August 24, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, August 24th, 2025, 12:46 am

বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সকল জাতীয় নেতাকে স্বীকৃতি দিন, শুধুমাত্র একজনকে নয়

 

শেখ মুজিবুর রহমানকে তার প্রকৃত পরিচয়ের জন্য সম্মান জানানো উচিত— আমাদের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতৃত্বদানকারী মশালবাহক হিসেবে। তিনি স্বাধীনতার যে চেতনা তার পতাকা বহন করেছিলেন মুক্তিসংগ্রামে মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করেছিলেন এবং আমাদের সংগ্রামের মুখ হয়ে উঠেছিলেন। তবে ইতিহাসকে সৎ হতে হবে।

১৯৭১ সালের ডিসেম্বর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মুজিব কারাগার থেকে মুক্তি পান এবং লন্ডনে যান। সেখান থেকে নয়াদিল্লি, অবশেষে ১০ জানুয়ারি ১৯৭২- এ ঢাকায় ফিরে আসেন। দুই দিন পর তিনি প্রধানমন্ত্রী হিসেবে শপথ নেন। ওই সময়ের ঘটনা বর্ণনায় তাজউদ্দীন আহমদের কন্যা শারমিন আহমদের দেওয়া এক সাক্ষাৎকার অনুযায়ী, মুজিব ঢাকায় পৌঁছেই তার বাবাকে অনেকের মাঝে ফিসফিসিয়ে জানিয়েছিল যে, তিনি প্রধানমন্ত্রীর পদ নিতে চান।

লন্ডনে থাকা অবস্থায়, ৮ জানুয়ারি ১৯৭২- এ ক্ল্যারিজ হোটেলে বিভিন্ন দেশের সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে মুজিব ঘোষণা করেন যে যুদ্ধে ‘মিলিয়ন মানুষ’ নিহত হয়েছে।

সেই আর্ন্তজাতিক সংবাদ সম্মেলনের অল্প সময় পর, ডেভিড ফ্রস্টকে দেয়া এক টেলিভিশন সাক্ষাৎকারে তিনি ‘তিন মিলিয়ন’ সংখ্যাটিও পুনরাবৃত্তি করেন। পরে দ্য গার্ডিয়ান রিপোর্ট করে যে, তখনকার বিবিসি বাংলা সার্ভিসের ডেপুটি প্রধান সেরাজুর রহমান ‘বিস্মিত ও আতঙ্কিত’ হয়েছিলেন এই দাবিতে এবং তিনি মনে করেছিলেন মুজিব হয়তো তিন লাখ (৩,০০,০০০) এর সাথে তিন মিলিয়ন গুলিয়ে ফেলেছিলেন। তা সত্ত্বেও, এই অতিরঞ্জিত সংখ্যা রাজনৈতিক মিথ নির্মাণে প্রতিষ্ঠিত হয়ে যায়।

মুক্তিযুদ্ধের মাত্র তিন বছরের মধ্যেই স্বাধীনতার গণতান্ত্রিক প্রতিশ্রুতি ভেঙে পড়ে কেন্দ্রীভূত ক্ষমতার রূপ নেয়। মুজিব গঠন করেন বাকশাল, রাজনৈতিক বহুত্ববাদ বিলোপ করেন এবং স্বৈরতান্ত্রিক রাজনীতির ভিত্তি স্থাপন করেন।

২০০৯ সালে ক্ষমতায় ফিরে আসার পর গত ১৬ বছরে আওয়ামী লীগ স্বাধীনতার ইতিহাসে একক নেতার বয়ান প্রতিষ্ঠা করেছে। মুজিবকে জাতির একমাত্র ত্রাণকর্তা হিসেবে তুলে ধরতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ ঢেলে দেওয়া হয়েছে— বিশাল ভাস্কর্য, প্রতিকৃতি, দেয়ালচিত্র, স্মৃতিস্তম্ভ এবং এখানে-সেখানে বিরামহীন একের পর এক প্রদর্শনীতে।

তার চিত্র সর্বত্র অথচ বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় অন্যান্য জাতীয় নেতাদের নাম ইতিহাস থেকে প্রায় মুছে ফেলা হয়েছে। পাঠ্যবইগুলো পুনর্লিখন করা হয়েছে একপাক্ষিক ইতিহাসের সাথে মিলিয়ে। সেই সাথে কোটি কোটি টাকা খরচ করা হয়েছে মুজিবকে এক পৌরাণিক চরিত্রে রূপ দিতে, যেখানে স্বাধীনতার প্রকৃত যৌথ নেতৃত্বকে উপেক্ষা করা হয়েছে।

মুজিব ও তাজউদ্দীন: বাংলাদেশের জেফারসন ও ওয়াশিংটন

আমরা যদি বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার সংগ্রামকে কিংবা মুক্তিযুদ্ধকে আমেরিকান বিপ্লবের সাথে তুলনা করি, মুজিবুর রহমান ছিলেন আমাদের থমাস জেফারসন— যিনি স্বাধীনতার রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি সুসংগঠিত করেছিলেন, জনমানসে আন্দোলনের প্রতীক হয়েছিলেন এবং গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জন্য মুক্তিসংগ্রামের ডাক দিয়েছিলেন।

জেফারসনের মতো, তিনি ছিলেন মেধা ও রাজনীতির মশালবাহক, যুদ্ধকালীন কার্যকর নেতা নন।

অন্যদিকে, তাজউদ্দীন আহমদ ছিলেন আমাদের জর্জ ওয়াশিংটন— যিনি রাজনৈতিক মুখপাত্রের অনুপস্থিতিতে স্বাধীনতার আন্দোলনকে ধরে রেখেছিলেন, বিদেশি জোট (আমাদের ক্ষেত্রে ভারত, ওয়াশিংটনের ক্ষেত্রে ফ্রান্স) নিশ্চিত করেছিলেন, সামরিক ও রাজনৈতিক কৌশল সমন্বয় করেছিলেন এবং ভঙ্গুর জোটকে একত্রে রেখেছিলেন। ওয়াশিংটন ছাড়া আমেরিকার বিপ্লব ভেঙে পড়তে পারত; ঠিক তেমনি তাজউদ্দীন ছাড়া বাংলাদেশের স্বাধীনতা জন্মের আগেই ভেঙে পড়তে পারত।

পার্থক্য হলো, আমেরিকায় ইতিহাস উভয়ের অবদানকেই সমানভাবে সম্মান জানিয়েছে এবং স্মৃতিস্তম্ভে অমর করেছে। বাংলাদেশে সরকারি বয়ান জেফারসনকে মহিমান্বিত করেছে অথচ ওয়াশিংটনকে মুছে দিয়েছে। যেন আমেরিকার ইতিহাসে লেখা হতো জেফারসন একাই যুদ্ধ জিতেছেন আর ওয়াশিংটনকে সম্পূর্ণ অদৃশ্য করে দেওয়া হতো।

জাতীয় আর্কাইভের দাবি

এ কারণেই বাংলাদেশে জরুরি ভিত্তিতে একটি জাতীয় আর্কাইভ প্রতিষ্ঠা করা প্রয়োজন— যা হবে স্বাধীন, নিরপেক্ষ এবং দলীয় নিয়ন্ত্রণমুক্ত। এর অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে থাকতে হবে একটি মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভ।

এই মুক্তিযুদ্ধ আর্কাইভে স্বাধীনতা আন্দোলনের সম্পূর্ণ দলিলভিত্তিক ইতিহাস সংরক্ষিত থাকতে হবে: প্রারম্ভিক রাজনৈতিক সংগ্রাম ও ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে ছয় দফা ও মুজিবনগর সরকার এবং শেষ পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধ ও তার পরবর্তী পরিস্থিতি পর্যন্ত।

এতে বাংলাদেশ রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায় সকল জাতীয় নেতা ও অবদানকারীদের স্বীকৃতি দিতে হবে। যাতে তাদের ত্যাগ-সংগ্রামের গল্পগুলো দলিল, সাক্ষ্য, আলোকচিত্র এবং রেকর্ডিংয়ের মাধ্যমে— বাংলা ও ইংরেজি উভয় ভাষায় সংরক্ষিত থাকে এবং সাধারণ মানুষের জন্য উন্মুক্ত হয়।

গত ১৬ বছর ধরে আওয়ামী লীগ কোটি কোটি টাকা ব্যয় করেছে ভাস্কর্য, দেয়ালচিত্র ও রাষ্ট্র-স্পন্সরকৃত জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠানে— শুধুমাত্র একজন মানুষের প্রতিচ্ছবি অমর করে তুলতে।

অথচ আমাদের প্রকৃত ইতিহাসের আর্কাইভগুলো অবহেলায় পচে নষ্ট হচ্ছে। যদি সেই অর্থের অল্প অংশও একটি স্বাধীন জাতীয় আর্কাইভ গঠনে বিনিয়োগ করা হতো, তবে আজ বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধের একটি পূর্ণাঙ্গ ও সত্যভিত্তিক রেকর্ড থাকত, যা দলীয় বিকৃতির বাইরে। এখন সময় এসেছে মিথকে স্মৃতিস্তম্ভে রূপ দেওয়ার কাজ বন্ধ করে সত্যকে সংরক্ষণের জন্য প্রকৃত প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলার।