নিজস্ব প্রতিবেদক:
ঢাকা ও আশপাশের জেলার বায়ুদূষণ রোধে অবৈধ ইটভাটা বন্ধে সম্প্রতি এক রুল শুনানিতে হাইকোর্ট বলেছেন, ঢাকার নদীগুলো দূষিত, বাতাস দূষিত এবং ঢাকা খুব বাজে অবস্থায় আছে; ঢাকার পরিবেশ নিয়ে শঙ্কিত। আদালত বলেন, দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে শিল্পায়নের অবশ্যই প্রয়োজন আছে, তবে সেটা হতে হবে পরিবেশকে রক্ষা করে। দেশে অটিজম কী পরিমাণ বাড়ছে, সরকার কি তার হিসাব রাখে? এক্ষেত্রে পরিবেশ দূষণের প্রভাব রয়েছে। অবৈধ ইটভাটা বন্ধে আদেশ বাস্তবায়ন না করা প্রসঙ্গে হাইকোর্ট বলেন, আমরা সাজা দিতে পারি। কিন্তু সাজা দিয়েই কি সব হয়? আমরা বিব্রতবোধ করি যে, কতবার এসব নিয়ে ডিরেকশন দেব? সর্বোচ্চ আদালত থেকে এমন উদ্বেগ, নির্দেশনা বিভিন্ন সময়ে এলেও পরিস্থিতি খুব একটা বদলায় না।
এছাড়া রাজধানীর বায়ুদূষণ যে বিপজ্জনক মাত্রায় রয়েছে, তা বিভিন্ন গবেষণায় একাধিকবার উঠে এসেছে। এরপরও তা নিরসনে কার্যত কোনো উদ্যোগ চোখে পড়ে না। চরম অস্বাস্থ্যকর বায়ুর মধ্যে শ্বাস নিয়েই জীবন কাটাচ্ছে মেগা সিটির মানুষ। ভুগছে অ্যাজমা, অ্যালার্জি, বমি, শ্বাসকষ্টসহ নানা ফুসফুসজনিত রোগে। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে প্রকাশিত বায়ুদূষণবিষয়ক এক বৈশ্বিক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছিল, বায়ুদূষণে এদেশে মানুষের গড় আয়ু কমে যাচ্ছে। কারণ ১৯৯৮ সালের তুলনায় বর্তমানে বায়ুদূষণ ৬৩ শতাংশ বেড়েছে। এদিকে সদ্য সমাপ্ত ২০২৩ সাল ছিল আট বছরের মধ্যে সবচেয়ে দূষিত বায়ুর বছর। এর পেছনে অন্যতম দায় ধুলার।
এ দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তরসহ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছে। তবে সেগুলো দূষণ রোধ করতে পারছে না। ফলে দূষিত শহরের তালিকায় প্রায়ই শীর্ষস্থানে থাকছে রাজধানী ঢাকা। পরিবেশবাদীরা বলছেন, ধুলার দূষণে রোগবালাই থেকে শুরু করে পোশাক-পরিচ্ছদ, আসবাবপত্র, বাসাবাড়ি, খাবার-দাবার সবকিছুতেই ভোগান্তির শিকার হচ্ছেন নগরবাসী। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, নগরের বায়ুদূষণ রোধে সিটি করপোরেশন, পরিবেশ অধিদপ্তর ও সরকারের মন্ত্রণালয়গুলোর সমন্বয়হীনতা রয়েছে। বিশেষ করে ধুলাদূষণের প্রধান উৎস নির্মাণকাজ ও রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট নীতিমালা থাকলেও সেগুলো মানছে না সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো। এ ছাড়া দূষণ রোধে সিটি করপোরেশন ও পরিবেশ অধিদপ্তরের সমন্বয় নেই। ফলে শহরে মারাত্মক আকার ধারণ করছে ধুলা দূষণ।
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী বলেন, আন্তর্জাতিক গবেষণায় দেখা গেছে বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে শুধু বায়ুদূষণের কারণে মানুষের গড় আয়ু সাত বছর কমে যাচ্ছে। আমরা দেখছি শীতকালে বাতাসের আর্দ্রতা কমে গেলে ঢাকাসহ দেশের প্রায় সব নগরীতে বায়ুদূষণের মাত্রা অনেক বেড়ে যায়। বায়ুদূষণের কারণে হাঁচি, কাশি, সর্দি, শ্বাসের টান বা হাঁপানি, অ্যালার্জিক কফ, অ্যালার্জিক অ্যাজমা, নিউমোনিয়া, যক্ষ্মা, ফুসফুস ক্যান্সারের মতো রোগগুলো হয়। তিনি আরও বলেন, বায়ুতে ভাসমান ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র বস্তুকণা (পিএম ২.৫) শ্বাসতন্ত্র দিয়ে রক্তস্রোতে মিশে গিয়ে লিভার, কিডনিসহ বিপাক প্রক্রিয়ার সঙ্গে যুক্ত অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ক্ষতি করে। ফলে কিডনি বিকল, লিভার বিকলসহ নানা জাতীয় ক্যান্সার বাড়ছে।
এক বায়ুদূষণের কারণে সংক্রামক-অসংক্রামক দুই ধরনের রোগই বাড়ছে। নগর পরিকল্পনাবিদ অধ্যাপক ড. আদিল মুহাম্মদ খান বলেন, বায়ুর মানের কারণে সৃষ্ট স্বাস্থ্যঝুঁকি সরকারি পর্যায়ে আমলে নেওয়া হচ্ছে না। কিন্তু এর স্বাস্থ্যক্ষতি ও অর্থনৈতিক ক্ষতি অনেক বেশি। দূষণ নিয়ন্ত্রণে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো এক দমই অকার্যকর। দূষণ বন্ধে আইন আছে, কিন্তু বাস্তবায়ন নেই। যতদিন জনস্বাস্থ্যের জন্য যারা ঝুঁকি তৈরি করছে তাদের শাস্তির আওতায় আনা না যাবে, ততদিন দূষণ বন্ধ হবে না।
দূষণবিষয়ক গবেষণা প্রতিষ্ঠান ক্যাপসের একটি গবেষণা সূত্রে জানা যায়, ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য সমন্বয়হীন রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি ও নির্মাণকাজ ৩০ শতাংশ দায়ী। ঢাকার বায়ুদূষণে শিল্পায়নের প্রভাব ও আশপাশের ইটভাটার পাশাপাশি নির্মাণ স্থান হলো ধুলা দূষণের প্রধান উৎস। এ ছাড়া নির্মাণসামগ্রী আনা-নেওয়ার সময় বড় বড় মালবাহী গাড়িতে ছাউনি না থাকায় ছড়াচ্ছে ধুলা। ক্যাপসের চেয়ারম্যান ও স্ট্যামফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেন, ঢাকা শহরের বায়ুদূষণের কয়েকটি কারণ রয়েছে। প্রথম সর্বোচ্চ উৎস নির্মাণকাজ, দ্বিতীয় কারণ হলো শিল্প কারখানা, তৃতীয় সর্বোচ্চ হলো ফিটনেসবিহীন যানবাহন। বর্তমানে শঙ্কা হলো নির্মাণবিধি না মেনে বড় বড় মেগা প্রজেক্ট, রাস্তা কাটাকাটির কারণে ধুলাবালি বেশি হচ্ছে।
সিটি করপোরেশন, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, পরিবেশ অধিদপ্তর যদি নজরদারি রাখতো তাহলে এ উৎসগুলো থেকে দূষণ হতো না। রাজধানীতে সারা বছরই ওয়াসা, সিটি করপোরেশনসহ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের ভবন নির্মাণ ও রাস্তা মেরামতের কাজ চলে। পাশাপাশি গত কয়েক বছরে সরকারের বেশ কয়েকটি মেগা প্রকল্পসহ বিভিন্ন উন্নয়নমূলক কাজ চলমান। এসব নির্মাণ কাজের কারণে সবচেয়ে বেশি ধুলা দূষণ হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তবে যে কোনো ধরনের নির্মাণকাজ করার সময় বায়ুদূষণ রোধে পরিবেশ অধিদপ্তরের সুনির্দিষ্ট কিছু নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে এসব নিয়ম পালন করতে তেমন দেখা যায় না। পরিবেশ অধিদপ্তরের নিয়ম অনুযায়ী, রাস্তা ও ভবন নির্মাণ বা মেরামতের সময় ধুলাবালি যেন বাতাসের সঙ্গে মিশে না যায়, সেজন্য নির্মাণ স্থানে যথাযথ ছাউনি বা ঢেকে রাখার নির্দেশনা রয়েছে।
একই সঙ্গে ভেতর ও বাইরে মাটি, বালি, রড, সিমেন্ট ইত্যাদি নির্মাণসামগ্রী যথাযথভাবে ঢেকে রাখা এবং দিনে কমপক্ষে দুবার পানি ছিটানোর কথা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবে এসব নির্দেশনা অনুসরণ না করায় রাজধানীতে ধুলার পরিমাণ বাড়ছে। ২০২০ সালের জানুয়ারি মাসে হাইকোর্ট বায়ুদূষণ নিয়ন্ত্রণে যে ৯ দফা নির্দেশনা দিয়েছিলেন, তার মধ্যে নির্মাণসামগ্রী ঢেকে রাখা, পানি ছিটানো এবং খোঁড়াখুঁড়ির ক্ষেত্রে দরপত্রের শর্ত মানার বিষয়গুলো ছিল। কিন্তু সেগুলো মানা হয় না। মানাতে তেমন কোনো পদক্ষেপও দেখা যায় না। এদিকে দূষণ রোধে ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশন পানি ছিটানোর স্পেশাল ক্র্যাশ প্রোগ্রাম চালু করলেও সেটি ফলপ্রসূ হচ্ছে না। এখানকার বাসিন্দারা বলছেন, সব এলাকায় পানি ছিটানো হয় না। যে পরিমাণ পানি ছিটানো হয় তা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই সামান্য।
পরিকল্পনাবিদ আদিল মোহাম্মদ খান বলেন, বায়ুদূষণ আমাদের অপরিকল্পিত উন্নয়নের একটি বাই-প্রোডাক্ট। নগর পরিকল্পনায় যত ধরনের উন্নয়নমূলক কর্মকা- আছে তার সব প্রভাব বায়ুদূষণের ওপর পড়ছে। সরকারি-বেসরকারিভাবে যে অবকাঠামো নির্মাণ চলছে, কোথাও স্ট্যান্ডার্ড মানা হচ্ছে না। ঢাকা ও আশপাশে যে শিল্পায়ন হচ্ছে, এর ফলে বায়ুদূষণ বেশি হচ্ছে। কিন্তু এর বিপরীতে বায়ুদূষণ কমানোর জন্য একটা ব্যালেন্সিং ফ্যাক্টর হিসেবে শহরে যদি গাছপালা থাকে, সবুজায়ন হয়, তাহলে একটা ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করে। কিন্তু মাত্রারিক্ত নগরায়নের কারণে এটিকে আমরা ধ্বংস করে দিয়েছি। এ পরিকল্পনাবিদ বলেন, যাই হচ্ছে, সবকিছুর জন্য আমাদের নীতিমালা আছে, আইন আছে। কিন্তু এগুলো প্রতিফলনের জন্য কোনো মনিটরিং হচ্ছে না। এ ক্ষেত্রে পরিবেশ অধিদপ্তর, সিটি করপোরেশন বা সংশ্লিষ্টরা শুধু নির্দেশনা মানছে না বলে দায় এড়াচ্ছে। এসব নির্দেশনা মানাতে আমাদের রাষ্ট্র ব্যর্থ। এ প্রতিষ্ঠানগুলোর সক্ষমতাও নেই। যারাই কনস্ট্রাকশনের কাজ করছে, রাস্তা খোঁড়াখুঁড়ি করছে, নীতিমালা না মানলে শাস্তির ব্যবস্থা করতে হবে। প্রশাসনের কঠোর পদক্ষেপ ছাড়া নগরবাসীর এ ভোগান্তি কমানো সম্ভব হবে না।
এর আগে ২০১৯ সালের মার্চে পরিবেশ অধিদপ্তর ও বিশ্বব্যাংকের এক প্রতিবেদনেও উল্লেখ করা হয়েছিল, ঢাকার বায়ুদূষণের তিনটি প্রধান উৎস হলো-ইটভাটা, যানবাহনের ধোঁয়া ও নির্মাণ সাইটের ধুলা। বস্তুত, একসময় ঢাকার বায়ুদূষণের জন্য দায়ী করা হতো ইটভাটার ধোঁয়াকে। পরে সে জায়গা দখল করে নেয় যানবাহন ও শিল্পকলকারখানার ধোঁয়া। গত কয়েক বছর ধরে বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প ও ছোট-বড় আবাসন প্রকল্পের নির্মাণযজ্ঞ এ দূষণের মাত্রা আরও বাড়িয়েছে। পরিবেশ সচেতনরা বলেছেন, দূষণ কমাতে রাজধানীতে ব্যক্তিগত গাড়ি ব্যবহারে নিরুৎসাহিত করা দরকার। যদিও উন্নত গণপরিবহণব্যবস্থা গড়ে না উঠলে ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমবে না। নগরীতে এখনো আধুনিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা গড়ে ওঠেনি। এ কারণেও দূষণ বাড়ছে। এ ছাড়া অবকাঠামোগত সংস্কার ও নির্মাণের ক্ষেত্রেও বায়ুদূষণের বিষয়টি সরকারকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে।
আরও পড়ুন
শীতে রোগমুক্ত জীবন পেতে সাহায্য করবে যেসব ভেষজ
অন্যতম দর্শনীয় স্থান মহামায়া লেক
টেলিযোগাযোগ খাতে অস্থিরতার শঙ্কা, বাড়বে ইন্টারনেটের দাম