তথ্যপ্রযুক্তি ডেস্ক:
সম্প্রতি টিকটকে ব্লুটুথ ইয়ারবাড ব্যবহার নিয়ে কিছু ভিডিও এমন বিতর্ক উসকে দিয়েছে। ভিডিওটির শিরোনাম, ‘কেন আপনি এখনই আপনার ইয়ারপড ছুড়ে ফেলে দেবেন?’ এতে বলা হচ্ছে, ব্লুটুথ ইয়ারবাড থেকে নির্গত তরঙ্গ মস্তিষ্কের ক্ষতি করছে।
প্রায় একই ধরনের উৎকণ্ঠা ছড়ানো ভিডিও অন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমেও দেখা যাচ্ছে। এসবে বলা হচ্ছে, ব্লুটুথ ইয়ারবাডের কারণে মস্তিষ্কের ক্যানসার, স্মৃতিভ্রম, মানসিক ক্লান্তিসহ নানা স্বাস্থ্যগত সমস্যা তৈরি হয়।
কিছু যোগাযোগমাধ্যম এসব ভিডিও সরিয়েও ফেলেছে। তারা বলছে, ভিডিওগুলো স্বাস্থ্যবিষয়ক ভুল তথ্য ছড়াচ্ছে। কিন্তু ভিডিওগুলোর দাবি কি একেবারেই অমূলক? তা বুঝবেনই-বা কী করে? শুধু তারহীন এই ইয়ারবাড ব্যবহারের সুবিধা নেওয়ার জন্য এত বড় ঝুঁকি নেওয়া কি ঠিক হবে? বিশেষ করে যেখানে ক্যানসারের মতো রোগের কথা বলা হচ্ছে?
ব্লুটুথ ইয়ারবাড ক্যানসারের কারণ কি না, একেবারে পরিষ্কারভাবে এর জবাব দেওয়া কঠিন। এর উত্তর কতটা সঠিক, তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। ইয়ারবাড পৃথিবীব্যাপী বেশ জনপ্রিয় এবং অপেক্ষাকৃত নতুন প্রযুক্তি। তারহীন প্রযুক্তি ১৯৯০-এর দশক থেকে ছড়িয়ে পড়লেও ইয়ারবাডের প্রচলন হয়েছে মাত্র কয়েক বছর আগে। এত কম সময়ের মধ্যে বিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরাও এখনো এর ব্যবহারের দীর্ঘমেয়াদি ফলাফল সম্পর্কে পুরোপুরি ওয়াকিবহাল নন।
ড. নাভিদ ওয়াগলে নামের একজন নিউরো-ক্যানসার বিশেষজ্ঞ বলছেন, ‘প্রায়ই আমার রোগীদের কাছে একটা উদ্বেগের কথা শুনি। সেটা হচ্ছে, তাঁদের মুঠোফোন বা ইয়ারবাড মস্তিষ্কের ক্যানসার তৈরি করছে কি না। সংক্ষেপে এর জবাব হচ্ছে, সম্ভবত এটাই এর একমাত্র কারণ নয়।’
ড. নাভিদ যোগ করেন, ‘আমাদের কাছে এ ব্যাপারে এখন পর্যাপ্ত তথ্য নেই, যার ভিত্তিতে এর নিশ্চিত উত্তর দেওয়া যায় অথবা বলা যায়, এসবের কোনো ভূমিকা আছে কি না।’
তারহীন ইয়ারবাডের সঙ্গে ক্যানসারের কার্যকারণ
শুরুতেই পদার্থবিদ্যার একটা ছোট্ট পাঠ দেখা যাক। তারহীন যন্ত্রগুলো ব্লুটুথ প্রযুক্তি ব্যবহার করে। ব্লুটুথ এমন দুটি যন্ত্রের মধ্যে সংযোগ স্থাপন করে, যেসব অল্প দূরত্বে অবস্থিত। যেমন আমাদের হাতের ফোন থেকে হেডফোন বা ইয়ারফোন পর্যন্ত।
যুক্তরাজ্যের ইনস্টিটিউট অব ফিজিকসের মতে, ব্লুটুথ বেতার তরঙ্গের অতি উচ্চ তরঙ্গদৈর্ঘ্য আকারে খুব অল্প বিকিরণ নিঃসরণ করে। এর তরঙ্গের পাল্লা মাত্র ২ দশমিক ৪০২ থেকে ২ দশমিক ৪৮ গিগাহার্টজ। প্রকৃতপক্ষে তারহীন ইয়ারবাডগুলো মুঠোফোনের চেয়ে কম তরঙ্গ নিঃসরণ করে। ২০১৯ সালে এনভায়রনমেন্ট জার্নালে প্রকাশিত গবেষণাপত্রে বলা হয়, স্মার্টফোনের তুলনায় তারহীন ইয়ারফোন ১০ থেকে ৪০০ গুণ কম তরঙ্গ বিকিরণ করে।
আদতে আমরা প্রতিনিয়তই এমন অল্প পরিমাণ বিকিরণের মধ্যে থাকি। এটা কম্পিউটার থেকেও হয় কিংবা সূর্য থেকেও আসে। তাহলে এর কোনোটা কি ক্যানসার তৈরির মতো তরঙ্গ বিকিরণ করে?
ইয়ারবাডের মতো অল্প বেতার তরঙ্গের বিকিরণ থেকে ইঁদুরের শরীরে ক্যানসার দানা বাঁধার কিছু প্রমাণ মিলেছে। ২০২০ সালে ন্যাশনাল টক্সিকোলজি জার্নালে প্রকাশিত ইঁদুরের ওপর পরিচালিত একটি গবেষণায় বলা হয়, বেতার তরঙ্গের মতো বিকিরণ থেকে এদের হৃৎপিণ্ড, মস্তিষ্ক ও অ্যাড্রিনাল গ্রন্থির কিছু ম্যালিগন্যান্ট টিউমার সৃষ্টি হয়। তবে মানুষের ওপর পরিচালিত গবেষণায় এ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
ঝুঁকি সম্পর্কে জানুন
ড. নাভিদ ওয়াগলে বলেন, ক্যানসার সৃষ্টির ঝুঁকি কম মানে কিন্তু এই নয় যে ঝুঁকি একেবারে নেই। এটা ব্যক্তিভেদে ভিন্ন হতে পারে। আপনার তারহীন যন্ত্র থেকে কত বিকিরণ বের হচ্ছে, তা নির্ভর করছে আপনি কত সময় ইয়ারবাড ও ফোন ব্যবহার করছেন। এসব যন্ত্র আপনার শরীরের কোথায় অবস্থান করছে। এ ছাড়া আপনার ক্যানসারের ঝুঁকি কতটা, তা আপনার পারিবারিক ইতিহাস, ওজন, খাবারদাবার, অসুস্থতা ইত্যাদির ওপর নির্ভর করে।
ইয়ারবাডের কারণে অন্য অসুবিধা
ইয়ারবাড ব্যবহারের কারণে ক্যানসার না হতেই পারে, কিন্তু অন্য অসুখবিসুখ যে হয় না, তা কিন্তু নয়। ব্রাইয়া কলিনস নামের একজন শ্রবণ-বিশেষজ্ঞ বলছেন, ইয়ারবাডের কারণে নিচের অসুবিধাগুলো হতে পারে।
১. শ্রবণশক্তি হ্রাস
যখন আপনি ইয়ারবাড ব্যবহার করছেন, তখন কানের পর্দার একেবারে কাছে শব্দ তৈরি হচ্ছে। এটা প্রয়োজনের চেয়ে বেশি তীব্র শব্দ তৈরি করছে। তাই দীর্ঘ সময় ইয়ারবাড ব্যবহারে শ্রবণশক্তি কমে যেতে পারে।
২. কানে শোঁ শোঁ শব্দ শোনা
ইয়ারবাড ব্যবহারের কারণে আপনার কানের ভেতরে শোঁ শোঁ শব্দ শোনার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে। মনে হতে পারে, কানের ভেতর কোনো কিছু একটানা বেজে চলেছে।
৩. কানে মোম জমা
কানে মোম জমাট বাঁধা নির্ভর করে আপনার কানের নালির আকার কেমন এবং আপনি কত বড় বা ছোট আকারের ইয়ারবাড ব্যবহার করছেন, তার ওপর। কানে মোম জমাট বাঁধলে কানের মধ্যে চাপ, ব্যথা বা কম শুনতে পাওয়ার মতো সমস্যা তৈরি হতে পারে।
৪. কানে সংক্রমণ
ইয়ারবাড বারবার ভেতরে ঢোকানোর কারণে এর মাধ্যমে কানের ভেতরে জীবাণু ঢুকতে পারে। এই জীবাণু কানের ভেতরের আর্দ্র ও উষ্ণ পরিবেশে সহজেই ছড়িয়ে পড়ে সংক্রমিত হয়। তাই একজনের ইয়ারবাড অন্যের ব্যবহার করাও ঠিক নয়।
৫. কানব্যথা
যদি আপনার ইয়ারবাড বেশি বড় বা এটা আপনার কানের সঙ্গে মাপমতো না হয়, তবে তা আপনার কানব্যথার কারণ হতে পারে। এ জন্য আপনার কানে অস্বস্তি হতে পারে। অনেক সময় কানে ফোসকাও পড়তে পারে।
সমাধান কী?
ইয়ারবাড ব্যবহারে যদি এত অসুবিধা, তাহলে কি এটা বাদ দেবেন? না বাদ দিলে এর সমাধানই-বা কী? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আপাতত এর সমাধান একটাই। তা হলো, যতক্ষণ প্রয়োজন ততক্ষণই শুধু ইয়ারবাড ব্যবহার করা। যখন দরকার নেই, তখনই এটা খুলে রাখতে হবে। যখন কথা বলা, গান শোনা শেষ, তখন ইয়ারবাড কানে রাখা যাবে না।
কলিনসের ৬০/৬০ সূত্র
ইয়ারবাড ব্যবহারের বিষয়ে শ্রবণ–বিশেষজ্ঞ ব্রাইয়া কলিনস একটি ৬০/৬০ সূত্র দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ইয়ারবাড একবারে সর্বোচ্চ ৬০ মিনিট ব্যবহার করুন। আবার ব্যবহারের আগে কমপক্ষে ৬০ মিনিটের বিরতি নিন। আর এর আওয়াজ সীমার সর্বোচ্চ ৬০ শতাংশ ব্যবহার করুন। সুতরাং আপনি ইয়ারবাড ব্যবহার করতেই পারেন। তবে অবশ্যই বুঝেশুনে। ড. ওয়াগলে ও কলিনস বলেছেন, তাঁরাও ইয়ারবাড ব্যবহার করেন, ব্যবহার রাখেন পরিমিত।
আরও পড়ুন
আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানোর মামলায় কনস্টেবল মুকুল কারাগারে
শীতে শিশুদের সুস্থ রাখবে যেসব খাবার
দীর্ঘদিন পর ফেরা তারকারা