নিজস্ব প্রতিবেদক:
ধরাছোঁয়ার বাইরেই থেকে যাচ্ছে মানব পাচারের সাথে জড়িতরা। মানব পাচারের অধিকাংশ মামলার বিচার কার্যক্রমই ধীর গতিতে চলছে। তদন্ত কর্মকর্তারা তদন্ত কার্যক্রম শেষ করতে দীর্ঘসময় নিচ্ছে। আর যেসব মামলার চার্জশিট দেয়া হয়েছে সেগুলোর ৯৬ ভাগই বিচারাধীন রয়েছে। মানব পাচার মামলা নিষ্পত্তির হার ৩ দশমিক ৯১ ভাগ। সারাদেশে মানব পাচারের মামলা ৬ হাজার ১৩৪টি হয়েছে। তার মধ্যে মাত্র ২৩৩টি মামলা আদালতে নিষ্পত্তি হয়েছে। বিচারাধীন মামলার সংখ্যা ৫ হাজার ৯০১টি। যদিও মানব পাচার প্রতিরোধ ও দমন আইনে সংঘবদ্ধভাবে মানব পাচারের জন্য মৃত্যুদন্ড, যাবজ্জীবন কারাদন্ড ও সর্বনিম্ন ৭ বছরের কারাদন্ড এবং অন্যূন ৫ লাখ টাকা অর্থদন্ডের বিধান রয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও আদালত সংশ্লিষ্ট সূত্রে এসব তথ্য জানা যায়।
সংশ্লিষ্ট সূত্র মতে, দুর্বল তদন্ত ও আদালতে সাক্ষী হাজির করতে না পারায় অধিকাংশ অপরাধীদের শাস্তি হয় না। আর মানব পাচার মামলা আইনে জামিন অযোগ্য হলেও অধিকাংশই জামিন পেয়ে যাচ্ছে। ব্র্যাকের অভিবাসন কর্মসূচীর তথ্যানুসারে ২০২০ সাল পর্যন্ত দেশে মানব পাচারের ৬ হাজার ১৩৪টি মামলা হয়েছে। সেগুলোর মধ্যে বিভিন্ন আদালতে ২৩৩টির নিষ্পত্তি হয়েছে আর বিচারাধীন রয়েছে ৫ হাজার ৯০১টি। তার মধ্যে ৩৩টি মামলায় ৫৪ জনের বিভিন্ন মেয়াদে সাজা হয়েছে। আর উচ্চ আদালতের এক পরিসংখ্যানের তথ্যানুযায়ী ২০১৯ সালের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত মানব পাচারের মোট মামলা ছিল ৫ হাজার ৯৯টি। তার মধ্যে ৪ হাজার ৮৫১টি মামলা বিচারাধীন রয়েছে। নিষ্পত্তি হয়েছে ১৯০টি। আর ৫৮টি মামলা বদলি করা হয়েছে। উচ্চ আদালতের নির্দেশে ১৩টির বিচার কার্যক্রম স্থগিত রয়েছে। তাছাড়া ১৯০টি মামলা ৫ বছরের অধিক সময় ধরে বিচারাধীন রয়েছে।
সূত্র জানায়, মানব পাচার মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তারা যদি প্রসিকিউশনের সহায়তা নেন তাহলে মামলায় কাকে সাক্ষী করা যাবে আর কাকে সাক্ষী করা যাবে না- সে বিষয়ে ভুল হওয়ার সম্ভাবনা কম থাকে। সর্বদাই এমন লোকদের সাক্ষী করা প্রয়োজন যাদের ডাক দিলে পাওয়া যাবে। যারা কোর্টে এসে সাক্ষী দিতে প্রস্তুত তাদেরই সাক্ষী করা প্রয়োজন। তাছাড়া নানা আইনী বিষয়গুলোর প্রতি লক্ষ্য রেখে প্রসিকিউশনের সহায়তায় নির্ভুলভাবে আসামিদের বিরুদ্ধে চার্জশিট (অভিযোগপত্র) দেয়া সম্ভব।
এদিকে মানব পাচার মামলার তদন্ত প্রসঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্টদের মতে, মানব পাচার বিষয়ক অভিযোগের সত্যতা নিরূপণে অনেক সময় অনেক সময় লেগে যায়। আর অনেক আসামিই তাদের প্রকৃত নাম-ঠিকানা গোপন করে মিথ্যা তথ্য দেয়। সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে সময় লেগে যায়। আবার আসামিদের জিজ্ঞাসাবাদে যেসব তথ্য পাওয়া যায় সেগুলোও যাচাই-বাছাই করতে হয়। মামলার চার্জশিট আসামিদের সঠিক নাম-ঠিকানাসহ তদন্তের বিস্তারিত উল্লেখ করতে হয়। ফলে তথ্য সংগ্রহ ও পর্যালোচনা করে সেগুলো যাচাই-বাছাই করতে কোন কোন ক্ষেত্রে কিছু সময় লেগে যায়। তবে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী মানব পাচারের মামলাগুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিয়ে তদন্ত করে। যাতে কোন নিরপরাধ মানুষজন দোষী সাব্যস্ত হয়ে সাজা না পায় পুলিশকে সেই দিকটাও খেয়াল রাখতে হয়।
অন্যদিকে এ বিষয়ে অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মানব পাচারের মামলাগুলো দীর্ঘদিন ঝুলে থাকা দুঃখজনক। মামলাগুলো দ্রুত বিচার নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। তা নাহলে বিচারপ্রার্থীদের মনে ন্যায়বিচার নিয়ে হতাশা সৃষ্টি হবে। কোন অপরাধীই যেন আইনের ফাঁক-ফোকর দিয়ে পার পেয়ে না যায় সে ব্যাপারে আদালত, প্রসিকিউশন ও তদন্ত সংস্থাকে আরো সতর্ক থাকতে হবে। তাছাড়া মানব পাচাররোধে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো কার্যকরী ভূমিকা পালন করতে হবে। বিশেষ করে বর্ডার অঞ্চলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে আরো তৎপরতা বাড়ানো প্রয়োজন। এসব উদ্যোগ যথাযথভাবে নেয়া গেলে মানব পাচার কমে আসবে।
এ প্রসঙ্গে ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর তাপস কুমার পাল জানান, আগে নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালে মানব পাচার আইনের মামলার বিচার কার্যক্রম পরিচালনা করা হতো। ফলে একজন বিচারকের নানা ধরনের মামলা পরিচালনা করতে হতো। এখন পৃথক ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়েছে। ফলে মামলা নিষ্পত্তির হার অনেকটা বাড়বে।
একই প্রসঙ্গে ঢাকার মানব পাচার অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের অতিরিক্ত পাবলিক প্রসিকিউটর (ভারপ্রাপ্ত পাবলিক প্রসিকিউটর) সাজ্জাদুল হক শিহাব জানান, মানব পাচার আদালতের কার্যক্রম শুরু হয়েছে। অনেক মামলা ইতোমধ্যেই নিষ্পত্তি হয়েছে। তবে সাজার পরিমাণ খুবই কম। তার প্রধান কারণ সাক্ষী আসে না। তাছাড়া তদন্তের ত্রুটিও অন্যতম কারণ। সাক্ষীরা কোর্টে এসে আপোসের কথা বলে। কোর্টে এসে মামলায় উল্টো সাক্ষী দেয়। সন্দেহাতীতভাবে অপরাধ প্রমাণিত না হলে কোন আসামির সাজা হয় না। আর ওসব নানা কারণেই মানব পাচার মামলায় আসামিরা সুবিধা পেয়ে যাচ্ছে।
আরও পড়ুন
পিছিয়ে থেকেও ফেরার গল্প লিখল বাংলাদেশ
লুকিয়ে রাখা বাচ্চা পৌঁছে দিলে ২০ হাজার ডলার দিব: তানজিন তিশা
ছাত্রীকে ইমো কলে দেখতে চাওয়া সেই ইবি শিক্ষক বরখাস্ত