পিলখানায় বিডিআর সদর দপ্তরে সংঘটিত সেনা হত্যাযজ্ঞের তদন্তে গঠিত জাতীয় স্বাধীন তদন্ত কমিশনের প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে উঠে এসেছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাতিজা ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপসের নাম। কমিশনের দাবি, পুরো ঘটনার পরিকল্পনা ও সমন্বয়ে তাঁর সংশ্লিষ্টতার ব্যাপক তথ্য-উপাত্ত পাওয়া গেছে। তদন্ত শুরুর আগেও গণমাধ্যমে তাপসকে ঘিরে নানা আলোচনা ছিল।
কমিশনের প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের আগে ভারতীয় পক্ষের সঙ্গে বৈঠকের পর পরিকল্পনা চূড়ান্ত করা হয় এবং এই সমন্বয়ের কেন্দ্র ছিল তাপসের অফিস ও বাসা। অভিযোগ অনুযায়ী, তাপসের অফিসে অনুষ্ঠিত এক বৈঠকে ভারতীয় গোয়েন্দাদের সঙ্গে পিলখানার হত্যাযজ্ঞের পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয়। প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, ভারতের বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ জন সদস্য সরাসরি এই ঘটনায় যুক্ত ছিলেন—এমন সাক্ষ্যপ্রমাণ তদন্তে উঠে এসেছে।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ভারতে পলাতক শেখ হাসিনা ও তাঁর ভাতিজা তাপসের পাশাপাশি শেখ পরিবারের আরেক প্রভাবশালী সদস্য শেখ সেলিমও এই পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন। তৎকালীন স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজও ঘটনাটি সম্পর্কে অবগত ছিলেন বলে কমিশনের দাবি।
তদন্ত কমিশন বলছে, ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ওয়ান-ইলেভেন সরকারের আয়োজন করা নির্বাচনে ভারতের প্রত্যক্ষ সহায়তায় শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসেন। এরপর দুই মাসের মধ্যেই পরিকল্পিতভাবে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের বিডিআরে পদায়ন করা হয়। এর আগে রৌমারী, বড়াইবাড়ী ও পদুয়া সীমান্তে বিএসএফ সদস্য নিহত হওয়ার ঘটনাকে কেন্দ্র করে প্রতিশোধ এবং বাংলাদেশের ওপর আধিপত্য বিস্তারের লক্ষ্যেই হত্যাযজ্ঞ সংঘটিত হয় বলে কমিশনের বিশ্লেষণ।
প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়, পদুয়া ও রৌমারীর যুদ্ধ বিডিআরের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় বীরত্বগাথা, যা ভারত কখনোই মেনে নিতে পারেনি।
প্রায় ১১ মাস তদন্ত শেষে মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের নেতৃত্বাধীন কমিশন গত রোববার প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে ৩৬০ পৃষ্ঠার মূল প্রতিবেদন হস্তান্তর করে। ২০০৯ সালের ফেব্রুয়ারির সেই নৃশংস ঘটনায় ৫৭ সেনা কর্মকর্তাসহ মোট ৭৪ জন নিহত হন।
কমিশনের দাবি, তাপসের বাসায় শেখ ফজলুল করিম সেলিমের উপস্থিতিতে বিডিআর সদস্যদের একাধিক বৈঠক হয়। প্রথমে কর্মকর্তাদের জিম্মি করার সিদ্ধান্ত হলেও পরে তা পরিবর্তন করে হত্যার সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হয়। তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী সোহেল তাজ, শেখ সেলিম এবং ভারতের গোয়েন্দা সংস্থার ২৪ সদস্য একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈঠকে অংশ নেন, যেখানে হত্যার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। অভিযুক্তদের নিরাপদে পালিয়ে যেতে সহায়তার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল তাপসকে—এমন অভিযোগও প্রতিবেদনে উল্লেখ রয়েছে।
পরিকল্পনার বিভিন্ন ধাপে আওয়ামী লীগ নেতা জাহাঙ্গীর কবির নানক, মির্জা আজম, লেদার লিটন ও তোরাব আলী উপস্থিত ছিলেন বলে কমিশনের প্রতিবেদন দাবি করে। ৪৪ রাইফেলস ব্যাটালিয়নের সিও কর্নেল শামসও বিষয়টি সম্পর্কে জানতেন এবং তাপস তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে পরিকল্পনার অনুমোদন নিতেন বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ আছে।
ডাল-ভাত কর্মসূচি নিয়ে সাধারণ বিডিআর সদস্যদের ক্ষোভ উসকে দিয়ে বিদ্রোহ তৈরি করা হয়, যা মূলত সেনা অফিসারদের হত্যার বড় পরিকল্পনা বাস্তবায়নের অংশ—এমন তথ্যও সাক্ষ্যপ্রমাণে উঠে এসেছে। বিভিন্ন বৈঠক হয় তাপস, শেখ সেলিম ও কিছু বিডিআর সদস্যদের মধ্যে বাসা, অফিস এবং মসজিদে। হত্যাকাণ্ড বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিপুল অর্থ বিতরণের কথাও প্রতিবেদনে উঠে আসে।
তদন্তে বলা হয়েছে, সংসদ সদস্য গোলাম রেজা ২০০৯ সালের ২৫ ফেব্রুয়ারির সকালে পিলখানায় আলাউদ্দিন নাসিম, সাবেক এমপি মোর্শেদ, শেখ সেলিম এবং ভারতীয় গোয়েন্দা কর্মকর্তাদের দেখেছেন। ক্যাপ্টেন তানভীর হায়দার নূরও বিদ্রোহ শুরুর পর স্ত্রীকে জানান পিলখানায় ভারতীয় এনএসজি সদস্যদের উপস্থিতির কথা। তার স্ত্রী তাসনুভা মাহা জানান, তিনি বিডিআরের পোশাক পরা তিনজনকে হিন্দিতে কথা বলতে শুনেছেন। এদিন পিলখানায় হিন্দি, পশ্চিমবঙ্গীয় টানে বাংলা ও অচেনা ভাষায় কথোপকথন শোনার কথা বলেন একাধিক সাক্ষী।
প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০০৯ সালের ২৪–২৭ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ৮২৭ জন ভারতীয় পাসপোর্টধারী ও ভারতীয় বংশোদ্ভূত বিদেশি নাগরিক বাংলাদেশে প্রবেশ করেন, যাদের মধ্যে ৬৫ জনের বহির্গমনের তথ্য পাওয়া যায়নি। একই সময়ে ১,২২১ জনের বহির্গমন তথ্য থাকলেও ৫৭ জনের আগমনের কোনো রেকর্ড নেই। বিদেশি ভাষা শোনার ঘটনা, বহিরাগতদের পলায়ন, কল তালিকায় বিদেশি নম্বরসহ বিভিন্ন বিষয়কে কমিশন ভারতের সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ হিসেবে উল্লেখ করেছে।
এনএনবাংলা/

আরও পড়ুন
খালেদা জিয়ার জন্য এয়ার অ্যাম্বুলেন্স পাঠাচ্ছে কাতার, লন্ডনে নিতে প্রস্তুতি সম্পন্ন
নিবন্ধন পাচ্ছে অনশন করা সেই তারেকের ‘আমজনতার দল’
বিএনপি আরও ৩৬ আসনে প্রার্থী ঘোষণা করলো