অভিনয়শিল্পী দম্পতি মাসুম বাসার ও মিলি বাসার সংসার জীবন ৪২ বছরেরছবি
অনলাইন ডেস্ক:
তখন ক্লাস নাইনে পড়ি। বাবার বদলির চাকরির কারণে ঢাকায় নতুন এসেছি। পুরোনো বন্ধুবান্ধবকে ছেড়ে আসায় মন খুব খারাপ থাকত। একদিন ছোট মামা (ঢাকা থিয়েটারের কর্মী আশরাফ হোসেন) এসে বললেন, চল তোকে এমন একটা জায়গায় নিয়ে যাব, যেখানে গেলে মন ভালো হয়ে যাবে। তাঁর হাতে ধরেই ঢাকা থিয়েটারের সঙ্গে যুক্ত হই। মাসুম তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, ঢাকা থিয়েটারের সক্রিয় কর্মী। মামার বন্ধু হিসেবেই যেহেতু পরিচয়, সবার মতো তাকেও মামা বলেই ডাকতাম।’ বলছিলেন মিলি বাসার।
১৯৭৭ সালে এভাবেই প্রথম পরিচয়। আর এই পরিচয়ই ১৯৮২ সালে পরিণয়ে গড়ায়। ধানমন্ডির বাসায় বসে অভিনয়শিল্পী দম্পতি মাসুম বাসার ও মিলি বাসার যখন ৪২ বছর আগের পরিচয়পর্বের গল্প শোনাচ্ছিলেন, তখনো তাঁদের চোখেমুখে খেলা করছিল সেদিনের মুগ্ধতা।
যেভাবে বিয়ে হলো
মিলি বাসারের কাছে ঢাকা থিয়েটার অচিরেই সেকেন্ড হোম হয়ে ওঠে। থিয়েটারের মেয়ে কর্মীদের অন্য সহকর্মীরা বাসা থেকে নিয়ে ও দিয়ে আসত। মিলিকে নিতে যে দুই-তিনজন আসতেন, তাঁদের মধ্যে সব সময় মাসুম থাকতেন। ‘তখন থেকেই মিলিকে মনে মনে পছন্দ করি। কিন্তু কীভাবে বলব, বুঝতে পারছিলাম না। প্রত্যাখ্যানের ভয় ছিল, এ ছাড়া মনে হয়েছে মিলি যদি দলে না আসে, তাহলে তো আমাদের দলের একজন নারী সদস্য কমে যাবে,’ তখনকার মনের অবস্থাটা মাসুমের আজও মনে আছে। থিয়েটারে এমনিতেই তখন নারী সদস্য কম ছিল। এসব সাতপাঁচ ভেবে মিলিকে মনের কথাটা জানাতে পারছিলেন না মাসুম।
মিলি বাসারছবি
গ্রুপে সুবর্ণা মুস্তাফা ছিলেন মাসুম বাসারের সবচেয়ে কাছের বন্ধু। শেষে তিনিই এগিয়ে এলেন। শো শেষে বাসায় ফেরার সময় একদিন সুবর্ণা মুস্তাফা মিলির ভাইকে বলেন, মিলি আর আমি এক রিকশায় যাব, তুমি মাসুমের সঙ্গে ওঠো। রিকশায় উঠেই সুবর্ণা মিলির কাছে জানতে চান, মাসুমকে তোর কেমন লাগে? মিলি বললেন, ভালোই তো লাগে। সুবর্ণা তখন ঘুরিয়ে জানতে চান বিশেষ কোনো ভালো লাগা আছে কি না, তারপরও মিলি যখন বুঝতে পারলেন না, তখন বলেই ফেললেন, মাসুম তোকে বিয়ে করতে চায়। আকাশ থেকে পড়েন মিলি, ‘এটা কীভাবে হয়, মাসুম তো আমার মামা হন।’ শুনে সুবর্ণা মুস্তাফা কিছুটা রাগই করেন, মামা মানে? সেকি তোর মায়ের পেটের ভাই নাকি?
‘বেশ ঘাবড়ে যাই। বাসায় ফিরে ভাইকে সব বললাম। তারপর মাসুম আর আমাকে নিতে আসে না, আসে মাসুমের আরেক বন্ধু থিয়েটারকর্মী জহির উদ্দীন পিয়ার। থিয়েটারেও তার দেখা পেতাম না। আমার বড় ভাই মাসুম সম্পর্কে সব খোঁজখবর করে। তবে মাসুম যে আমাকে নিতে আসত না, বিষয়টি আমার মা খেয়াল করল। তখন আসলেই মাসুমের প্রতি একধরনের কষ্টের অনুভূতি কাজ করা শুরু করল। সুবর্ণা আপা, পিয়ার ভাই, সাইফুল ইসলাম মাহমুদ (অভিনেতা রাইসুল ইসলাম আসাদের ছোট ভাই) ভাইরা যখন আমার মতামত জানতে চাইল; বললাম, হুম আমারও কেমন অনুভূতি হচ্ছে। সেই শুরু।’
মামার বন্ধু হিসেবেই যেহেতু পরিচয়, সবার মতো তাকেও মামা বলেই ডাকতেন মিলি বাসারছবি
সেই সময়ই মাসুম সুইডেনে উচ্চশিক্ষার্থে বৃত্তি পান। তখন মাসুমের মা মিলিকে পারিবারিকভাবে দেখতে যেতে চান। যেহেতু মিলির বাবা দেশের বাইরে থাকতেন, তাই প্রথমে মিলির মা রাজি ছিলেন না, তবে মাসুমের পরিবার থেকে বলা হয় বাইরের কেউ এই কথা জানবে না। দেখতে এসে মিলিকে তিনি আংটি পরিয়ে যান। মাসুম সুইডেনে চলে যাওয়ার পরপরই মিলিদেরও ইরাকের ভিসা হয়ে যায়। যেখানে যাওয়ার পর বিভিন্ন জায়গা থেকে মিলির বিয়ের প্রস্তাব আসতে থাকে। তখন মিলির মা মাসুমের ব্যাপারে স্বামীকে কিছুটা আভাস দিয়েছিলেন। মাসুমের সঙ্গে যোগাযোগও বেশ কষ্ট করে করতে হয় সে সময়। মিলিকে ১০ পাতার চিঠি লিখতেন মাসুম, একমাস পর মিলির হাতে এসে পৌঁছাত সেই চিঠি। এভাবেই চলছিল মাসুম-মিলির জীবন। এর মধ্যে মাসুমের বাবা মিলির বিষয়টি জানতে পেরে তাঁর পরিবার সম্পর্কে খোঁজখবর নেন। মিলির পারিবারিক পরিচয় জানতে পেরে তিনি আর দেরি করতে চাননি। অনেকটা গোপনেই ছেলেকে না জানিয়েই বিয়ের ব্যাপারে মিলির বাবাকে চিঠি লেখেন। তারপরও একমাত্র মেয়ের ব্যাপারে এত বড় সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে তার কোনো মতামত নেওয়া হয়নি বলে বেশ রেগে যান বাবা। মিলির ভাই তাঁদের বাবাকে মাসুমের প্রতি আস্থা রাখতে বলেন। ১৯৮৩ সালে দেশে ফেরে মিলির পরিবার। ৩০ জুলাই বেইলি রোডের লেডিস ক্লাবে মিলি-মাসুমের বিয়ে হয়ে যায়।
তারপর ৪২ বছরে একটি বারের জন্যও একে অপরের হাত ছাড়েননি মাসুম বাসার-মিলি বাসার। তাঁদের এই সতেজ সম্পর্কের রহস্য কী, জানতে চাইলে দুজনেই বললেন, একে অপরের প্রতি আস্থা। এখনো নতুন করে একজন আরেকজনকে আবিষ্কারের চেষ্টা করেন। একে অপরের ব্যক্তিগত জায়গায় কেউ ঢোকেননি। কাজের জায়গাতেও নয়। বিয়ের পর দীর্ঘদিন সৌদি আরবে ছিলেন এই দম্পতি। অভিনেতা মাসুম বাসার বলছিলেন, সৌদি আরবে থাকতে কাজ শেষে যখন বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা দিতাম, কখনোই মিলি ফোন দিয়ে বিরক্ত করত না বা কেন আড্ডা দিচ্ছি, কৈফিয়ত চাইত না। অন্য বন্ধুদের স্ত্রীরা দেখতাম বারবার ফোন দিয়ে বিরক্ত করত। মিলি বলছিলেন, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক যেন এমন না হয়, যাতে দুজনেরই দম বন্ধ লাগতে থাকে। এ জন্য নিজেদের মধ্যে ব্যক্তিগত জায়গা থাকা খুব জরুরি। এ কারণে দীর্ঘ পথচলায় কখনো একঘেয়েমি আসেনি। মিলি বাসার জানালেন, কখনোই কোনো বড় বিষয় নিয়ে তাঁদের মধ্যে মনোমালিন্য হয়নি। কারণ হিসেবে মাসুম বললেন, মিলির মধ্যে নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি নেই। আমার মায়ের কাছে ও যেমন প্রিয় ছিল, তেমন আমার ভাগনে–ভাগনিদের কাছেও প্রিয়।
মাসুম বাসার
‘আসলে মনের মধ্যে কোনো বাজে চিন্তা আসার সুযোগ আমি দিই না। কারও আচরণ বা কারণে মন খারাপ হলে দোষারোপ না করে সৃজনশীল কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখি। ছবি আঁকি, লেখালেখি করি,’ বলছিলেন মিলি বাসার।
মজা করেই মাসুম বাসার বললেন, বিদেশে থাকতাম, ঝগড়া করে কোথায়–বা যাবে বলেন, বাবার বাড়ি তো ছিল না। দুজনই হো হো করে হেসে উঠলেন। বিয়ের পর দীর্ঘ সময় প্রবাসে কেটেছে। তাঁদের দুই সন্তানের জন্মও সেখানে হয়েছে। বড় মেয়ে নাবিলা বাসার এখন কানাডাতে থাকেন। ছোট মেয়ে নাজিবা বাসার ডেইলি স্টার–এর জ্যেষ্ঠ সহসম্পাদক।
২০১২ সালে দেশে ফিরে দুজনে আবার কাজে নিয়মিত হন। গত সোমবার তাঁদের সঙ্গে যেদিন কথা হচ্ছিল, তার আগের দিন রাত দুইটায় শুটিং শেষ হলে মিলি বাসারকে বাসায় নিয়ে আসেন মাসুম বাসার। বলছিলেন, ঢাকায় জন্ম হলে কী হবে, এখানকার রাস্তাঘাট এখনো মিলি কিছুই চেনে না। সঙ্গে সঙ্গে মিলি যোগ করলেন, আমাকে পথ চেনানোর দায়িত্ব তো তোমার। সেই ১৮ বছর বয়সে তোমার হাত ধরে পথচলা শুরু করেছি। বলতে বলতে দুজনেই কিছুটা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। মাসুম বাসার বলছিলেন দিনে দিনে একজনের প্রতি আরেকজনের নির্ভরতাটা এত বেড়েছে যে এখন শুধু ভয়, একজন যদি আগে চলে যাই, আরেকজন তাহলে কীভাবে বাঁচব। বয়স তো আর থেমে নেই।
আরও পড়ুন
বাড়িতে ভয়াবহ সন্ত্রাসী হামলায় আহত দিতিকন্যা লামিয়া
ইংলিশদের ঝড় থামিয়ে দিল অস্ট্রেলিয়া
পাঁচ দফা দাবিতে ইন্টার্ন চিকিৎসক ও মেডিকেল শিক্ষার্থীদের সড়ক অবরোধ