বিশেষ প্রতিবেদন:
ভারতের বিদ্যুৎ রপ্তানি বিধিতে নতুন সংশোধন আসার ফলে ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারকদেরকে বিদেশী অংশীদারদের থেকে অর্থপ্রদানে বিলম্ব বা অফ টেক সমস্যার মুখোমুখি হলে তাদের বিদ্যুৎ অভ্যন্তরীণ গ্রিডে পুনরায় বিক্রি করার সুযোগ প্রদান করা হয়েছে। সম্প্রতি রয়টার্সের প্রতিবেদন অনুযায়ী, এই নতুন নিয়ম ভারতের শক্তি খাতকে আর্থিক ঝুঁকি থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে চালু করা হয়েছে।
নতুন নিয়ম অনুযায়ী, যদি বিদেশী অংশীদাররা নিয়মিতভাবে অর্থ প্রদান করতে ব্যর্থ হয়, তবে ভারতীয় বিদ্যুৎ উৎপাদকরা তাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ অভ্যন্তরীণ বাজারে বিক্রি করতে পারবেন। এই পরিবর্তনটি বিশেষভাবে প্রতিবেশী দেশগুলির অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে ভারতীয় কোম্পানিগুলিকে সুরক্ষিত করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, যাতে বিদেশে বাধার ক্ষেত্রে তারা একটি নির্ভরযোগ্য বাজারে প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে পারে।
এই নীতির পরিবর্তনের মূল কারণ হলো ভারতীয় বিদ্যুৎ রপ্তানিকারকদের চলমান অর্থপ্রদানের সমস্যা, বিশেষ করে আদানি পাওয়ারএর গোড্ডা প্ল্যান্টের ক্ষেত্রে। এই প্ল্যান্টটি বাংলাদেশ পাওয়ার ডেভেলপমেন্ট বোর্ডের (বিপিডিবি) সাথে ২৫ বছরের পাওয়ার পারচেজ চুক্তির অধীনে সম্পূর্ণ বিদ্যুৎ রপ্তানি করে। বিপিডিবির সূত্রে জানা গেছে, গোড্ডা সহ একাধিক বিদ্যুৎ প্ল্যান্টে বিপিডিবির উল্লেখযোগ্য বকেয়া রয়েছে। আদানি পাওয়ারের প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি বকেয়া রয়েছে, যা মূলত ক্ষমতার চার্জ এবং জ্বালানি প্রদানের সঙ্গে সম্পর্কিত।
বাংলাদেশের বিদ্যুৎ খাতে আর্থিক পতনের অন্যতম কারণ হিসেবে চিহ্নিত করা হচ্ছে, বাতিল হওয়া জরুরি আইন এবং আন্তর্জাতিক দরপত্রের মাধ্যমে বিদ্যুৎ চুক্তির সন্দেহজনক প্রদানের ঘটনা। এসব চুক্তি প্রধানমন্ত্রীর শেখ হাসিনার পরিবারের সাথে ঘনিষ্ঠ সম্পর্কযুক্ত আওয়ামী লীগের এমপি ও অলিগার্চদের উপকারে এসেছে।
বিদ্যুৎ প্রকল্প প্রদানে এই প্রাধান্যসূচি প্রকৃত চাহিদার প্রতি অমনোযোগী হয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার দ্রুত সম্প্রসারণ ঘটিয়েছে। ফলস্বরূপ, বাংলাদেশ বর্তমানে ৪০ শতাংশের বেশি অতিরিক্ত বিদ্যুৎ উৎপাদন ক্ষমতার মুখোমুখি এবং আরও ২৯টি প্রকল্পের মাধ্যমে ১০,৮৮১ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ গ্রিডে যুক্ত হবে। এটি স্বাধীন বিদ্যুৎ উৎপাদনকারীদের (আইপিপি) অতিরিক্ত ক্ষমতা প্রদান করেছে, এমনকি বিদ্যুতের জন্য প্রয়োজনীয়তা না থাকলেও।
সন্দেহজনক টেন্ডারিং প্রক্রিয়ার একটি উদাহরণ হল শান্তাহার এবং বাগেরহাট অঞ্চলে দুইটি ১১৫ মেগাওয়াট ভারী জ্বালানি তেল (এইচএফও)-ভিত্তিক আইপিপি প্রকল্পের প্রত্যাখ্যান। আন্তর্জাতিক দরপত্রে সর্বনিম্ন যোগ্য দরদাতা হিসেবে এক্সেল ইনফ্রাস্ট্রাকচার লিমিটেড (এনার্জিস পাওয়ার কর্পোরেশন লিমিটেডের মালিকানাধীন) প্রকল্পগুলো জিতেছিল, বিপিডিবি একটি লেটার অফ ইনটেন্ট (এলওআই) এবং চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য সুপারিশও করেছিল। কিন্তু হাসিনা সরকার প্রকল্পগুলো প্রত্যাখ্যান করে, যা টেন্ডার প্রক্রিয়ার ন্যায্যতা এবং বিদ্যুৎ খাতে সিদ্ধান্ত গ্রহণে রাজনৈতিক সংযোগের প্রভাব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
অতিরিক্ত ক্ষমতার সমস্যা বিপিডিবির জন্য আর্থিক সংকট সৃষ্টি করেছে, কারণ বোর্ড আইপিপিদের প্ল্যান্ট নিষ্ক্রিয় থাকা সত্ত্বেও তাদের ক্ষমতা প্রদানের জন্য বাধ্য। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগ (সিপিডি) অনুসারে, এই ক্ষমতা প্রদানের বকেয়া পরিমাণ ২০১৭ অর্থবছরে ৫,৩৭৬ কোটি টাকা থেকে ২০২৩ অর্থবছরে আনুমানিক ২৮,০০০ কোটি টাকায় পৌঁছেছে। ডলারের তীব্র ঘাটতির সাথে মিলিত হওয়ায় বিদ্যুৎ খাতের বকেয়া বিলের পরিমাণ প্রায় ৪ বিলিয়ন ডলার হয়ে দাঁড়িয়েছে।
নতুন নিয়ম বাংলাদেশের সামিট গ্রুপকেও প্রভাবিত করেছে, যেটি এখন ভারতীয় অংশীদারদের সাথে তাদের আন্তঃসীমান্ত শক্তি চুক্তি পর্যালোচনা করছে। সামিট গ্রুপ ভারতের Tata Power Renewable Energy Ltd সহ ভারতীয় কোম্পানির সাথে নবায়নযোগ্য শক্তি আমদানি এবং ১০০০ মেগাওয়াট পুনর্নবীকরণযোগ্য প্রকল্প নির্মাণের জন্য প্রাথমিক চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। তবে, নতুন নীতির কারণে সামিট গ্রুপের মধ্যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে।
সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খান বলেছেন, নতুন নিয়মের কারণে ভারতীয় অংশীদাররা এখন ভারতের অভ্যন্তরীণ বাজারে বিদ্যুৎ বিক্রি করতে আরও আগ্রহী হতে পারে, যা সামিট গ্রুপের বিনিয়োগ পরিকল্পনাকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। সামিট গ্রুপ আর্থিক শর্তাদি পুনর্বিবেচনা বা আরও নীতিগত স্পষ্টতা না হওয়া পর্যন্ত বিনিয়োগ বিলম্বিত করার কথা ভাবছে। কোম্পানিটি ভুটান এবং নেপালে জলবিদ্যুৎ প্রকল্প নির্মাণ এবং পরিষ্কার বিদ্যুৎ আমদানির পরিকল্পনাও পর্যালোচনা করছে।
আজিজ খান নতুন বাংলাদেশ সরকারের জরুরি আইন স্থগিত করার সিদ্ধান্তেরও ইঙ্গিত দিয়েছেন, যা পূর্বে দরপত্র ছাড়াই বিদ্যুৎ সরবরাহের চুক্তি প্রদানের অনুমতি দিয়েছিল। এই পরিবর্তন সামিট গ্রুপের পরিকল্পিত প্রকল্পগুলির জন্য আরো জটিলতা সৃষ্টি করেছে এবং আন্তঃসীমান্ত বিনিয়োগ পর্যালোচনা করার সিদ্ধান্তে অবদান রেখেছে।
যদিও নতুন নীতি এবং আর্থিক চ্যালেঞ্জ বিদ্যুৎ খাতে প্রভাব ফেলেছে, আদানি পাওয়ার তাদের বাংলাদেশের সাথে বিদ্যুৎ চুক্তি পূরণের প্রতিশ্রুতি পুনর্ব্যক্ত করেছে। কোম্পানিটি স্পষ্ট করেছে যে নতুন নিয়ম অভ্যন্তরীণভাবে বিদ্যুৎ বিক্রির বিকল্প প্রদান করলেও, বাংলাদেশের সাথে বিদ্যমান চুক্তি থেকে সরে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। এই পরিবর্তনটি বাংলাদেশের সাথে বিদ্যমান শক্তি সম্পর্ককে বিপর্যস্ত করার উদ্দেশ্যে নয়, বরং উল্লেখযোগ্য অর্থপ্রদানের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার জন্য।
আরও পড়ুন
আমানত ও ঋণের সুদের তথ্য দিতে হবে মাসের ১০ তারিখের মধ্যে
ইসরায়েলের ভয়াবহ হামলায় গাজায় ৬৪ ফিলিস্তিনি নিহত
দিল্লিতে ভবন ধসে চারজনের মৃত্যু