December 17, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Wednesday, December 10th, 2025, 7:47 pm

বাংলাদেশের উপকূলীয় নারীদের নীরব স্বাস্থ্য বিপর্যয়: লবণাক্ত পানি, জরায়ু অপারেশন ও প্রজনন স্বাস্থ্য সংকট

খুলনা প্রতিনিধি:

বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম উপকূল—খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট—জলবায়ুর অভিঘাতের নিবিড় পরীক্ষাগার। কিন্তু এখানে আরেকটি নীরব সংকট বহুদিন ধরে ঘনীভূত হচ্ছে অল্পবয়সী নারীদের জরায়ুজনিত জটিলতা ও অকাল জরায়ু অপারেশনের ভয়াবহ বিস্তার। লবণাক্ত পানি, মাসিক স্বাস্থ্য সচেতনতার ঘাটতি, দারিদ্র্য, অপচিকিৎসা, ক্লিনিক-দালাল সিন্ডিকেট মিলিয়ে পরিস্থিতি এখন একটি নীরব স্বাস্থ্য বিপর্যয় ।

অনুসন্ধানে দেখা গেছে ২৫–৩৫ বছরের মধ্যে জরায়ু অপারেশনের সংখ্যা ভয়াবহ বাড়ছে। গ্রামে গ্রামে এমন পরিবার পাওয়া যায়, যেখানে একাধিক নারী জরায়ু কেটে ফেলেছেন। স্থানীয় অনেক ক্লিনিক রোগী ধরতে জরায়ু কাটলেই সুস্থ বলে ভুল পরামর্শ দিচ্ছে । লবণাক্ত পানি নারীদের সংক্রমণ ও হরমোনজনিত জটিলতা বাড়িয়ে দিচ্ছে। নারীরা অপারেশনের পর বাকি জীবন ভুগছেন দুর্বলতা, মানসিক চাপ ও দাম্পত্য ক্ষতিতে।

দাকোপের বানিশান্তা ইউনিয়নের ৩২ বছরের মাহফুজা খাতুন। সকাল হলেই সুন্দরবনের খালে নেমে রেণুপোনা ধরেন। তাঁর শরীরে এখন শক্তি নেই, কোমরে ব্যথা, মাথা ঘোরে।তিনি ফিসফিসিয়ে বলেন, জরায়ু কাটছে পাচ বছর আগে। বয়স ছিল ২৭। লোনা পানি খাইয়া বড় হইছি, সেই পানিই আমার জরায়ু শেষ কইরা দিছে। কারণ জানতে চাইলে বলেন, প্রথমে স্রাব ও পেট ব্যথা শুরু। ডাক্তারের কাছে গেলে বলে জরায়ু বড় হইছে, কাটতেই হবে। কিন্তু তিনি জানতেন না জরায়ু অপারেশন নারীর শরীরে স্থায়ী প্রভাব ফেলে। কাটাইয়া দেওয়ার পর আর আগের মতো কাজ করতে পারি না। দুই বালতি পানি পর্যন্ত তুলতে পারি না। এমন গল্প আশাশুনি, শ্যামনগর, কয়রা পাইকগাছা ও দাকোপের প্রায় সব গ্রামেই শোনা গেছে। এমনকি  শ্যামনগরের একটি  গ্রামের ২১ জন বিবাহিত নারীর মধ্যে অন্তত ৭ জনের জরায়ু অপসারণ হয়েছে।৫৫ বছরের লতিফা বেগম জানান, মোর মেয়ারে ২৮ বছর বয়সে কাটাই দিচ্ছে। ডাক্তার কইছে, আর সময় নষ্ট করলে বাঁচব না।দুজন নারী জানালেন এলাকার বেসরকারি  ক্লিনিকের লোকজনই বেশি চাপ দেয়। কাটলে দ্রুত আরাম পাবি বলে। এটা একধরনের ব্যবসায়িক সিন্ডিকেট, যেখানে—দালালেরা গ্রামের নারীদের খুঁজে খুঁজে ধরে। সামান্য সংক্রমণকেও জটিল বলে ভয় দেখানো হয়। অপ্রয়োজনীয় অপারেশনের মাধ্যমে ক্লিনিক লাখ লাখ টাকা আয় করে। উপকুলীয় এলাকার প্রতিটি গ্রামে দালালের নেটওয়ার্ক সক্রিয়।

কয়রা বেদাকশি গ্রামের ১৮ বছরের রুবিনা (ছদ্মনাম) বলেন, ন্যাপকিন কিনতে পারি না। লোনা পানিতে পুরানো কাপড় ধুই। দুইদিন পর থেকে চুলকানি আর জ্বালা শুরু হয়।গ্রামে কথা বলে যা পাওয়া গেছে ৭০% নারী এখনো পুরনো কাপড় ব্যবহার করেন। অধিকাংশ কাপড় ধোয়া হয় লবণাক্ত পানিতে। আধুনিক মাসিক-স্বাস্থ্য বিষয়ে ধারণা নেই। সংক্রমণ হলে প্রথমে কবিরাজ, পরে ফার্মেসি। একজন স্থানীয় স্কুলশিক্ষিকা হামিদা খাতুন জানান, মেয়েরা মাসিক নিয়ে কথা বলতে ভয় পায়। অসুস্থ হলেও লুকায়। এগুলো মিলিয়েই জরায়ু রোগের প্রাথমিক ভিত্তি তৈরি হয়।

 

সাতক্ষীরার শ্যামনগরের ছোট্ট গ্রাম ধুমঘাট। দুপুরের রোদে মাটির ঘরের আঙিনায় বসে আছেন ৩৫ বছর বয়সী খাদিজা বেগম। শরীরের নিচের অংশে শাড়ি জড়িয়ে রেখেছেন প্রায় হাঁটু পর্যন্ত। নিচে শুকনো কাপড়, কিন্তু শব্দেই বোঝা যায় ব্যথায় কুঁকড়ে আছেন। তলপেটটা আগুনের মতো জ্বলে, ধীরে ধীরে বলেন তিনি। তিন বছর হলো জরায়ু কেটে ফেলেছে। তখন বয়স মাত্র ৩২। এখনো শরীর টলে যায়।

এ গল্প আলাদা নয় বরং উপকূলের নারীদের সবচেয়ে সাধারণ গল্পগুলোর একটি। যে ভূমি কৃষির জন্য  বিখ্যাত ছিল, সেই ভূমিতে এখন নোনা পানি, লবণাক্ত মাটি, ব্যাধি, জলবায়ু দুর্যোগ আর স্বাস্থ্যসংকটের জটিল এক ত্রিভুজ নারীর শরীরকে প্রতিদিন ক্ষতবিক্ষত করছে।

খুলনা-সাতক্ষীরা-বাগেরহাট  উপকূল আজ শুধু পরিবেশগত সংকটে নয়, মানবিক বিপর্যয়ের কিনারায় দাঁড়িয়ে।

উপকূলীয় জেলা তিনটি খুলনা, সাতক্ষীরা ও বাগেরহাট জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে দ্রুত রূপ পাল্টাচ্ছে। সাগরের পানি উপকূলে প্রবেশ করছে ক্রমেই গভীরে। নদীগুলো শুষ্ক মৌসুমে হয়ে যাচ্ছে নোনাজলপূর্ণ খাল। বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের (BWDB) Salinity Monitoring Report ২০২৩ বলছে, গত ২৫ বছরে নদীর লবণাক্ততা বেড়েছে ২৭%, শুষ্ক মৌসুমে কিছু নদীতে স্যালিনিটি বেড়েছে ৫-৮ PSU. উপকূলের অনেক স্থানে পানির লবণাক্ততা WHO র মানের ৪-৫ গুণ বেশি।

DPHE-WHO Joint Water Survey 2021 Ges DPHE Water Quality Report ২০২৩ অনুযায়ী  সাতক্ষীরার ৫০০ থেকে ৭০০ ফুট গভীর নলকূপেও TDS WHO র মাত্রার দ্বিগুণ। অধিকাংশ গ্রামে রান্নার পানি পর্যন্ত নোনা। এই নোনা জলের বিরুদ্ধে উপকূলীয় নারীরা প্রতিদিন যুদ্ধ করেন হাঁটেন ২-৫ কিলোমিটার, মাথায় কলসি নিয়ে সুপেয় পানি খুঁজে বেড়ান। প্রতিদিনের এই পরিশ্রম, সঙ্গে লবণাক্ততা একটি ধীর বিষের মতো তাদের শরীরের প্রতিটি অঙ্গকে ক্ষয় করে।

২০২৩ সালে হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক আশরাফী বিনতে আকরাম উপকূলের ৩টি উপজেলার ২,৩০০ নারীর ওপর সমীক্ষা চালান। ফলাফলে ভয়াবহতা লক্ষনীয়। এসব অঞ্চলের ৬৭% নারী লিউকোরিয়ায় আক্রান্ত, ৫৮% অতিরিক্ত ঋতুস্রাব, জরায়ুর সংক্রমণের শীকার ৪৩% । এছাড়া  ১২% নারীর ক্যানসারের প্রাক-লক্ষণ শনাক্ত করা হয়েছে।

গাইনী বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক (অবসরপ্রাপ্ত)  ডাঃ শামসুন্নাহার লাকী বলেন, যে লেভেলের সংক্রমণ আমরা উপকূলে দেখি, দেশের অন্য কোথাও দেখি না। লবণাক্ততা যেভাবে শরীরে পানি তুলে নেয়, ত্বক আর প্রজনন অঙ্গ দুইটাই দ্রুত সংবেদনশীল হয়ে পড়ে। নারীরা বলেন সাদা স্রাব, জ্বালা, ব্যথা এগুলো আমাদের নিত্যদিনের অংশ হয়ে গেছে।

কিন্তু লবণাক্ততা কিভাবে এসব ঘটায়? অতিরিক্ত লবণ শরীরের প্রাকৃতিক ব্যাকটেরিয়াল ভারসাম্য নষ্ট করে, যৌনাঙ্গের টিস্যু শুকিয়ে যায়, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ক্ষত তৈরি হয় এবং সহজে সংক্রমণ ঢুকে পড়ে সহজেই। ডিহাইড্রেশন হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট কওে । এর ফলে ব্যথা, সংক্রমণ, ঋতুস্রাব চক্রের অস্থিরতা। এভাবে লবণাক্ততা নারীর শরীরে শত্রুর মতো বাসা বাঁধে।

DGHS -এর জেলা স্বাস্থ্য বুলেটিন (২০১৯-২০২৩) বিশ্লেষণে দেখা যায় ২০১৮ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত উপকূলীয় জেলা খুলনায় ৮হাজার৪২২জন, সাতক্ষীরায় ৬হজার১৩৫ জন ও বাগেরহাটে ৫হাজার ০৩৭ জন নারীর জরায়ু অপসারণ হয়েছে । সব মিলিয়ে ১৯,৫৯৪ নারী পাঁচ বছরে জরায়ু হারিয়েছেন। আরও উদ্বেগের কারন হচ্ছে এই নারীদের ৬৫%এর বয়স মাত্র ৩০ থেকে ৪০। বিশেষজ্ঞদের মতে, এই অপারেশনের অন্তত ৩০-৪০% করা হয় যথাযথ পরীক্ষার আগেই। অনেক ক্ষেত্রেই রোগীর দরিদ্রতা, ভয়, অজ্ঞতা সব মিলিয়ে দ্রুত অপারেশন করে ফেলা হয়। জরায়ু অপসারণের পর নারীদের মধ্যে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট, গরম-ঠান্ডা ওঠানামা, ডিপ্রেশন, হাড়ের ক্ষয়, যৌনজীবনে সমস্যা ও স্থায়ী ক্লান্তির মত জটিলতা দেখা যায়।

দাকোপের খাদিজা বেগম বলেন, ডাক্তার বললো অপারেশন ছাড়া উপায় নেই। এখনো রাতে ঘুমাতে পারি না, শরীর জ্বলে।

icddr,b এর ২০২২ সালের গবেষণা বলছে উপকূলীয় এলাকায় গর্ভপাতের হার ২২%, জাতীয় গড় ১২%। খুলনার কয়রায় এ হার সবচেয়ে বেশি ২৫%। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে মায়ের রক্তচাপ বেড়ে যাওয়া, শরীরে লবণের ঘনত্ব বাড়া, প্লাসেন্টা জটিলতা, ডিহাইড্রেশন, অতিরিক্ত হাঁটাহাঁটি ও নিরাপদ পানি না পাওয়া।

খুলনার  সুন্দরবনসংলগ্ন ঢাংমারির গৃহবধূ সোনালী খাতুন (২৬) বলেন, গর্ভের পাঁচ মাসে রক্ত পড়তে লাগলো। দুর্গম এলাকা হওয়া হাসপাতালে যেতে পারেনি। পরে বাচ্চা নষ্ট হলো।

চিকিৎসকদের মতে গর্ভবতী নারীরা দিনের পর দিন নোনাজলে হাঁটেন, যা জরায়ুতে স্ট্রেস তৈরি করে। প্লাসেন্টা স্বাভাবিকভাবে বেড়ে উঠতে পারে না। ফলে ডিহাইড্রেশন গর্ভধারণ বজায় রাখা কঠিন করে।

উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডাঃ সুদীপ বালা  বলেন আমরা প্রায়ই দেখি গর্ভবতী নারী লবণাক্ততার কারণে হঠাৎ রক্তচাপ বাড়ায়। এতে ভ্রূণ বাঁচানো কঠিন হয়ে যায়।

ইজঅঈ ঐবধষঃয ২০২৩ এর সমীক্ষায় দেখা গেছে  উপকূলে নারীরা ৩৮-৪০ বছরেই মেনোপজে পৌঁছান। কিন্তু বাংলাদেশের জাতীয় গড় ৪৮-৫০। এ যেন কিশোর বয়স পার হতেই বার্ধক্যের আগমন। সাতক্ষীরার কালিগঞ্জের হাসিনা খাতুন বলেন, ৩৬ বছর বয়সে মাসিক বন্ধ হয়ে গেলো। আগে কখনো ভাবিনি এত তাড়াতাড়ি বার্ধক্য আসবে।

বিজ্ঞানীরা বলেন অতিরিক্ত লবণাক্ততার কারণে শরীরের ইলেকট্রোলাইট ব্যালান্স নষ্ট হয়, অ্যাড্রেনাল গ্ল্যান্ড অতিরিক্ত চাপ তৈরি করে,হরমোন (estrogen) দ্রুত কমে যায়। ফলে মেনোপজ দ্রুত আসে এর প্রভাবে হাড় ভঙ্গুরতা,হৃদরোগ,ডিপ্রেশন,ঘুমের সমস্যা ও যৌনজীবনের জটিলতা দেখা যায়।

BRAC Health এর ২০২২ সালের সমীক্ষা বলছে, ৩৮% কিশোরী মাসিকের সময় স্কুলে যেতে পারে না, ২৯% মাসিকজনিত সংক্রমণে ভোগে। এছাড়া ১৯% মাসিক বন্ধ রাখতে নিজে থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পিল খায়। পিল সেবনের এই প্রবণতা ভবিষ্যৎ প্রজননক্ষমতার জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ।

কয়রার  ১৪ বছর বয়সী বর্ষা জানায়, স্কুলে যাওয়া যায় না। ব্যথা আর লজ্জা। তাই মাসিক বন্ধ করতে মাঝেমধ্যে পিল খাই। তার মা বলেন, স্বাস্থ্য সম্মত শৌচাগার নেই, পানি নোনা। মেয়েদের কষ্ট দেখলে বুক ভেঙে যায়। বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন কিশোর বয়সের পিল নেওয়ায় ভবিষ্যতে বন্ধ্যাত্ব, অনিয়মিত ঋতুস্রাব, জরায়ুর জটিলতা ও বয়ঃসন্ধির সমস্যা বাড়ায়।

UNICEF–BNPS ২০২১ এর গবেষণা বলছে যেসব এলাকায় লবণাক্ততা বেশি, সেখানে নবজাতকদের মধ্যে দেখা যায় কম ওজন  ৩৪%,শ্বাসকষ্ট ২৭%, ত্বকের সমস্যা ৪২% ও  প্রসবকালীন জটিলতা ৩০%।

পুষ্টিবিদরা বলেন, মায়ের শরীরে লবণের ঘনত্ব বাড়লে ফ্লুইড রিটেনশন হয়। এতে ভ্রূণের বৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। সাতক্ষীরার দুধপুটি গ্রামের রাবেয়া বলেন আমার তিনটা সন্তানই কম ওজন নিয়ে জন্মেছে। ডাক্তার বললো লবণাক্ত পানির জন্যই হয়তো। এ যেন ভবিষ্যৎ প্রজন্মের ওপর লবণাক্ত অভিশাপ।

উপকূলীয় এলাকার নারীদের  পানির জন্য হাঁটতে হয় মাইলকে মাইল। IMED এর ২০২৩ সালের মূল্যায়ন রিপোর্ট বলছে উপকূলের নারীদের ৬৩% প্রতিদিন অন্তত ৩–৫ কিমি হাঁটেন পানি আনতে, ৫২% গর্ভবতী নারী শারীরিকভাবে অতিরিক্ত ঝুঁকিতে ও ৪৭% পানির কারণে নিয়মিত কোমর–পিঠের ব্যথায় ভোগেন।

কয়রা উপজেলার আমিনা বললেন, প্রতিদিন দুইবার ৪ কিলোমিটার হাঁটি। গর্ভের সময়ও হাঁটতে হয়েছে। কিন্তু পানি আনবে কে?

এই পানির শ্রমের ফলে গর্ভপাত, হাড়ের ক্ষয়, রক্তস্বল্পতা, দীর্ঘস্থায়ী ক্লান্তি, প্রজনন ক্ষমতার অবনতির মতন ঘটনা ঘটে থাকে।

যেদিন পানি পাই না, সেদিন খাবারই হয় না। বলছিলেন বেদকাশীর হাসিনা খাতুন।

উপকূলীয় অঞ্চলের সরকারি স্বাস্থ্যসেবা দীর্ঘদিন ধরেই অবকাঠামোগত দুর্বলতা, জনবল সংকট ও বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ঘাটতিতে ভুগছে। বিশেষ করে স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের অভাবে নারীরা সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ছেন। চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে প্রথমে ভরসা করতে হয় স্থানীয় ফার্মেসি, ডিপ্লোমা ডাক্তার, ক্লিনিকের কর্মচারী বা ভ্রাম্যমাণ দালালের ওপর, যা রোগ জটিল করে তোলার পাশাপাশি বাড়িয়ে দিচ্ছে প্রাণঘাতী ঝুঁকি।

খুলনার দাকোপ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. সুদীপ বালা জানান, উপজেলায় মোট ১ লাখ ৫৪ হাজার জনসংখ্যার মধ্যে নারী রয়েছেন ৭৯ হাজার ১৭ জন। কিন্তু এত বিপুল নারীর জন্য স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে একজনও স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞ নেই। ফলে নারীদের প্রসূতি ও স্ত্রীরোগ সংক্রান্ত জটিলতা দেখা দিলেই তারা বাধ্য হয়ে অনিয়ন্ত্রিত চিকিৎসা ব্যবস্থার ওপর নির্ভর করেন।

এ অবস্থার আরও করুণ চিত্র দেখা যায় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলায়। উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. জিয়াউর রহমান জানান, এলাকায় সাড়ে ৩ লাখের বেশি মানুষের বসবাস। এর মধ্যে নারী রয়েছেন ১ লাখ ৫৩ হাজার ৪৮৭ জন। কিন্তু এত মানুষের জন্য মাত্র একজন গাইনি বিশেষজ্ঞ দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি বলেন, এত বড় জনসংখ্যার জন্য একজন বিশেষজ্ঞ পর্যাপ্ত নয়। ফলে রোগীরা সময়মতো সেবা পান না, অনেকে জটিল অবস্থায় হাসপাতালে আসেন।

জনবহুল উপকূলীয় এলাকায় স্ত্রী রোগ বিশেষজ্ঞের সংকট নারীদের প্রজনন স্বাস্থ্যে বড় ধরনের ঝুঁকি তৈরি করছে। অনিয়ন্ত্রিত চিকিৎসার ফলে ভ্রূণ নষ্ট হওয়া, রক্তক্ষরণ, সংক্রমণসহ নানা জটিলতা বাড়ছে।

Bangladesh Meteorological Department এর তথ্যানুযায়ী ১৯৯১ থেকে ২০২৪ পর্য়ন্ত ২৫ টি ঘূর্ণিঝড় উপকুলে আছড়ে পড়েছে।

Center for Environmental and Geographic Information Services (CEGIS) ২০২২ এর রিপোর্ট বলেছে

প্রতিটি ঘূর্ণিঝড়ুজলোচ্ছ্বাসের পর লবণাক্ততা ২০–৩০% বাড়ে। কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে বেড়িবাঁধ ভেঙে পানি ঢুকে পুকুর–নদী–খালে নোনা পানি জমে থাকা,নলকূপ নষ্ট হওয়াএবং মিঠা পানির উৎস মরে ধ্বংস হওয়া।

মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের উপকূলীয় জনগোষ্ঠীর লবণাক্ততা মোকাবিলায় অভিযোজন সক্ষমতা বৃদ্ধি প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল রেইনওয়াটার হারভেস্টিং, স্বাস্থ্যসচেতনতা, নারীদের মাসিকসেবা ও  নিরাপদ পানি নিশ্চিত করা । কিন্তু IMED এর ২০২৩ সালের পর্যালোচনায় দেখা গেছে ৪৪% রেইনওয়াটার সিস্টেম অচল ও ৫৬% সচেতনতা কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। বাজেট খরচ হয়েছে কিন্তু মাঠপর্যায়ে ফল নেই এমনই অভিযোগ স্থানীয়দের। বানিশান্তা ইউনিয়নের ওয়ার্ড মেম্বর দিলীপ কুমার মন্ডল বলেন,প্রকল্প নামে আছে, কাজ নেই।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্স বিভাগের ২০২৪ সালের এক গবেষনায়  বলছে লবণাক্ততা কারনে নারীর প্রজননক্ষমতা ২০-৩০% কমায়। ফলে জন্মহার কমে যাচ্ছে, জরায়ুর রোগ বাড়ছে। একারনে ভবিষ্যৎ প্রজন্ম জন্মঝুঁকিতে।

খুলনার পরিবেশযোদ্ধা এড.বাবুল হাওলাদার বলেন,উপকূলের নারীরা জলবায়ু পরিবর্তনের এক ফ্রন্টলাইন যোদ্ধা। তাদের স্বাস্থ্য নিয়ে এখনই পদক্ষেপ না নিলে পরবর্তী প্রজন্মও ঝুঁকিতে পড়বে।

নোনা পানি পান করেন, প্রতিদিন ব্যথায় কাটান, গর্ভ হারান,জরায়ু হারান,বয়সের আগেই মেনোপজে পৌঁছান,সন্তান জন্মালে কম ওজন হয়, চিকিৎসা খরচ বহন করতে পারেন না, সুবিধা পান না প্রকল্পের