মুখ দেখেনি।
ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের বিষয়ে ইস্টার্ণ ব্যাংকের উপব্যবস্থাপনা পরিচালক খোরশেদ আলম বলেন, করোনায় ছোট-বড় সব উদ্যোক্তাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। বড় উদ্যোক্তারা যেভাবে ঘুরে দাঁড়ানোর সুযোগ পাচ্ছেন, ছোটরা সেভাবে পারছেন না। ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার মতো ছোট গ্রাহকই খুঁজে পাচ্ছে না। আবার বিক্রি না থাকলে ঋণ নিয়ে কী হবে, এজন্য অনেকে ব্যাংকে আসছেন না। এরপরও ব্যাংকগুলোর প্রণোদনার ঋণের টাকার যথাযথভাবে বিতরণ করেছে। এখনো ঋণ বিতরণ চলছে। অন্যদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের এক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ছোট উদ্যোক্তাদের মাঝে ঋণ বিতরণের জন্য নানাভাবে চাপ তৈরি করা হচ্ছে। পিছিয়ে থাকা ব্যাংকগুলোকে কারণ দর্শানোর নোটিশ, বৈঠকসহ নানাভাবে বলা হয়েছে। এর পরও যথাসময়ে ঋণ বিতরণ শেষ হলে ব্যাংকগুলোকে আরও কঠোর বার্তা দেওয়া হবে।
আরও পড়ুন
এলো ফার্স্টলুক, কবে মুক্তি পাবে রানির নতুন সিনেমা
গরমে কিশমিশ ভেজানো পানি পান করা কেন জরুরি?
কর্মস্থলে ‘তুই-তুমি’ সম্বোধন বন্ধের সুপারিশ কমিশনের