জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজারের কুলাউড়ায় মনু নদীর বালুমহাল থেকে উত্তোলিত প্রায় ২৭ কোটি টাকার বালু নিয়ে চলছে লাগামহীন লুটপাট। ইজারার মেয়াদ দুই বছর আগেই শেষ হলেও পূর্বের ইজারাদার দীপক দে ও বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপির যোগসাজশে গোপনে এই লুটপাট চলছে বলে অভিযোগ উঠেছে।
বর্তমান বাংলা সন ১৪৩২-এ বালুমহালটির ইজারা পান হবিগঞ্জের চুনারুঘাট উপজেলার সেলিম আহমদের স্ত্রী নাজমুন নাহার লিপি। তবে অভিযোগ রয়েছে, পূর্বের ইজারাদার দীপক দে এখনো ব্যবসায়িকভাবে সম্পৃক্ত থেকে আগেই উত্তোলিত প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট জমাট বালুর মধ্য থেকে অন্তত ১ কোটি ঘনফুট বালু অবৈধভাবে বিক্রি করেছেন।
স্থানীয় সড়কগুলো দিয়ে প্রতিদিন ৩০-৪০ টন ওজনের ১০ চাকার ওভারলোড ডাম্পার ট্রাকে এসব বালু পরিবহন করা হচ্ছে। এতে হাজীপুর, পৃথিমপাশা ও টিলাগাঁও ইউনিয়নের বিভিন্ন সড়ক ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে, ফাটল ধরছে এবং স্থায়িত্ব হারাচ্ছে।
স্থানীয়দের অভিযোগ, ১৪৩০ সনের ইজারাদার দীপক দে যেহেতু মেয়াদোত্তীর্ণ অবস্থায় রয়েছেন, তাঁর দ্বারা বালু বিক্রি সম্পূর্ণ অবৈধ। স্থানীয়রা দাবি করছেন, এই বালু নিলামে বিক্রির মাধ্যমে সরকারের রাজস্ব আয় নিশ্চিত করা উচিত।
সাবেক ইজারাদারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, পৃথিমপাশা ইউনিয়নের বাসিন্দা দীপক দে তাঁর ইজারা চলাকালীন সময়েই নিয়ম ভেঙে কটারকোনা বাজারসংলগ্ন মনু নদীর ওপর নির্মিত ব্রিজের পাশ থেকে ড্রেজার বসিয়ে ব্যাপক হারে বালু উত্তোলন করেন। এই এলাকায় ইউনিয়ন ভূমি অফিস, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মাদ্রাসাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা থাকলেও তা উপেক্ষিত ছিল।
সাবেক ইজারাদার দীপক দে স্থানীয় রাজনৈতিক নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে মেয়াদোত্তীর্ণ হওয়ার পরও বালু উত্তোলন ও বিক্রি চালিয়ে যান বলে অভিযোগ রয়েছে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, জমাট করা বালু থেকে প্রতিদিন কোটি কোটি টাকার বালু বিক্রি করে সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে।
আইনি পদক্ষেপ ও আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপি বালু উত্তোলন, পরিবহন ও বিপণনের দায়িত্ব দেন স্থানীয় ব্যবসায়ী আব্দুল হাছিবকে। তবে এক পর্যায়ে তাঁকে ভয়ভীতি দেখানো হলে তিনি কুলাউড়া সিনিয়র সহকারী জজ আদালতে মামলা করেন (স্বত্ব ১৭৯/২০২৫)।
আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নিষেধাজ্ঞা জারি করে নাজমুন নাহার, সেলিম আহমদ, দীপক দে, জামিল ইকবাল ও আব্দুল মুকিতদের বিরুদ্ধে কার্যক্রমে বাধা না দেওয়ার নির্দেশ দেন। পরবর্তীতে দীপক দে গং আদালতের নির্দেশ অমান্য করে সাইনবোর্ড উপড়ে ফেলে বলে অভিযোগ রয়েছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, নদীর তীরে ৫-৬টি স্থানে বিশাল বালুর স্তুপ গড়ে তোলা হয়েছে। সেখান থেকে নিয়মিত ভারী ট্রাকে বালু সরিয়ে নেওয়া হচ্ছে। এতে করে নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ ধসে পড়ছে, সড়কে গর্তের সৃষ্টি হচ্ছে এবং যান চলাচলে বিঘ্ন ঘটছে।
সোমবার রাতে কনিমোড়া এলাকায় স্থানীয়রা প্রতিবাদ করলে সাবেক ইজারাদারের ভাড়াটে লোকজন তাদের ওপর চড়াও হয় বলেও অভিযোগ উঠে।
হাজীপুর ইউনিয়ন ভূমি অফিসের উপ-সহকারী কর্মকর্তা মোহাম্মদ মতিউর রহমান বলেন, জমাট বালুর পরিমাণ প্রায় ৫ কোটি ৫০ লাখ ঘনফুট, যার আনুমানিক বাজারমূল্য ২৭ কোটি টাকা। এ বালুর বড় অংশ অবৈধভাবে বিক্রি করা হচ্ছে, যা অভিযান চালিয়ে জব্দ করা হয়েছে এবং প্রশাসনের জিম্মায় রয়েছে।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) শাহ জহরুল হোসেন বলেন, ইজারা শেষ হয়ে গেলে বালু নেওয়ার কোনো বৈধতা নেই। এ বিষয়ে আইন অমান্যকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে এবং একটি প্রতিবেদন জেলা প্রশাসক বরাবর পাঠানো হচ্ছে।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোছা. শাহীনা আক্তার বলেন, বিষয়টি খতিয়ে দেখে সংশ্লিষ্ট ঠিকাদার ও ইজারাদারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অভিযুক্ত সাবেক ইজারাদার দীপক দে বলেন, “১৪৩০ সনে জটিলতার কারণে সময়মতো বালু সরাতে পারিনি। তাই বর্তমান ইজারাদারের সাথে অংশীদার হয়ে পূর্বের উত্তোলিত বালু উন্নয়ন কাজে সরবরাহ করছি।”
তবে বর্তমান ইজারাদার নাজমুন নাহার লিপির সঙ্গে যোগাযোগ করা সম্ভব হয়নি। তাঁর স্বামী সেলিম আহমদের ফোন বন্ধ পাওয়া গেছে।
মনু নদীর বালুমহাল থেকে দুই বছর আগে উত্তোলিত ২৭ কোটি টাকার বালু এখনো বিক্রি চলছে—যার পেছনে রয়েছে প্রভাবশালী সাবেক ও বর্তমান ইজারাদারের যোগসাজশ। আদালতের নিষেধাজ্ঞা, প্রশাসনের অভিযান সত্ত্বেও লুটপাট বন্ধ হয়নি। স্থানীয়দের দাবি, সরকারের রাজস্ব বাঁচাতে দ্রুত বালু নিলামে বিক্রি ও অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হোক।
আরও পড়ুন
দেশে এই মুহুর্তে দরকার বিচার ও সংস্কার: নাহিদ ইসলাম
এসআই পরিচয়ে থানায় তরুণী, কনস্টেবলকে ভুলে ‘স্যার’ ডেকে ধরা
যৌন নির্যাতনের কারণে নিখোঁজের ২১ দিন পর কিশোরী রিতু পিবিআই হেফাজতে