December 11, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, December 10th, 2025, 6:48 pm

বর্ধমান হাউস : কাজী নজরুল ইসলাম ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ

 

শাহ্ মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান:

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ ও ‘শিখা’ অভ্যুদয়ের ১০০ বছর পূর্তি হচ্ছে আগামী বছরের ১৯শে জানুয়ারি। ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হয় এই প্রতিষ্ঠানের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র কার্যক্রমের প্রাসঙ্গিকতা আজও বিদ্যমান। এ কথা বার বার উচ্চারিত হয় যে, ঐতিহ্যবাহী বর্ধমান হাউস, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং বর্তমান স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ প্রভৃতি প্রত্যয় অভিন্ন, একটির সঙ্গে আরেকটি ওতপ্রোতভাবে যুক্ত। অর্থাৎ একটি ছাড়া অপরটি খণ্ডিত, অসম্পূর্ণ।
আমরা জানি বঙ্গভঙ্গের (১৯০৫) সময়ে পূর্ববঙ্গ ও আসাম প্রদেশের সরকারি বা রাষ্ট্রীয় বিভিন্ন প্রয়োজনে ব্যবহারের জন্য তখন যেসব ভবন নির্মিত হয় সেসব ভবনের একটি ভবন ‘বর্ধমান হাউস’। ১৯৪৭ পর্যন্ত মূলত এটি উচ্চ পদস্থ সরকারি কর্মকর্তাদের অতিথিশালা, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকদের বাসভবন, ছাত্রবাসসহ নানা কাজে ব্যবহৃত হতো। ১৯২৬ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হলের প্রভোস্ট ও ইতিহাস বিভাগের অধ্যাপক ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার বর্ধমান হাউসে বসবাসকালে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তাঁর আতিথ্য গ্রহণ করেছেন। ১৯৪৭ এর ১৪ই আগস্ট থেকে পূর্ব বাংলা সরকারের প্রধানমন্ত্রীর বাসভবন, কখনো পূর্ব পাকিস্তান সরকারের মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন রূপে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন চলাকালে এ ভবন তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রীর বাসভবন হওয়ায় এ ভবনের প্রতি জনারোষ পতিত হয় এবং এ ভবনকে বাংলা ভাষার গবেষণাগারে রূপান্তরিত করার দাবি প্রবল হয়। ভাষা শহিদদের রক্তের ইতিহাসের পরিপ্রেক্ষিত, সাধারণ মানুষের দাবি, রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতি প্রভৃতি কারণে এই ভবনে ১৯৫৫ সালে ৩রা ডিসেম্বর বাংলা একাডেমির অফিসীয় কার্যক্রম শুরু হয়েছিল।

বর্ধমান হাউসে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের একটি তাৎপর্যপূর্ণ অধ্যায় রয়েছে। বাংলার তারুণ্যের প্রতীক কাজী নজরুল তার উদ্দাম যৌবনের দিনগুলিতে একাধিকবার বর্ধমান হাউসে এসেছেন। এদেশের সাংস্কৃতিক ইতিহাসের প্রেরণাদায়ী মুসলিম সাহিত্য সমাজের একাধিক বার্ষিক সম্মেলনে আমন্ত্রিত অতিথি হিসেবে তিনি ঢাকায় এলে তখনও তার থাকার ব্যবস্থা হয় এই বর্ধমান হাউসে। এ সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে এসে কাজী নজরুল এমন সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলেন যা তার জীবন ও সাহিত্যে গভীর রেখাপাত করে। কবি নজরুল বর্ধমান হাউসে থাকাকালীন রমনায় বসে থাকতে পছন্দ করতেন। এখানে বসে তিনি কবিতা ও গানের সুর নিয়ে ভাবতেন। ‘শিউলিমালা’ (১৯৩১) গল্পগ্রন্থ ও ‘চক্রবাক’ (১৯২৯) কাব্যগ্রন্থে কবি যে চিত্র ফুটিয়ে তুলেছেন তা বর্ধমান হাউসে অবস্থানকালীনেরই প্রতিচ্ছবি। এদেশের মাটি, মানুষের প্রতি ছিল তার অকৃত্রিম ভালোবাসা। সেই সময় থেকেই তার কবিতা, গান ও বক্তৃতায় এদেশের মানুষকে জাগিয়ে তুলেছেন তিনি। ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি প্রতিষ্ঠিত মুসলিম সাহিত্য সমাজের বার্ষিক সম্মেলনে কাজী নজরুল ছিলেন অতিথি এবং ১৯২৭ সালে এই কার্যক্রমের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা কাজী নজরুলের গান দিয়ে শুরু হয়েছিল। আজকের এই স্বাধীন ও সার্বভৌম রাষ্ট্র বাংলাদেশ শতবর্ষের রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনেরই ফসল। কাজী নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউস থেকে বাংলা একাডেমি এক বিরাট ইতিহাস। এই ইতিহাসের সঙ্গে জড়িয়ে আছে বাংলা ভাষাভাষী মানুষের স্বাধিকার আন্দোলনের চেতনা, একুশের রক্তস্রোত দ্রোহ, একুশের সাফল্য ও মহান মুক্তিযুদ্ধের বিজয়গাথা। কালের পরিক্রমায় বর্ধমান হাউসকে কেন্দ্র করে বাংলা একাডেমি, অমর একুশে বইমেলা ও একুশের অনুষ্ঠানমালা, নজরুল মঞ্চ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সঙ্গত কারণে বাংলাদেশের ইতিহাস বাস্তবতার পটভূমিতে বর্ধমান হাউস ও কাজী নজরুল ও মুসলিম সাহিত্য সমাজ অবিচ্ছেদ্য প্রত্যয়। পূর্ববাংলার বাংলা ভাষাভাষী মুসলমান সমাজের শত বছর আগের এই সংগঠন জাতির অগ্রগতির ইতিহাস বিনির্মাণে যথেষ্ট অবদান রেখেছে। বর্তমান প্রবন্ধটি ঐতিহ্যবাহী বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতি ও মুসলিম সাহিত্য সমাজের বিভিন্ন বিষয় তুলে ধরবার একটি ক্ষুদ্র প্রয়াস করেছি মাত্র।

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সঙ্গে বাংলাদেশের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম জড়িয়ে আছেন গভীর একাত্মতায়। কাজী নজরুল বর্ধমান হাউসে আমন্ত্রিত বরেণ্য অতিথি হিসেবেও একাধিকবার এসেছেন। এ বিষয়ে বর্ধমান হাউসের নিচতলার দেয়ালে ৩রা ডিসেম্বর ২০০৭ তারিখে স্থাপিত এক প্রস্তরখণ্ডে বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুলের আগমনের তথ্য রয়েছে। তারুণ্যদীপ্ত কাজী নজরুলের খ্যাতি তখন সারা ভারতবর্ষ জুড়ে। বর্ধমান হাউসে তার আগমন বাংলাদেশের ইতিহাসে একটি ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যময় ঘটনা। পক্ষান্তরে, বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসেও তার ভূমিকা অবিভাজ্য ও অনিবার্য। তার লেখায় বাংলা ভাষাভাষীদের জাতিসত্তার বিভিন্ন উপাদান ব্যাপকভাবে মূর্ত হয়ে উঠেছে যা অন্য কোনো লেখকের লেখায় তেমন ঘটেনি। বাংলাদেশের স্বাধীনতার কথা বলতে গেলে কাজী নজরুলের কথা বলতে হয়। যে স্বাধীনতা ১৯৭১ সালের ১৬ই ডিসেম্বর এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধে অসংখ্য শহিদ ও মা-বোনের নির্যাতনের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে।
১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধে কাজী নজরুলের কবিতা ও গান যুদ্ধাস্ত্রের মতো ব্যবহৃত হয়েছে। স্বাধীনতা সংগ্রামের দিনগুলোতে কাজী নজরুলের কবিতা ও গান জাতিকে বিজয়ের স্বপ্ন দেখিয়েছে। তার লেখা ‘কারার ঐ লৌহ কপাট’, ‘খাঁটি সোনার চেয়ে খাঁটি’, ‘তোরা সব জয়ধ্বনি কর’, ‘নম নম বাংলাদেশ মম’, ‘চল্ চল্ চল্’ প্রভৃতি গান ও ‘পূর্ববঙ্গ’সহ অনেক কবিতা মুক্তি সংগ্রামে এদেশের মানুষকে নবজাগরণের প্রেরণা জুগিয়েছে। এ কারণে বাংলাদেশ রাষ্ট্রগঠনের সাথে কাজী নজরুলের নাম ওতপ্রোতভাবে যুক্ত।

বিশ শতকের ত্রিশের দশকে ১৯২৬ সালের ১৯শে জানুয়ারি ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ প্রতিষ্ঠিত হলো। ১৯২৭ সালে প্রকাশিত হলো তার মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’। ১৯২৮ সালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে ঢাকায় এসে কাজী নজরুল প্রায় আড়াই সপ্তাহ ছিলেন। তখন প্রথমদিকে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি ও বাণিজ্য বিভাগের অধ্যাপক আবুল হুসেনের বাসায় উঠলেও পরে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হলের [আওতাধীন] বর্ধমান হাউস ছাত্রাবাসের হাউস টিউটর তার ঘনিষ্ঠ বন্ধু কাজী মোতাহার হোসেনের বাসা বর্ধমান হাউসের দুতলায় ওঠেন। এরপর দু-তিন বছরে কমাস পরপর বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুলের কয়েকবারে মাসাধিককাল অবস্থানের ঐতিহাসিক ঘটনা শুধু কবি নজরুলের জীবনেই নয়, তাঁর সাহিত্যকর্মে বিশেষ করে তাঁর কবিতা, গান, গল্গ ও চিঠিপত্রে যেমন ব্যাপক প্রভাব ফেলেছে তেমনি প্রভাব পড়েছে বাংলাদেশের শিল্পসাহিত্য ও সমকালীন সমাজ-চেতনায়। কবি নজরুল বর্ধমান হাউসের ঠিকানায় কাজী মোতাহার হোসেনকে ‘প্রিয় মোতিহার’ সম্বোধনে বেশ কয়েকটি পত্র ও ‘দাড়ি বিলাপ’ কবিতা লিখেছিলেন।

মুসলিম সাহিত্য সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার প্রথম সংখ্যা কাজী নজরুলের গান দিয়ে শুরু হয়েছিল। ‘শিখা’-সংশ্লিষ্টদের আমন্ত্রণে বর্ধমান হাউসে এসে তিনি তৎকালীন স্থবির মুসলমান সমাজে প্রজ্বলিত মশাল হাতে নিয়ে পথের সন্ধান দিয়েছিলেন যা আজ অবধি প্রজ্বলিত শিখা হয়ে সারা দেশময় জ্বলছে। ‘শিখা’ পত্রিকার টাইটেল পৃষ্ঠায় ‘মুখবাণী’ (Motto) হিসেবে লেখা থাকত : ‘জ্ঞান যেখানে সীমাবদ্ধ, বুদ্ধি সেখানে আড়ষ্ট, মুক্তি সেখানে অসম্ভব।’ এটিই ছিল তাঁদের জীবনদর্শন। এই জীবনদর্শনের সঙ্গে কাজী নজরুলের আদর্শের মিল ছিল। মুসলিম সাহিত্য সমাজের সদস্যরা ছিলেন অসম্প্রদায়িক এবং যুক্তিবাদী। তাঁরা নিজেদের সময়ের চাইতে অগ্রগামী চিন্তা ও বিচার করতেন। তারা সাহিত্য শব্দটিকে বিস্তৃত অর্থে শিল্পচর্চা, নারী শিক্ষা, অর্থনীতি ইত্যাদি ক্ষেত্রে মুসলমানদের দুষ্টিভঙ্গি বদলাতে উৎসাহিত করতেন। পরবর্তীকালে ‘শিখা’-সংশ্লিষ্ট আবুল হুসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, আবদুল কাদির, আবুল ফজল, মোহাম্মদ কাসেম, আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্নসহ প্রায় সকলেই মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র সাথে কাজী নজরুলের যুক্ততা সম্পর্কে লিখেছেন। ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এগারো বছর পর অর্থাৎ ১৯৩৬ সালে নিষ্ক্রিয় হয়ে গেলেও বুদ্ধির মুক্তির চিন্তার আন্দোলন এক সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলেছিল এবং এ সংগঠনের অন্তর্যাত্রীরা আজীবন সেই ধারণাটাই পোষণ করেছেন। সংগত কারণে বাংলাদেশের ইতিহাস বাস্তবতার পটভূমিতে বর্ধমান হাউস ও কবি কাজী নজরুল এ দুটি অবিচ্ছেদ্য প্রত্যয়। এই প্রত্যয় সামাজিক-সাংস্কৃতিক জাগরণ ও স্বাধীন বাংলাদেশ বিনির্মাণে ভূমিকা রেখেছে। উত্তরকালে আমরা আরও দেখতে পাই যে, বর্ধমান হাউসকে কেন্দ্র করেই মহান একুশের রক্তস্নাত দ্রোহ এবং এরই পরবর্তীকালে বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমির প্রতিষ্ঠা ও বাংলাদেশের স্বাধিকার আন্দোলনের ফলে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্র সৃষ্টি—এই প্রত্যয়গুলো যেন অভিন্নসূত্রে গ্রথিত। বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসের সঙ্গে জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের এই ঐতিহাসিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তাঁর স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধার নিদর্শনস্বরূপ একাডেমির বর্ধমান হাউসে প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ এবং একাডেমির চত্বরে ‘নজরুল মঞ্চ’ ও অন্যান্য স্মারক রয়েছে।

বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউস কাজী নজরুলের স্মৃতির ধারক ও বাহক। বর্ধমান হাউসে ও এর প্রাঙ্গণে কবি নজরুলের স্মৃতি ধরে রাখার জন্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে কয়েকটি স্থাপনা। কাজী নজরুলের স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ বর্ধমান হাউসে ১৯৭৮ সালের ২৯শে আগস্ট ‘নজরুল স্মৃতিকক্ষ’ উদ্বোধন এবং ২০০৩ সালের ২৫শে জুন বর্ধমান হাউসের সম্মুখস্থ বটতলায় ‘নজরুল চত্বর’ ও ‘নজরুল মঞ্চ’ প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। নজরুল মঞ্চের ওপর নজরুল ভাস্কর্যটি তৈরি করেছেন ভাস্কর হামিদুজ্জামান। ২০২১ সালে কাজী নজরুলের রচিত ‘বিদ্রোহী’ কবিতার শতবর্ষ উদযাপন উপলক্ষ্যে এই মঞ্চে কবিতাটির পূর্ণাঙ্গ রূপ দৃষ্টিনন্দনভাবে ভাস্কর জাহানারা পারভীনের কারুকার্যে মার্বেল পাথরে শিলালিপিতে খোদিত আকারে প্রতিস্থাপিত হয়েছে। তাছাড়া ১৯৭৬ সাল থেকে বর্তমান অবধি একাডেমির সম্মুখস্থ সড়কের নাম কাজী নজরুল ইসলাম এভিনিউ এবং বাংলা একাডেমির প্রধান ও একমাত্র কার্যালয় এই সড়কেই অবস্থিত। বাংলা একাডেমি কাজী নজরুলের জন্মদিন ও মৃত্যুবার্ষিকী অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে পালন করে আসছে। বাংলা একাডেমি ১৯৬১ সালের ২৫শে মে সপ্তাহব্যাপী নজরুল-জয়ন্তী উৎসব আয়োজন করেছিল। এই আয়োজনে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানসহ বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের প্রকাশিত সমস্ত গ্রন্থ, সম্পাদিত পত্রিকা, এগুলোর প্রথম সংস্করণ, নিজের লেখা পাণ্ডুলিপি, চিঠিপত্র, কবির বিভিন্ন বয়সের আলোকচিত্র, কবি ও তাঁর গ্রন্থ সম্পর্কে লিখিত পুস্তক ও প্রবন্ধাদি প্রদর্শন করা হয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে একাডেমিতে প্রতি বছর কাজী নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠান পালিত হয়ে আসছে। নজরুল জয়ন্তী অনুষ্ঠানে কোনো বিশেষজ্ঞ বা পণ্ডিত ব্যক্তির দ্বারা কাজী নজরুলবিষয়ক প্রবন্ধ রচনা ও পাঠ করা হয়। এছাড়া কয়েক বছর ধরে বাংলা একাডেমি ‘নজরুল পুরস্কার’ প্রদান করে আসছে।
কাজী নজরুলের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা অর্পণেরই ধারাবাহিকতায় বাংলা একাডেমি কাজী নজরুলবিষয়ক ও তাঁর মৌলিক গ্রন্থ প্রকাশের অন্যতম পথিকৃতের দাবিদার। বর্তমানে একাডেমি থেকে বারোটি খণ্ডের ‘নজরুল-রচনাবলী’ নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ ছাড়াও নজরুল-সংগীত সংকলন গ্রন্থ, নজরুল-বিষয়ক অনেক গবেষণা-গ্রন্থ, নজরুল সাহিত্য-সমালোচনামূলক গ্রন্থ, নজরুল-কাব্যের অনুবাদ-গ্রন্থ এমনকি নজরুল-সংগীত স্বরলিপি গ্রন্থ প্রভৃতি বিষয়ে প্রায় দেড় শতাধিক গ্রন্থ প্রকাশ করেছে। উল্লিখিত কাজগুলোর মধ্যে ‘নজরুল রচনাবলী’র কাজ বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুলের স্মৃতিবিজড়িত কক্ষে সম্পন্ন করা হয়। মূলত বাংলা একাডেমি থেকেই প্রতিষ্ঠানিকভাবে নজরুল-চর্চার ব্যাপকতররূপে শুরু হয়। এক্ষেত্রে কবি আবদুল কাদির (১৯০৬-১৯৮৪) পথিকৃৎ ভূমিকা পালন করেন। তৎকালীন কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড (সেন্ট্রাল বোর্ড ফর ডেভেলপমেন্ট অব বেঙ্গলি)-এর উদ্যোগে এবং প্রখ্যাত নজরুল গবেষক আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় ‘নজরুল-রচনাবলী’ প্রকাশনার ব্যবস্থা গ্রহণ করা একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, যুগোপযোগী ও প্রশংসনীয় পদক্ষেপ ছিল। পাকিস্তান আমলে কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে ‘নজরুল-রচনাবলী’র ৩টি খণ্ড (১ম খণ্ড, ১৯৬৬; ২য় খণ্ড, ১৯৬৭, ৩য় খণ্ড, ১৯৭০) প্রকাশিত হয়।

স্বাধীনতা-পরবর্তীকালে ১৯৭২ সালে বাংলা একাডেমির সঙ্গে ‘কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড’ একীভূত হয়। আবদুল কাদিরের সম্পাদনায় কেন্দ্রীয় বাংলা উন্নয়ন বোর্ড থেকে ৩টি খণ্ড এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জন পরবর্তীকালে বাংলা একাডেমি থেকে কয়েক বছরের মধ্যেই নজরুল-রচনাবলী ৪র্থ খণ্ড (১৯৭৭), ৫ম খণ্ড, প্রথমার্ধ (জুন ১৯৮৪); ৫ম খণ্ড, দ্বিতীয়ার্ধ (ডিসেম্বর ১৯৮৪) মোট এই ৫টি খণ্ড তাঁর সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এই ৫টি খণ্ড প্রকাশিত না হলে নজরুল-চর্চা ও গবেষণার ব্যাপক ক্ষতির সম্মুখীন হতো। মোটকথা, এ পাঁচ খণ্ড প্রকাশের মধ্য দিয়ে প্রাথমিকভাবে সমগ্র কাজী নজরুল-রচনা সংকলন সম্পূর্ণ হয়। অতঃপর দীর্ঘ বছর কাজী নজরুলের রচনাবলি মুদ্রিত না হওয়ায় বাংলা একাডেমি পূর্ণাঙ্গভাবে ‘নজরুল-রচনাবলী’ পুনঃপ্রকাশের দায়িত্ব গ্রহণ করে। এই পরিপ্রেক্ষিতে বাংলা একাডেমি ২০০৫ সালের অক্টোবরে নজরুল-জন্মশতবর্ষ সংস্করণ প্রকাশের উদ্যোগ গ্রহণ করে। এই উপলক্ষ্যে নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলামকে সভাপতি করে তার তত্ত্বাবধান ও দিকনির্দেশনায় ছয় সদস্যের সম্পাদনা-পরিষদ গঠন করা হয়েছিল। এই সম্পাদনা-পরিষদ বাংলা একাডেমির কাজী নজরুলের স্মৃতিধন্য কক্ষে কাজটি সম্পন্ন করেছে। ‘নজরুল-রচনাবলী’ নজরুল-জন্মশতবর্ষ সংস্করণ ২০০৬ সাল থেকে পর্যায়ক্রমে বারোটি খণ্ড প্রকাশ করেছে। বাংলা একাডেমি থেকে প্রকাশিত ‘নজরুল-রচনাবলী’ এই ১২টি খণ্ড নজরুল জন্মশতবর্ষ সংস্করণ এখন অবধি পাওয়া যাচ্ছে এবং বারবার পুনর্মুদ্রিত হচ্ছে।

বাংলাদেশের প্রতি কবি নজরুলের গভীর ভালোবাসা ছিল। এ কথা বারবার উচ্চারিত হয় যে বাংলাদেশ ও কবি নজরুল এ প্রত্যয় দুটি পরস্পরের পরিপূরক ও অবিচ্ছেদ্য। পক্ষান্তরে, কবি নজরুলের সৃষ্টিকর্মে বাংলাদেশের মাটি, পানি, পরিবেশ-প্রতিবেশ প্রভৃতি অপরিসীম ভূমিকা রেখেছে। তিনি বাংলাদেশের নানা স্থানে ভক্ত-অনুরাগীদের কাছে, কখনো সংবর্ধনা উপলক্ষ্যে, কখনো সম্মেলন, কখনো অতিথি, কখনো গায়ক, কখনো বক্তা, কবি, আবৃত্তিকার হিসেবে, আবার কখনো রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে গিয়েছেন।
বিশ শতকের ত্রিশ দশকে বারবার কবি নজরুলের ঢাকায় আগমন এবং সময় সময়ে বাংলা একাডেমির বর্ধমান হাউসে অবস্থান একটি তাৎপর্যময় ঘটনা। কবি নজরুলের ঢাকায় অবস্থানের সময় এদেশের আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবেশ খুবই প্রতিকূল ছিল। সেই সময় সারা বাংলার বিভিন্ন স্থানে হিন্দু-মুসলমান সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাসহ উপমহাদেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি ছিল উত্তাল। অসহযোগ-সন্ত্রাসবাদ আন্দোলন, দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাশের মুত্যুর পর বেঙ্গল প্যাক্টের ব্যর্থতা ও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ইত্যাদি বিষয় কবি নজরুলকে ভাবিয়ে তুলেছিল। কবি নজরুল স্বপ্ন দেখতেন স্বাধীন বাংলাদেশের। পরবর্তীকালে তাঁর এ স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নেয়।
কবি নজরুল কালের প্রয়োজনেই বর্ধমান হাউসে এসেছেন। তিনি বর্ধমান হাউসের চত্বরে ও পুকুর পাড়ে বসে গান গাইতেন, বাঁশি বাজাতেন। বর্ধমান হাউসে তিনি রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি ও সৃষ্টির স্বাক্ষর। এসব তথ্যাদি কবি নজরুলের রচিত বিভিন্ন রচনা, চিঠিপত্র এবং সমসাময়িককালে তাঁর বন্ধু, প্রিয়জন ও ভক্তদের স্মৃতিকথায় রয়েছে। কালের পরিক্রমায় বর্ধমান হাউসে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠিত হওয়া এবং কাজী নজরুল ইসলামের এখানে অবস্থান করার ফলে দেশ-কাল বাস্তবতার পটভূমিতে এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব, তাৎপর্য ও প্রাসঙ্গিকতা এখনো বিরাজমান।

কবি নজরুল প্রথম ১৯১৪ সালে সপ্তম শ্রেণির ছাত্ররূপে আগমনের পর হতে অনেকবার এদেশে এসে তাঁর অনলবর্ষী ভাষণ, জাগরণমূলক কবিতা ও গানের মাধ্যমে এই অঞ্চলের মানুষের মধ্যে জাগরণের সৃষ্টি করেছিলেন। তিনি পশ্চাৎপদ পূর্ববঙ্গের হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যেও এনেছিলেন এক ভিন্নতর জাগরণ, প্রেরণা, সম্প্রীতি ও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষা। সেই সময় থেকেই কাজী নজরুল বাংলাদেশের খুব জনপ্রিয় ব্যক্তিত্ব। এরই ধারাবাহিকতায় একজন রাজনৈতিক নেতা হিসেবে তিনি ১৯২৬ সালের জুন মাসের শেষ সপ্তাহে প্রথম ঢাকায় আগমন করেন। এ সময় তাঁর রাজনৈতিক সহকর্মী হেমন্তকুমার সরকার এমএ, এমএলসি তাঁর সঙ্গী ছিলেন। ওই বছরের অক্টোবরে কবি নজরুল আবার স্বরাজ দলের বেঙ্গল লেজিসলেটিভ কাউন্সিলের মনোনীত প্রার্থী হিসেবে ঢাকায় এসেছিলেন। তখন তিনি পুরোনো ঢাকার শ্রীমোহিনী মোহন দাশের আতিথ্য গ্রহণ করেছিলেন। তাঁর বাসা ছিল ঢাকা জজ কোর্ট সংলগ্ন।
কবি নজরুলের প্রত্যক্ষ রাজনৈতিক জীবনের এটি সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ও তাৎপর্যময় ঘটনা। তিনি তদানীন্তন পূর্ববঙ্গের ঢাকা বিভাগ (ঢাকা, ফরিদপুর, বরিশাল ও ময়মনসিংহ) থেকে ভারতীয় কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদের নির্বাচনে সদস্যপদ লাভের জন্য প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলেন। তখনকার সময়ে কেন্দ্রীয় আইনসভার উচ্চ পরিষদে মুসলমানদের জন্য পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে দুইটি আসন ছিল। সম্পত্তির হিসাবের ভিত্তিতে মোট ভোটারের সংখ্যা ছিল আঠারো হাজারের কিছু বেশি। এ নির্বাচনে বরিশালের মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী, টাঙ্গাইলের জমিদার আবদুল হালিম গজনবি, ঢাকা নবাব বাড়ির আবদুল করিম এবং কাজী নজরুল ইসলাম ও মফিজউদ্দিন আহমদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন। কিন্তু সীমিত সংখ্যক ভোটারের ভোটের ভিত্তিতে পৃথক নির্বাচন পদ্ধতিতে তিনি পূর্ববঙ্গের জাঁদরেল মুসলমান জমিদারদের সঙ্গে পেরে ওঠেননি। মুহম্মদ ইসমাইল চৌধুরী ও আবদুল হালিম গজনবি নির্বাচনে জয়লাভ করেন। তবে এই নির্বাচন উপলক্ষ্যে কবি নজরুলকে পূর্ব বাংলায় ব্যাপক সফর করতে হয়েছিল; বিশেষত তদানীন্তন ঢাকা বিভাগে।
নির্বাচনি প্রচার কাজ চালাতে গিয়ে কবিকে বাববার প্রতিক্রিয়াশীলদের মুখোমুখি হতে হয়েছে, তখন তিনি তার ইসলামি গান ও কবিতা শুনিয়ে তাদের শান্ত করার চেষ্টা করেছেন। এ সময় প্রগতিপন্থি তরুণদের এগিয়ে আসার জন্য বারবার আহ্বান করেছেন তিনি। নির্বাচনি কাজে কবি নজরুলের ঢাকায় আগমনের খবর পেয়ে কবি আবদুল কাদির ও তাঁর সাহিত্যিক বন্ধু মোহাম্মদ কাসেম এবং আবদুল মজিদ সাহিত্যরত্নসহ অনেকে কবির সঙ্গে দেখা করেন। কবি নজরুল মুসলিম সাহিত্য সমাজের খবর আগেই শুনেছিলেন এবং দূর থেকে প্রথম থেকেই এ সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। সরাসরি তাদের নিকট ঢাকা ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র হিন্দু মুসলিম সমন্বয় ধারার যুক্তিবাদী-প্রগতিশীল সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের খবর শুনে খুবই প্রীত হন এবং তাদের সঙ্গে যুক্তভাবে কাজ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেন।

নির্বাচন উপলক্ষ্যে ১৯২৬ সালে কয়েকবার কাজী নজরুল ঢাকায় আগমনের এক পর্যায়ে তিনি পুরোনো ঢাকার ৫২ বেচারাম দেউড়ির হযরত সৈয়দ শাহ মোহাম্মদ ইউসুফ কাদেরি (র.)-এর বাড়িতে অবস্থান করেন। তিনি কাজী নজরুলের বিশেষ ভক্ত ছিলেন। এ বাড়িতে অবস্থান করে তিনি নির্বাচনি প্রচার কাজে জয়দেবপুরসহ বিভিন্ন জায়গায় গমন করেন। তবে তার নির্বাচনি উদ্দেশ্য সফল হয়নি।

কাজী নজরুল ঢাকায় নির্বাচনি সফরকালে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র কর্মীদের সঙ্গে মিলিত হওয়ার সময় এ সাহিত্য সমাজের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হলের বর্ধমান হাউস ছাত্রাবাসের হাউস টিউটর এ ভবনের দুতলায় বসবাসকারী অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেনের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক তৈরি হয়। তখন বর্ধমান হাউস ছিল মুসলিম হলের অন্তর্ভুক্ত। সেই সূত্রে কাজী নজরুল ইসলাম বর্ধমান হাউসে বেশ কয়েকবার তার আতিথেয়তা গ্রহণ করেন। উল্লেখ্য, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহ্যবাহী মুসলিম হল কিছুকাল তদানীন্তন প্রাদেশিক সচিবালয় হাউসে (পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কলা ভবন, বর্তমানে ঢাকা মেডিকেলের জরুরি বিভাগ) প্রথম তলায় কার্যক্রম শুরু করে। এটি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম হল। কিছুকাল পরে বর্তমান জায়গায় সলিমুল্লাহ্ মুসলিম হল হিসেবে যাত্রা শুরু করে।

১৯২৭ সালের ২৮শে ফেব্রুয়ারি মুসলিম সাহিত্য-সমাজের প্রথম বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল (বর্তমানে স্যার সলিমুল্লাহ মুসলিম হল) মিলনায়তনে। পূর্বাপর ধারাবাহিকতায় এ সম্মেলন উদ্বোধনের জন্য কাজী নজরুল ঢাকার আমন্ত্রণ পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়ে সাহিত্য-সমাজের সম্পাদক আবুল হুসেনকে কৃষ্ণনগর থেকে ১০-২-১৯২৭ তারিখে লিখেন, ‘প্রিয় আবুল হুসেন সাহেব। আপনার আমন্ত্রণলিপি নব-ফাল্গুনের দখিন হাওয়ার মতই খুশখবরী নিয়ে এসেছে’। [শাহাবুদ্দীন আহমদ (১৯৯৫), নজরুলের পত্রাবলী, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, পৃ. ৪৭]
সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে এসে এবার কবি কাজী নজরুল ইসলাম ঢাকায় আবুল হুসেনের বাসায় উঠেছিলেন। সম্মেলন উপলক্ষ্যে কাজী নজরুল তাঁর সদ্য রচিত ‘খোশ্ আমদেদ’ গানটি গেয়ে বার্ষিক সম্মেলন উদ্বোধন করেন। সম্মেলনের দ্বিতীয় দিন কবি নজরুল দীর্ঘ বক্তৃতা করেন। বক্তৃতায় তিনি বলেন, ‘আজ আমি এই মজলিসের আমার আনন্দ বার্ত্তা ঘোষণা করছি। বহুকাল পরে কাল রাত্রে আমার ঘুম হয়েছে। আজ আমি দেখছি এখানে মুসলমানের নূতন অভিযান শুরু হয়েছে। আমি এই বার্ত্তা চতুর্দ্দিকে ঘোষণা করে বেড়াব।’ [মুস্তাফা নূরউল ইসলাম (সম্পা.) (২০০৩), শিখাসমগ্র, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, পৃ. ১৭৯]
সমসাময়িক প্রেক্ষাপটে কাজী নজরুলের বক্তৃতাটি তাৎপর্যপূর্ণ ও গুরুত্ববহ ছিল। দুদিনব্যাপী এ সম্মেলনে দেশের বিভিন্নপ্রান্ত থেকে আগত বিশিষ্টজনেরা প্রবন্ধ-নিবন্ধ পাঠ করেন এবং শিল্পীরা সংগীত পরিবেশনা করেন। প্রবন্ধকারদের মধ্যে ছিলেন কাজী মোতাহার হোসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, মোহাম্মদ কাসেম, কাজী আনোয়ারুল কাদির, শামসুল হুদা, আবুল হুসেন প্রমুখ। ঢাকার ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র প্রথম বার্ষিক সম্মেলনের বিবরণী সমাজের মুখপত্র বার্ষিক ‘শিখা’য় ছাপা হয়েছিল।

প্রথম বর্ষের অনুবৃত্তিক্রমে পরের বছর ১৯২৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের প্রথম সপ্তাহে (১৩৩৪ বঙ্গাব্দের মাঘ) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মুসলিম হল মিলনায়তনে ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র সম্মেলনের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনও উদ্বোধন করতে ঢাকায় আসেন কাজী নজরুল ইসলাম। এ প্রসঙ্গে কাজী নজরুল গবেষক রফিকুল ইসলাম লিখেছেন :
‘১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারির প্রথম সপ্তাহে ঢাকায় মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন হয়, অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন তখন সাহিত্য সমাজের সম্পাদক। … ঢাকায় এবারের সফরে নজরুল ‘এ বাসি বাসরে আসিলে গো ছলিতে’, ‘নিশি ভোর হলো জাগিয়া পরাণ প্রিয়া’, ‘আমার কোন কূলে আজ ভিড়ল তরী’ প্রভৃতি গজল গান রচনা করেন যার প্রথম দুটি ‘প্রগতি’তে ছাপা হয়েছিল। ঢাকায় এবারের সফরে নজরুলের ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল অনেক বিদগ্ধজনের সঙ্গে যাদের মধ্যে ছিলেন ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রেয়, তাঁর গুণবতী কন্যা উমা মৈত্রেয় (নোটন), অধ্যাপক কাজী মোতাহার হোসেন, কৃতি ছাত্র ও সাহিত্যিক বুদ্ধদেব বসু এবং রানু সোম (প্রতিভা বসু), অংক বিভাগের এম. এ. ক্লাসের ছাত্রী ফজিলাতুন্নেসা প্রমুখ।’ [রফিকুল ইসলাম (২০১৯), নজরুলের বাংলাদেশ-আগমনের শতবর্ষ, কবি নজরুল ইনস্টিটিউট, ঢাকা, পৃ. ৮৫]
কাজী মোতাহার হোসেন মুসলিম সাহিত্য সমাজের দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলন ও সমাজের মুখপত্র ‘শিখা’র সম্পাদক ছিলেন। কবি নজরুল নতুনের গান (চল্ চল্ চল্) গানটি গেয়ে এই সম্মেলন উদ্বোধন করেন। এবারের যাত্রায় কবি নজরুল প্রথমে উঠেছিলেন আবুল হুসেনের বাসায়। পরে অধিবেশন শেষে কবি নজরুলকে কাজী মোতাহার হোসেনের আতিথেতায় বর্ধমান হাউসের দ্বিতীয় তলার একটি কক্ষে থাকার ব্যবস্থা করা হয়। এ সফরে আবদুল কাদিরকে কাজী নজরুলের খোঁজ খবর ও দেখাশোনার দায়িত্ব প্রদান করা হয়। আবদুল কাদির ছিলেন তখন ঢাকা কলেজের আইএ ক্লাসের ছাত্র। কবি নজরুল আবদুল কাদিরকে খুব স্নেহ করতেন। পরবর্তীকালে কবি নজরুল তাঁর বিবাহের ঘটকালি করেছিলেন এবং মুজফফর আহমদের কন্যা আফিফা খাতুনের সঙ্গে আবদুল কাদিরের বিবাহ (১৯৩৫) সম্পন্ন করে দেন।

‘মুসলিম সাহিত্য সমাজে’র দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে ঢাকায় কাজী নজরুলের সঙ্গে বহু বিদ্বৎজনের ঘনিষ্ঠতা ও সম্পর্ক হয়। রানু সোম (প্রতিভা বসু), ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ সুরেন্দ্রনাথ মৈত্রেয়র কন্যা উমা মৈত্রেয় (নোটন), ফজিলাতুন্নেসা এবং তাঁর ছোট বোন শফিকুন্নেসা প্রমুখের সঙ্গে নজরুলের পরিচয় হয়। রানু সোম (প্রতিভা বসু) ও উমা
মৈত্রেয় (নোটন)’র সঙ্গে নজরুলের সংগীতের সম্পর্ক স্থাপিত হয়েছিল। নজরুল তাঁদের গান শেখাতেন। একদিন রানু সোমকে গান শিখিয়ে নজরুল পুরোনো ঢাকার বনগ্রাম থেকে রাতের অন্ধকারে বর্ধমান হাউসে ফেরার পথে কতিপয় গুন্ডা দ্বারা আক্রান্ত হয়েছিলেন। মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে এসে কবি নজরুলের সাহিত্যকর্মে ব্যাপক ছাপ পড়েছিল। বিশেষ করে তাঁর ‘শিউলিমালা’ গল্পগ্রন্থে ও ‘চক্রবাক’ কাব্যগ্রন্থে। ‘বুদ্ধদেব বসু নজরুলের এ সফরের মনোরমভাবে বর্ণনা করেছেন ‘কালের পুতুল’ (১৯৫৮) গ্রন্থে। মুসলিম সাহিত্য সমাজ-এর দ্বিতীয় বার্ষিক সম্মেলনে কাজী নজরুল ইসলামের সঙ্গে আরও যাঁদের পরিচয় ও ঘনিষ্ঠতা হয় তাঁদের মধ্যে বুদ্ধদেব বসু, অজিত দত্ত প্রমুখ অন্যতম।

পূর্ব বাংলার গৌরবের প্রতীক ঐতিহ্যবাহী বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুলের আগমন এবং মুসলিম সাহিত্য সমাজের প্রাসঙ্গিকতা কখনো ফুরিয়ে যাবে না। আমাদের দুর্ভাগ্য জাতিগতভাবে আমরা ইতিহাস ও ঐতিহ্য সম্পর্কে সচেতন নই। এজন্য কাজী নজরুলসহ বহু গুণিজনের সারা বাংলাদেশে স্মৃতিবিজড়িত স্থান সম্পর্কে জানি না এবং সংরক্ষণ করার চেষ্টা করি না। ঐতিহ্যের কারণে মুসলিম হলসহ ঢাকায় জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নানা স্মৃতিবিজড়িত স্থানে তথ্য লিপিবদ্ধ করে শ্বেতপাথর প্রস্তরখণ্ড স্থাপন করা প্রয়োজন। এটা করা হলে জাতীয় কবি সম্পর্কে নতুন প্রজন্ম নানা তথ্য জানতে পারবে। কবি নজরুলের কর্মময় জীবনে নানা ঘটনা-উপঘটনা রয়েছে। তারুণ্যদীপ্ত কাজী নজরুলের স্মৃতির অন্যতম স্থান হলো ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বর্ধমান হাউস। বর্ধমান হাউসে কাজী নজরুল রেখে গেছেন অনেক স্মৃতি ও সৃষ্টির স্বাক্ষর। সেসব তথ্যাদি কবি নজরুলের রচনা, চিঠিপত্র এবং ভক্তদের স্মৃতিকথাসহ নানা মাধ্যমে লিপিবদ্ধ রয়েছে। রাজধানী শহর ঢাকার সঙ্গে কবি নজরুলের জীবন, সৃষ্টিকর্ম ও মৃত্যুর অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক রয়েছে। কাজী নজরুলের সৃষ্টিকর্ম বাংলাদেশ সৃষ্টিতে অপরিসীম ভূমিকা পালন করেছে। সংগত কারণেই কাজী নজরুল ইসলামের জীবন ও কর্মের ইতিহাস জানতে গেলে, বুঝতে গেলে মুসলিম সাহিত্য সমাজ এবং ঐতিহাসিক বর্ধমান হাউসে তার স্মৃতির প্রাসঙ্গিকতা কখনোই উপেক্ষা করা যাবে না।

লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক। উৎপাদন অফিসার, বাংলা একাডেমি