বাংলাদেশের রাজধানী শহর ঢাকার মহম্মদপুরের নুরজাহান রোডে আমার আত্মীয় বাকির মুর্শেদের বাড়িতে সেদিন আড্ডাটা জমে উঠেছিল। ২০২৩ সালের মে মাস। মহম্মদপুরে যত ভারতীয় ওরিজিন বাংলাদেশী আছেন তারা আমাকে দেখতে এসেছিলেন। ভারতীয় মানে সোজা কথায় পশ্চিমবঙ্গ ওরিজিন বাংলাদেশিদের কথাই বলছি। সুজাউদ্দিন ভাই আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, আচ্ছা, মুর্শিদাবাদের সালার থানার গুলহাটিয়া হাইস্কুলের সে পুরানো বিল্ডিংটা কি আছে? আমি বললাম না। আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ভরতপুর-সালার থানার বিনোদিয়া, সৈয়দগুলুট, শাহপুর রাইগ্রাম মোড় ও পশ্চিমে করন্দী পর্যন্ত যে বিশাল বিল রয়েছে, বাবলা গাছ প্রচুর , সেই বিলের কী অবস্হা? আমি বললাম,সেই বিল রয়েছে। তবে এখন এগুলো ব্যবসায়ী বা কর্পোরেটের দখলে। আগে এই বিলের জমির দাম ছিল ২০০ টাকা বিঘা। এখন তা এক লাখ টাকা বিঘা। প্রতিদিন জমির দাম বাড়ছে।
পূর্ববর্ধমানের কাটোয়া থানার করজগ্রামের এক ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করছেন, আচ্ছা কাটোয়া স্টেশন টা এখন কী রকম হয়েছে? আমি বললাম , কাটোয়া এখন বর্ধমানের অন্যতম জংশন স্টেশন। তার পরিকাঠামোর ব্যাপক বদল ঘটে গেছে। কাটোয়া-বর্ধমান বা কাটোয়া-আমোদপুর যে ছোটো লাইন ছিল তা এখন ব্রডগেজে পরিণত।
হাওড়া জেলার বাগনানের এক বাসিন্দা জিজ্ঞাসা করলেন হাওড়ার ব্রিজ নিয়ে। আমি সবার প্রশ্নের একের পর এক জবাব দিলাম।
আমি নানাজনের প্রশ্ন শুনে শুধু এটাই ভাবলাম যে, মানুষের কত শিকড়ের টান। তাই তার ভিটেমাটি ফেলে আসা শিকড়ের খবর নেওয়ার আকুলতা।
বোঝাই যাচ্ছে দেশভাগের কারণে পারাপারটা শুধু একপক্ষীয় ছিল না। ছিল দ্বিপক্ষীয়। উল্লেখ্য , মুর্শিদাবাদে ভরতপুর থানার করন্দী গ্রামের ভূমিপুত্র ছিলেন বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন বিখ্যাত ছাত্রনেতা , বঙ্গবন্ধুর অন্যতম খলিফা ও ডলারম্যান হিসাবে খ্যাত প্রয়াত নুরে আলম সিদ্দিকী।
বাকির মুর্শেদের বাড়িতে ছিল আমার এক নানা আব্দুর রকিবের ছেলে আব্দুস সালাম(বাবু)। ওরা থাকে তাজমহল রোডে। ২০১২ ও ২০১৫ সালে বাবুদের বাড়িতে গিয়ে আমার সেই রকিব নানাকে জিজ্ঞাসা করছি, নানা , আপনার শেষ সাধ বা ইচ্ছা কী? রকিব নানা সেদিন বলেছিলেন, ভাই বয়স নব্বইয়ের উপর হয়ে গেছে। আমার শেষ ইচ্ছা আমার কবরটা যদি আমার মুর্শিদাবাদের সালারের রাইগ্রামের মাটিতে হত তাহলে আমার সব সাধ পূরণ হয়ে যায়। কিন্তু রকিব নানার সেই সাধ পূরণ হয়নি। যার বাড়িতে মিলিত হয়েছি সেই বাকির মুর্শেদ আমার নানি হাসিনা খাতুনের ছোট চাচা জবরদস্ত আলেম মৌলানা জাকির হোসেনের ছেলে। আমার নানি হাসিনা খাতুন তার চাচা জাকির হোসেনেরর সঙ্গে যোগাযোগ রাখতেন চিঠিপত্রে । দারুল উলুম দেওবন্দের ছাত্র। পরে কলাতার আলিয়া মাদ্রাসাতে পড়াশোনা করে চলে যান ময়মনসিংহের হালুয়াঘাট । সেখানেই স্হায়ীভাবে বসবাস করেন। রকিব নানা হলেন আমার নানি হাসিনা খাতুনের দু’বছরের বড়। আরেকটা চাচাইতো ভাই। কত লোকের সঙ্গে সেদিন মহম্মদপুরে পরিচয় হয়েছিল যারা ভারতীয় ওরিজিন।ঠিক একই অবস্হা পশ্চিমবঙ্গে বসবাসকারী পূর্ববঙ্গের বা অধুনা বাংলাদেশের ওরিজিন বাঙালিদের। তারাও তাদের ভিটেমাটি ও শিকড় ভুলতে পারে না। শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক বলেছিলেন, বঙ্গদেশ ভাগ হতে পারে। কিন্তু বাঙালি জাতিসত্ত্বা কোনোদিন ভাগ হতে পারে না।
দেশভাগ-ভিটেমাটি ছাড়ার ইতিহাস কলকাতা কেন্দ্রিক সাহিত্যিক যারা পূর্ববঙ্গের ওরিজিন তাদের কবিতা ও কথাসাহিত্যে যেভাবে শক্তিশালী হয়েছে, ঢাকা কেন্দ্রিক ভারতীয় ওরিজিন সাহিত্যিকদের মধ্যে ততখানি নয়। মানে শক্তিশালী নয়। কলকাতার বাংলাদেশ ওরিজিন সাহিত্যিক সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের কবিতা ‘কেউ কথা রাখেনি’ বা উপন্যাস ‘ পূর্ব-পশ্চিম’, মণিশঙ্কর মুখোপাধ্যায়ের(শঙ্কর) ‘এপার বাংলা ওপার বাংলা’, প্রফুল্ল রায়ের ‘কেয়াপাতার নৌকা’, অতীন বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘নীলকন্ঠ পাখির খোঁজে’ , দেবেশ রায়ের ‘তিস্তা পারের বৃত্তান্ত’-র মধ্যে দারুণভাবে ফুটে উঠেছে। এমনকি কলকাতার সিনেমাতেও বিষয়গুলি সুন্দরভাবে ফুটে উঠেছে। সাহিত্যিক সাধন চট্টোপাধ্যায়ের ‘ দেশভাগের গল্প ‘ আরো একটি ভালো কথাসাহিত্য। তপন রায়চৌধুরীর ‘বাঙ্গাল নামা’ আরো একটি সৃজনশীল গ্রন্হ।
কিন্তু দু:খের বিষয়, এই বিষয়গুলি ঢাকাতে প্রতিষ্ঠিত ভারতীয় বা পশ্চিমবঙ্গ ওরিজিন সাহিত্যিকদের মধ্যে তা ফুটে উঠেনি । ঢাকার চলচ্চিত্রেও সেভাবে ফুটে উঠেনি। দায়িত্বটা তাদের ছিল। তবে একেবারেই যে হয়নি তা নয়। যেমন কথাসাহিত্যিক হাসান আজিজুল হকের ‘আগুন পাখি’-তে ফুটে উঠলেও বইটই ছিল কিছুটা ফরমায়েসি। হাসান আজিজুল হকের ছোটগল্প ‘আত্মজা ও একটি কবরী গাছ’-এ প্রথম দেশভাগের প্রতিফলন। ‘আগুন পাখি ‘ এক নারীর অসাধারণ জাগরণ ফুটে উঠেছে। হাসান আজিজুল হকের পৈতৃক নিবাস ছিল বর্তমান পূর্ব বর্ধমান জেলার মঙ্গলকোর্ট থানার জগ্রাম(জবগ্রাম)। তার লেখাকে অভিনন্দন জানিয়ে বলব তা সেভাবে ধারালো হয়ে উঠতে পারেনি। বিখ্যাত গবেষক ও লেখক আনিসুজ্জামান রচিত ‘ কাল নিরবধি’-তে দুচার লাইনের স্মৃতিকথা। তার বেশি কিছু নয়। বরং তার চেয়ে অনেক বেশি শক্তিশালী গবেষক -লেখক-কবি আব্দুল মান্নান সৈয়দের স্মৃতি কথা। দুজনের পৈতৃক নিবাস বর্তমান উত্তর ২৪ পরগণার বাদুড়িয়া থানার মাহমুদপুর গ্রাম। সেকথা আব্দুল মান্নান সৈয়দের কথাতে ফুটে উঠলেও আনিসুজ্জামানের কথাতে সেভাবে উঠে আসে না। আনিসুজ্জামানের দাদু কবি শেখ আব্দুর রহিম ছিলেন বিখ্যাত ‘হাফেজ’, ‘ মিহির’ ও ‘মোসলেম প্রতিভা’ পত্রিকার সম্পাদক।
শওকত ওসমানের ‘জননী’ অনেকটাই শক্তিশালী।
এছাড়াও বেশি শক্তিশালী সাহিত্যিক শওকত আলীর ‘ওয়ারিশ’ নামে একটা অসাধারণ উপন্যাস । এই শওকত আলী হলেন পশ্চিমবঙ্গের উত্তরদিনাজপুরের রায়গঞ্জের উকিলপাড়ার ভূমিপুত্র । অসাধারণ এই উপন্যাস । কী তার শৈল্পিক গড়ন। দু:খের বিষয় ঢাকার চলচ্চিত্রেও ও দেশের পশ্চিমবঙ্গ ওরিজিনদের ভিটেমাটি ছাড়ার কাহিনী উঠে আসেনি। যে দায়িত্ব কলকাতা পালন করেছে।
অনেকে বলেন , দেশভাগের পরেও পশ্চিমবঙ্গের দু-তিনজন শক্তিশালী মুসলিম সাহিত্যিক এটা করতে পারতেন। আমি বলব, কেন তারা কি দেশ ছেড়েছেন , তাই করবেন? তারা তো এই পশ্চিমবঙ্গেই প্রতিষ্ঠিত অনেক লড়াই করেই। তবুও বলব সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের ‘ অলীক মানুষ’, আব্দুল জব্বারের ‘ বাংলার চালচিত্র’ , আফসার আহমেদের ‘মেটিয়াবুরুজের কেচ্ছা’ কম কি? আমরা এদের সম্পর্কে কতখানি সচেতন?
একই ভাষাভাষী মানুষকে ধর্মের দোহাই দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে রাজনৈতিকভাবে ভাগ করা যায়, কিন্তু তাদের ইতিহাস-ঐতিহ্যকে কি ভাগ করা যায়? মোটেই না। আমরা তাহলে রবীন্দ্রনাথ-নজরুলকে কী করে ভাগ করব।
আমরা নায়করাজ আব্দুর রাজ্জাককে নিয়ে খুব ব্যস্ত হয়ে পড়ি। তিনি বাংলাদেশের উত্তম কুমার। এটা অস্বীকার করার উপায় নেই। এই রাজ্জাকের আসল ওরিজিন হল কলকাতার টালিগঞ্জের কাছে নাকতলা। ১৯৬৪ সালের দাঙ্গার ক্ষতচিহ্নের অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি পশ্চিমবঙ্গ ছাড়েন রাতের অন্ধকারে।
তার আগে বাংলাদেশের আরো এক অভিনেতা স্বপ্নপুরুষ আরিফুল হকের কথা কি আমরা জানি?এই আরিফুল হক শতবর্ষ ছুই ছুই অবস্হায় আজ রয়েছেন হেমিলটনে। আরিফুলের ওরিজিন হল হাওড়া জেলার বাগনান থানার মহাদেবপুর গ্রাম। উলুবেড়িয়া কলেজের পদার্থবিদ্যা অনার্সের মেধাবী ছাত্র। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। ব্যারাকপুর সেনানিবাসে চাকুরি পান। ষাটের দশকের শুরুতেই একটা দাঙ্গার ক্ষতচিহ্ন তাকে দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য করেছিল। কলকাতাতে টুকটাক অভিনয় করতেন। পরে ১৯৬০-৬১ সালে তৎকালীন পূর্বপাকিস্তান যান। সামরিক কর্তা ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের পি এস ছিলেন। ঢাকা চলচ্চিত্রে অভিনয় করতেন। অথচ আমরা তা জানিই না। আজো হেমিলটনে তিনি স্মৃতিচারণা করে বলেন , এখানকার আকাশে যত মেঘ দেখি , তা বাগনান বা উলুবেড়িয়া থেকে আসে।
আমরা অনেকেই জানি না , বাংলাদেশের তত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান বিচারপতি অধ্যাপক হাবিবুর রহমান বিশ্বাস ছিলেন মুর্শিদাবাদের জঙ্গিপুরের দয়ারামপুর গ্রামের ভূমিপুত্র। তার পিতা মৌলভী জহিরুদ্দিন বিশ্বাস ছিলেন পেশায় আইনজীবী ও মুসলিম লীগের নেতা। অতিরিক্ত নজরদারির ফলে তিনি ভারত ছাড়েন।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের টপার ছাত্র ও কবি শঙ্খ ঘোষের সহপাঠী বাংলাদেশের প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ আনোয়ার পাশা । মুর্শিদাবাদের বহরমপুর থানার কর্ণসুবর্ণের কাছে ডবকাই গ্রামের তিনি ভূমিপুত্র। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক মনোনীত না করায় তিনি ১৯৫৮ সালে দেশ ছাড়েন। প্রথমে পাবনা এর্ডুয়ার্ড কলেজ , পরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেন। আবার তৎকালীন পূর্বপাকিস্তানে মুক্তিযুদ্ধে যোগ দেন। এরকম অনেক নাম রয়েছে। ভাষা-শহীদ আবুল বরকত বা শফিউর রহমান শফিরাও ছিলেন মুর্শিদাবাদের সালার থানার বাবলা গ্রাম ও হুগলি জেলার কোন্নগরের ভূমিপুত্র। হায়াত মামুদ, বশির আল হেলাল, থেকে শতাধিক গুনী মানুষের ওরিজিন তো পশ্চিমবঙ্গ। ১৯৯২ সালে বাবরি ধ্বংসের পরেও অনেক মানুষ বিপন্ন হয়ে দেশ ছাড়েন। আমরা কতটুকু খোঁজ নিয়েছি? এমাজুদ্দিন আহমেদ বা অধ্যাপক ওয়াকিদ আহমেদ মালদহ ও মুর্শিদাবাদের ভূমিপুত্র। নজরুল গবেষক দরবার-এ-আলম উত্তর ২৪ পরগণার দেগঙ্গার ভাসিলিয়া গ্রামের ভূমিপুত্র । প্রখ্যাত ভাষাতত্ত্ববিদ জ্ঞানতাপস ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ উত্তর ২৪ পরগণার হাড়োয়া থানার পিয়ারা গ্রামের সন্তান। বিজ্ঞানী কুদরতে খোদা বীরভূমের মাড়গ্রামের সন্তান। ডায়াবেটিসের প্রখ্যাত চিকিৎসক ও আইকন ডা: মহম্মদ ইব্রাহিম মুর্শিদাবাদের সালারথ থানার খাঁড়েরা গ্রামের সন্তান। প্রখ্যাত ধ্বনিতত্ববিদ মুহাম্মদ আব্দুল হাই মুর্শিদাবাদের রানিনগর থানার মরিচা গ্রামের সন্তান। স্বয়ং রাষ্ট্রপতি প্রয়াত জেনারেল হোসেন মহম্মদ এরশাদ কোচবিহারের দিনহাটার সন্তান। এইভাবে দেখলে তালিকা দীর্ঘ হবে।
এই দেশভাগকে কেন্দ্র করে আমার দুটি উপন্যাস
‘প্রত্যাবর্তন’ ও ‘ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদ’ বের করেছে বাংলাদেশের ঢাকার শিখা প্রকাশনী ।
আরো একটা উপন্যাস ‘পলাশীর কান্না’ কলকাতার একটা প্রকাশনা ছাপার কাজ করছে। প্রথম দুটো উপন্যাসের সাড়া পাচ্ছি। এটাই সবচেয়ে বড় পুরস্কার। তাই একথা নির্বিঘ্নে বলতে পারি যে, দেশভাগের পর পারাপার শুধু একপক্ষীয় ছিল না, ছিল দ্বিপক্ষীয়।
[লেখক কলকাতার বিশিষ্ট সাংবাদিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট ও কবি]

আরও পড়ুন
জাতি আশায় বুক বেঁধে আছে
ভাষাতত্ত্ববিদ-জ্ঞানতাপস ড: মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ভাষা আন্দোলনের স্বপ্নদ্রষ্টা
কাজী নজরুল ইসলামের রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা ও কারাবাস