নিজস্ব প্রতিবেদক:
বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম কমতে শুরু করেছে। দুই সপ্তাহের বেশি সময় ধরে স্পট পণ্যবাজার ও ফিউচার মার্কেটের বুকিং দরে পতন শুরু হয়েছে। এর মধ্যে নভেল করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ওমিক্রন শনাক্ত হওয়ায় এ পতনের গতি আরো ত্বরান্বিত হয়েছে। তবে বিশ্ববাজারে অব্যাহত এ দরপতনের কোনো প্রভাব দেশের বাজারে পড়েনি। ব্যবসায়ীরা বলছেন, সরকার দাম নির্ধারণ করে দেয়ার কারণে দেশের বাজারে পণ্যের দাম কমেনি। আবার বিশ্ববাজারে মূল্যের ঊর্ধ্বমুখিতার সময়ে বাড়তি দামে মজুদ করার কারণেও পাইকারি বাজারে পণ্যের দাম কমছে না। ভোগ্যপণ্যের দামের উর্ধ্বগতির শুরুটা হয়েছিল করোনাভাইরাসে দেশে প্রথম রোগী শনাক্ত হওয়ার পর। মানুষজন প্রথমে জীবাণুনাশক ও মাস্ক কেনার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। এরপর বহু ক্রেতা বাজারে গিয়ে এক-দুই মাসের জন্য বাজার সেরে ফেলেন। খুচরা দোকানে মজুত শেষ হতে থাকায় খুচরা বিক্রেতারা পাইকারি বাজারে থেকে বাড়তি পণ্য কেনা শুরু করেন। সরবরাহ ব্যবস্থায় এই চাপ থেকে দামও বেড়ে যায়। সূত্র জানায়, গত অক্টোবরে কয়েক বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ দামে ছিল বৈশ্বিক পণ্যবাজার। কিন্তু নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের পর পণ্যমূল্য কমতে শুরু করে। সর্বশেষ গত কয়েক দিনে পণ্যের বুকিং মূল্য গত মাসের তুলনায় সর্বোচ্চ ১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে গেছে। এর মধ্যে ২৮ নভেম্বর পাম অয়েলের বুকিং মূল্য ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ১৭৫ ডলার। যদিও অক্টোবরে অপরিশোধিত পাম অয়েলের দাম ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৩০৬ ডলার। অর্থাৎ এক মাসের ব্যবধানে পাম অয়েলের বুকিং কমেছে ১৩১ ডলার। এ ছাড়া সয়াবিনের বুকিং মূল্য অক্টোবরে ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৪৮৩ ডলার। ২৮ নভেম্বর পর্যন্ত বিশ্ববাজারে সয়াবিনের বুকিং ১৬৭ ডলার কমে নেমে এসেছে টনপ্রতি ১ হাজার ৩১৬ ডলারে। এর মধ্যে গত মে ও জুনে বিশ্ববাজারে সয়াবিনের দাম এক দশকের মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল। মে মাসে সয়াবিন ছিল টনপ্রতি ১ হাজার ৫৬৮ ডলার এবং জুনে ছিল ১ হাজার ৫১৮ ডলার। এ হিসাবে সয়াবিন ও পাম অয়েলের বুকিং দর রেকর্ড পরিমাণ বৃদ্ধির পর দৃশ্যমান কমলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব পড়ছে না। এ ছাড়া অক্টোবরে গমের বুকিং দর ২৯৪ থেকে কমে ২৮ নভেম্বর ১৮৬ ডলারে নেমে এলেও দেশের বাজারে এর কোনো প্রভাব এখনো পরিলক্ষিত হয়নি। সূত্র আরও জানায়, গত ১৫ অক্টোবর বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অনুরোধের পর পেঁয়াজ ও চিনির দাম নিয়ন্ত্রণে শুল্ক কমায় জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পেঁয়াজ আমদানির ক্ষেত্রে ৫ শতাংশ আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার ছাড়াও চিনির নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) ৩০ থেকে কমিয়ে ২০ শতাংশ করা হয়। চিনির নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত এবং পেঁয়াজের নতুন শুল্কহার কার্যকর থাকবে আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত। তবে পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও বৈশ্বিক বুকিং বেড়ে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোজ্যতেল আমদানিতে শুল্কহার কমালেও বাংলাদেশে ভোজ্যতেলের শুল্কহার কমানোর বিষয়ে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেয়া হয়নি। ব্যবসায়ীরা অবশ্য বলছেন ভিন্ন কথা। তাদের ভাষ্য, পণ্যবাজারের পাইকারিতে নিয়মিত ডিও (ডেলিভারি অর্ডার) সরবরাহ করে বাজার থেকে অর্থ তুলে নেন তারা। পণ্য আমদানির পর বিভিন্ন তারিখে ইস্যু করা ডিওগুলোর বিপরীতে মিল বা কারখানা থেকে পণ্য সরবরাহ করতে হয় তাদের। এ সময়ের মধ্যে এসব ডিও পাইকারি পর্যায়ে ট্রেডিং প্রতিষ্ঠান ও ডিও ব্যবসায়ীদের মাধ্যমে বিভিন্ন হাত ঘুরে প্রকৃত ক্রেতার কাছে পৌঁছে। ততদিনে নির্ধারিত পণ্যটির দাম মূল দামের চেয়ে অনেক বেড়ে যায়। তাদের অভিযোগ, এক বছর ধরে নিয়মিত ডিও সরবরাহ হলেও গত কয়েক সপ্তাহ পাইকারি বাজারে ডিও সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে আমদানিকারক প্রতিষ্ঠানগুলো। যার কারণে বর্তমানে বৈশ্বিক বুকিং মূল্য কমলেও বাংলাদেশে পণ্যের দামে প্রভাব পড়েনি। এ ছাড়া বিশ্ববাজারে দাম কমার কারণে দেশের মিল মালিকরা সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছে। ২০১০-১১ সালে বিশ্ববাজারে ভোগ্যপণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়ে গেলে বেশি দামে পণ্য এনে অনেক ব্যবসায়ীকে লোকসানের মুখে পড়তে হয়। বর্তমানে যেভাবে দাম বেড়েছে তাতে বৈশ্বিক দরপতন দীর্ঘায়িত হলে দেশের বাজারেও আমদানিকারকদের বড় লোকসান হবে। ফলে কেউই এখন দাম কমানো বা সমন্বয়ে আগ্রহী হবে না। তবে বেশি দামে কেনা পণ্যের মজুদ শেষ না হওয়া পর্যন্ত ভোগ্যপণ্যের বাজারে এ অস্থিরতা থাকবে বলেও মনে করছেন তারা। জানা যায়, করোনার সংক্রামক নতুন ধরন শনাক্ত হওয়ার পর আফ্রিকা ও ইউরোপের বিভিন্ন দেশে এরইমধ্যে বিভিন্ন বিধিনিষেধ আরোপ করা হচ্ছে। ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বব্যাপী নভেল করোনাভাইরাস ছড়িয়ে পড়লে প্রথম দফায় সব ধরনের পণ্যবাজারে ব্যাপক পতন শুরু হয়। যদিও টিকা আবিষ্কারের পর ভাইরাসের প্রকোপ কমে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী পতনের মুখে থাকা শেয়ারবাজার, জ¦ালানি, ইস্পাত, ভোগ্যপণ্য, কেমিক্যালসহ বিভিন্ন পণ্যের দাম ধারাবাহিকভাবে বাড়তে থাকে। নতুন করে পণ্যের চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় বিশ্বব্যাপী কনটেইনার সংকট ও পণ্য সরবরাহের শিপিং খাতে বিশৃঙ্খল পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। এতে শিপিং চার্জ বেড়ে উৎপাদক দেশের বিক্রি হওয়া দামের চেয়েও আমদানিকারক দেশে পণ্যবাজার অস্থিতিশীল হয়ে ওঠে। সাম্প্রতিক সময়ে জ¦ালানি তেলের রেকর্ড মূল্যবৃদ্ধি বৈশ্বিক পণ্যবাজারের ধারাবাহিক বৃদ্ধিকে উসকে দিয়েছিল। কিন্তু দুই সপ্তাহ ধরে জ¦ালানির দরপতনে পণ্যবাজারেও নিম্নমুখী প্রবণতা দেখা যাচ্ছে। বিশ্ব পণ্যবাজারের নিম্নমুখী প্রবণতার সাথে তাল মিলিয়ে দেশীয় বাজারে পণ্যের দাম না কমার পরিপ্রেক্ষিতে বিভিন্ন ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠানের পক্ষে থেকে বলা হচ্ছে, বিশ্ববাজারে ধারাবাহিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীরা চাইলে আসন্ন লোকসানের ভয়ে পণ্য আমদানি বন্ধ বা কমিয়ে দিতে পারতেন। কিন্তু ব্যবসা চালিয়ে যাওয়া ও দেশের স্বাভাবিক সরবরাহ ধরে রাখতে তারা ঝুঁকি নিয়ে হলেও পণ্য আমদানি অব্যাহত রেখেছিলেন। বর্তমানে নতুন করে ভোগ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার পরিপ্রেক্ষিতে ভোগ্যপণ্য বাজারসহ এ খাতের সঙ্গে যুক্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোও ঝুঁকির মধ্যে পড়বে।
আরও পড়ুন
হিন্দুসেনার আপত্তি সত্ত্বেও আজমির শরীফে ‘চাদর’ পাঠালেন মোদি
আগামীকাল লন্ডন যাচ্ছেন খালেদা জিয়া
পর্যটকদের প্রশান্তির খোরাক আকিলপুর সমুদ্রসৈকত