December 9, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, December 7th, 2025, 7:13 pm

মেগা প্রকল্পের কাজে অনিয়ম-ধীরগতি অসময়েও কপোতাক্ষের বাঁধে ভাঙন: উপকূলে অশনি সংকেত

খুলনা প্রতিনিধি:

‎প্রাকৃতিক দুর্যোগের ফলে নদী ভাঙনে প্লাবিত হওয়া খুলনার কয়রার সবচেয়ে বড় সমস্যা।  প্রতিবছর এপ্রিল থেকে জুন মাস পর্যন্ত কয়রার মানুষের মধ্যে চরম অতংঙ্ক বিরাজ করে। জলবায়ু পরিবর্তন, জোয়ার–ভাটার তীব্রতা এবং নদীর গতিপ্রকৃতির পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে ঝুঁকি বাড়ছে বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষা উপকূলীয় এ অঞ্চলের। এদিকে উপকূলবাসীর দীর্ঘদিনের প্রত্যাশিত টেকসই বাঁধ নির্মাণ প্রায় ১২ হাজার কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের অনুমোদনে আশার আলো জাগলেও কাজের ধীরগতি ও অনিয়মে তাদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ বিরাজ করছে। মেগা প্রকল্পে যথেষ্ট বরাদ্দ থাকার পরেও অবৈধভাবে কপোতাক্ষ ও শাকবাড়িয়া নদী থেকে বালু উত্তোলন করেই বাঁধ নির্মাণ কাজে ব্যবহার করা হচ্ছে। এছাড়া গাছ কেটে ধ্বংস করা হচ্ছে নদীর চরের সবুজ বনায়ন। যার ফলে বাঁধের স্থায়িত্ব কমছে।

‎জানা যায়, নদীতে পানির চাপ ও কোন প্রকারের ঝড়ো বাতাস ছাড়াই গত ৪ ডিসেম্বর গভীর রাতে হঠাৎ করে কয়রা উপজেলার দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের মাটিয়াভাঙ্গা এলাকায় প্রায় ২০০ মিটার বেড়িবাঁধ ধসে পড়ে। কয়েক সেকেন্ডের ব্যবধানে নদীতে ভেঙে পড়ে বিশাল অংশ। প্লাবিত হয় এলাকা। পরের দিন ভাটায় স্থানীয়রা স্বেচ্ছাশ্রমে রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে সক্ষম হলেও আতঙ্ক কাটেনি।

‎স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাত ১১টার পর থেকেই নদীর পাড়ের মাটি সরে যাওয়ার অস্বাভাবিক শব্দ শোনা যাচ্ছিল। পরে সেখানে যেয়ে দেখেন বড় বড় খণ্ড নদীতে ধ্বসে পড়ে ২০০ মিটারের মত বাঁধ ভেঙে এলাকায় লবন পানি প্রবেশ করে।

‎স্থানীয়দের অভিযোগ, দীর্ঘদিন ধরে স্থায়ী বাঁধ সংস্কার এবং নদী খননে অবহেলার কারণে এ অঞ্চলে ভাঙন আরও তীব্র হয়েছে। বর্তমানে দক্ষিণ বেদকাশি ইউনিয়নের ধানচর, শামুকপোতা, কুতুবেরচর, গাবতলা ও খোলপেটুয়া পাড়ের বেশ কয়েকটি এলাকা ঝুঁকির মুখে রয়েছে।

মাটিয়াভাঙ্গার বাসিন্দা মাসুম বিল্লাহ তখনকার ভয়াবহ মুহূর্তের বর্ণনা দিয়ে বলেন, ‘চোখের সামনে দিয়ে বাঁধটা নদীতে চইলে গেল। মনে হচ্ছিল, আজই বুঝি সব শেষ, বাড়ি-ঘর সবকিছুই বুঝি তলাই যাবেনে।

‎স্থানীয় বাসিন্দা আব্দুস সালাম জানান,

‎“প্রতিদিনই নদী এগিয়ে আসছে। কয়েক দিনের মধ্যে তিনটি বাড়ি নদীতে চলে গেছে। দীর্ঘদিন ধরে জরার্জীণ থাকলেও মেরামতের উদ্যোগ নেয়া হয়নি।

‎‎ফাটল ছিল এক মাস ধরে—তবু কেবল বালুর বস্তা

মাটিয়াভাঙ্গার ভেঙে যাওয়া অংশটি মেগা প্রকল্পের আওতায় রয়েছে । প্রকল্পের আওতায় দুই বছর যাবত বিভিন্ন প্যাকেজের কাজ চলমান থাকলেও রয়েছে চরম ধীরগতি। মাটিয়াডাঙ্গার ওই অংশটি দীর্ঘদিন যাবত নাজুক অবস্থায় থাকলেও সংস্কারে গুরুত্ব দেয়নি ঠিকাদার।

পানি উন্নয়ন বোর্ড (পাউবো) সূত্র জানায়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়ের ‘পুনর্বাসন’ প্রকল্পের আওতায় কয়রা উপজেলার উত্তর ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নের দুটি পোল্ডারে (১৪/১ ও ১৩–১৪/২) প্রায় ১,২০০ কোটি টাকার একটি প্রকল্পের কাজ চলছে। ৩২ কিলোমিটার বেড়িবাঁধে উচ্চতা–প্রশস্ততা বৃদ্ধি, ঢাল সংরক্ষণ, নদীশাসন ও চরবনায়নের কাজ করা হচ্ছে। মাটিয়াভাঙ্গার ভাঙন এলাকাটিও এই প্রকল্পের অংশ।

‎ইউপি সদস্য দিদারুল আলম বলেন,

‎“সুন্দরবনঘেঁষা আড়পাঙ্গাসিয়া নদী ও কপোতাক্ষ নদের মোহনার পাশে থাকা এ বাঁধটিতে এক মাস আগেই ফাটল দেখা গিয়েছিল। আমরা পাউবোর লোকজনকে জানাইছিলাম। তখন শুধু বস্তা ফেলে দায়সারা কাজ করে গেছে। সেই জায়গাই ভেঙে প্লাবিত হয়েছে।”

রিং বাঁধে আপাতত রক্ষা—কিন্তু কতদিন?

‎রাতে গ্রামবাসী ও পাউবো মিলে বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে এলাকা প্লাবিত হওয়া থেকে রক্ষা পায়। ‎কিন্তু নদীর ভাঙন ঠেকাতে রিং বাঁধ কোনো স্থায়ী ব্যবস্থা নয়। সচেতন মহল বলছেন, রিং বাঁধের স্থায়িত্ব খুব স্বল্প। যে কোন বড় মূহুর্তে ভেঙে যেতে পারে।  দ্রুত যদি মূল বাঁধ সংস্কার করা না হয় তাহলে ধ্বসের পরিধি বাড়তে পারে।

উপকূল ও সুন্দরবন সংরক্ষণ আন্দোলনের আহ্বায়ক এম আনোয়ার হোসেন বলেন,

‎‎যেখানে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে, তার আশপাশ থেকেই বালু উত্তোলন করা হয়। এছাড়া নদীর চর থেকে মাটি কেটে বাঁধ তৈরি করা হচ্ছে। নদীর চরের গাছ কেটে বনায়ন নষ্ট করা হচ্ছে। এসব বিষয় জানিয়ে বাঁধের স্থায়িত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন এই নাগরিক নেতা।

এটি কি শুধু প্রকৃতির তাণ্ডব, নাকি বাঁধের কাঠামোগত দুর্বলতা? এটা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে সচেতন মহলের।

‎‎পাউবো সাতক্ষীরা–২ বিভাগের উপ সহকারী প্রকৌশলী আলমগীর কবির বলেন, ‘কাজ চলমান অবস্থায়ই বাঁধটি ভেঙে গেছে। কংক্রিট ব্লক নির্মাণের সরঞ্জামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাতেই বিকল্প রিং বাঁধ দিয়ে পানি আটকাতে পারায় এলাকা প্লাবিত হয়নি। সকাল থেকে জোরেসোরে আমাদের বাঁধ মেরামতের কাজ চলছে।’

‎‎তবে এলাকার বহু মানুষের অভিযোগ—কাজের ধীরগতি, অসমাপ্ত মাটি ভরাট, কোথাও সিসি ব্লক না দেওয়া, আবার কোথাও বালুর বস্তা ফেলার বাকি—এসব কারণে বহু স্থানে ধস বেড়েছে এবং তৈরি হয়েছে ভাঙনের ঝুঁকি।

দক্ষিণ বেদকাশীর বাসিন্দা খলিলুর রহমান বলেন, ‘শুধু মাটিয়াভাঙ্গা না, এলাকার অনেক জায়গায় কাজ না করে ফেলাইয়ে রাখা হইছে। রাইতের বিপদ কাটিছে তবে আগামী বর্ষার আগে ঠিকমতো বাঁধের কাজ শেষ না হলি বড় বিপদ হবেনে।’

‎পাউবো সাতক্ষীরা–২ বিভাগের উপবিভাগীয় প্রকৌশলী মো. রাশিদুল ইসলাম বলেন, প্রকল্পের কাজ দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চলছে। তবে জমি অধিগ্রহণ জটিলতা, বরাদ্দ বিলম্ব, বালু–মাটির সংকট এবং নদীর ভাটার সময়ের ওপর নির্ভর করতে হওয়ায় কাজ পিছিয়ে যাচ্ছে। তিনি বলেন, ‘মাটিয়াভাঙ্গার রাতের ধস স্থানীয় মানুষের মনে আতঙ্ক তৈরি করলেও দ্রুত রিং বাঁধ নির্মাণে বড় ধরনের বিপর্যয় এড়ানো গেছে। সকাল থেকে ভাঙা অংশে কাজ শুরু হয়েছে। এখন আর তেমন ঝুঁকি নেই।’