যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ডোনাল্ড ট্রাম্প শপথ নেয়ার পরপরই সে দেশে অবৈধভাবে বসবাসকারী প্রায় ১৮ হাজার অভিবাসীকে ফেরত নিয়ে আসার প্রক্রিয়া শুরু করেছে ভারত।
আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম ব্লুমবার্গের এক প্রতিবেদনে এই খবর জানা গেছে।
ভারতের সংবাদমাধ্যম ও পোর্টালগুলোও ব্লুমবার্গের বরাত দিয়ে এই খবর প্রকাশ করতে শুরু করেছে।
ব্লুমবার্গের প্রতিবেদনে ১৮ হাজার ভারতীয়র যে হিসাবের কথা বলা হয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনই তাদের চিহ্নিত করেছে।
এই সংখ্যার সাথে যুক্তরাষ্ট্রের ‘ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট’ বা আইসিই-র তথ্য মিলে যাচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের আইসিই গত বছর নভেম্বরে প্রকাশিত এক তথ্যে জানিয়েছিল, ১৭ হাজার ৯৪০ জন ভারতীয়কে প্রত্যর্পণের জন্য চিহ্নিত করা হয়েছে।
ব্লুমবার্গ এটাও লিখেছে, অবৈধ অভিবাসীদের ফিরিয়ে আনার প্রক্রিয়া শুরু করে দিল্লির পক্ষ থেকে ট্রাম্প প্রশাসনকে একটা বার্তা দেয়া হচ্ছে, যাতে ওয়াশিংটন কোনো ধরনের বাণিজ্যিক বিধি-নিষেধ আরোপ না করে।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ার সাথে যুক্ত সূত্রগুলো থেকে ব্লুমবার্গ জানতে পেরেছে, দেশে ফিরিয়ে আনার আগে অবৈধ অভিবাসীদের পরিচয় এখন নিশ্চিত করবে ভারত। দুই দেশের মধ্যে এ সংক্রান্ত আলোচনা যেহেতু গোপনে চলছে, তাই সূত্রগুলো নিজেদের নাম প্রকাশ করতে দিতে চাননি।
কিন্তু তারা এটা জানাচ্ছেন যে সংখ্যাটা ১৮ হাজারের থেকে অনেক বেশিও হতে পারে। কারণ ঠিক কতজন ভারতীয় অভিবাসী বৈধ নথি ছাড়া আমেরিকায় বাস করছেন, তার সঠিক সংখ্যাটা এখনো স্পষ্ট নয়।
প্রত্যর্পণ প্রক্রিয়ায় জড়িত সূত্রগুলোর কাছ থেকে ব্লুমবার্গ এটাও জানতে পেরেছে যে বৈধ নথি ছাড়া যে ভারতীয়রা যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছেন, তাদের অধিকাংশই পাঞ্জাব আর গুজরাতের মতো পশ্চিমাঞ্চলীয় রাজ্যগুলো থেকে গিয়েছিলেন।
ভারতীয় অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা কত?
যুক্তরাষ্ট্রের তিনটি বিভাগ অবৈধ অভিবাসী চিহ্নিত করে থাকে। অফিস অফ হোমল্যান্ড সিকিওরিটি, ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশন এবং ইমিগ্রেশন অ্যান্ড কাস্টমস এনফোর্সমেন্ট।
তিনটি বিভাগেরই ওয়েবসাইট থেকে তথ্য পাওয়া যায়, যেকোনো দেশের কতজন অবৈধ অভিবাসীকে সীমান্তে আটক করা হয়েছে, নিজ দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বা বৈধ নথি ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসকারী কতজনকে চিহ্নিত করা হয়েছে।
যে কয়েকটি দেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীর সংখ্যা সব থেকে বেশি, সেই তালিকার ওপরের দিকেই রয়েছে ভারত।
আইসিই’র প্রকাশিত তথ্যে দেখা যাচ্ছে, এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে ওই তালিকায় সবার ওপরে রয়েছে চীন থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসীরা, তারপরেই ভারতের স্থান।
তবে তালিকার শীর্ষে আছে মেক্সিকো, এল সালভাদোরের মতো দেশ।
পৃথকভাবে ইউএস কাস্টমস অ্যান্ড বর্ডার প্রোটেকশনের কাছ থেকে এই তথ্য পাওয়া যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সীমান্তে প্রবেশের সময়ে কোন দেশের কত নাগরিক আটক হয়েছেন বা নিজ দেশে তাদের ফেরত পাঠানো হয়েছে।
সীমান্তে প্রবেশের সময়ে বাধাদানের কাজটিকে যুক্তরাষ্ট্রের পরিভাষায় বলা হয় ‘এনকাউন্টার’।
যুক্তরাষ্ট্রের সব সীমান্তে গত বছর অক্টোবর থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত মোট ১৮ হাজার ৬২৫ জন ভারতীয় বংশোদ্ভূত ‘এনকাউন্টার্ড’ হয়েছেন।
তার আগের বছর, ২০২৩ এর অক্টোবর থেকে ২০২৪ এর সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ৯০ হাজার ৪১৫ জন এবং তারও আগের বছর একই সময়কালে মোট ৯৬ হাজার ৯১৭ জন ভারতীয় সীমান্তে আটক হয়েছিলেন। এদের সীমান্ত পেরনোর অনুমতি দেয়া হয়নি অথবা নিজ দেশে প্রত্যর্পণ করার জন্য হেফাজতে রাখা হয়েছে।
ভারতের পার্লামেন্টেও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ওই একই তথ্যসূত্র উদ্ধৃত করে একটি প্রশ্নের জবাব দিয়েছিল।
অফিস অফ হোমল্যান্ড সিকিউরিটির গত বছর প্রকাশিত সর্বশেষ বার্ষিক প্রতিবেদনে দেখা যাচ্ছে যে তাদের হিসাব মতো ২০২২ সাল পর্যন্ত প্রায় দুই লাখ ২০ হাজার ভারতীয় বংশোদ্ভূত বেআইনিভাবে যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস করছিলেন।
প্রেসিডেন্ট হিসেবে শপথ নিয়েই তার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি অনুযায়ী অবৈধ অভিবাসীদের বিষয়ে কঠোর অবস্থান নিয়েছেন ট্রাম্প।
তিনি অঙ্গীকার করেছেন, লাখ লাখ ‘ক্রিমিনাল অ্যালিয়েন’ বা বহির্দেশীয় অপরাধীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে বের করে দেবেন।
ওভাল অফিসে বসে প্রথম দিনেই ট্রাম্প প্রতিবেশী কানাডা ও মেক্সিকো থেকে বিপুল সংখ্যক মানুষ আসা ঠেকাতে চড়া হারে শুল্ক বসানোর হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। ১ ফেব্রুয়ারির মধ্যে এই শুল্ক বসানো হতে পারে, যার হার ২৫ শতাংশ পর্যন্ত হতে পারে বলে সোমবার মন্তব্য করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের নতুন প্রেসিডেন্ট।
মেক্সিকো সীমান্তে জরুরি অবস্থার ঘোষণা দিয়ে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে সেনা মোতায়েনও করেছেন ট্রাম্প।
মেক্সিকোর প্রেসিডেন্ট ক্লডিয়া শেইনবাউম এই প্রসঙ্গে বলেছেন, মেক্সিকোর মানুষ এ বিষয়ে নিশ্চিত থাকতে পারে যে সরকার ‘সবসময় মেক্সিকোর সার্বভৌমত্ব ও স্বাধীনতাকে রক্ষা করবে।
ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশের বিষয়ে তিনি বলেন, মেক্সিকো সবসময় যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থান করা মেক্সিকানদের সমর্থন দিয়ে যাবে।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের যে বিধান দেশটির সংবিধানে আছে, সেটি বাতিলের পদক্ষেপ নিয়েছেন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প।
ফেডারেল অ্যাজেন্সিগুলোকে অবৈধ অভিবাসী কিংবা সাময়িক ভিসাধারী বাবা-মায়ের সন্তানকে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব না দেয়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
রাষ্ট্রীয় সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোকে এ সিদ্ধান্ত কার্যকরের জন্য ৩০ দিন সময় দেয়া হয়েছে।
তবে ইউনিভার্সিটি কলেজ ডাবলিনের ক্লিনটন ইনস্টিটিউটের যুক্তরাষ্ট্র ও আন্তর্জাতিক রাজনীতি বিষয়ক অধ্যাপক স্কট লুকাস বলেছেন, ‘অভিবাসনের বিষয়ে ট্রাম্পের নির্বাহী আদেশ সাথে সাথে প্রয়োগ হয়েছে। কিন্তু এটি আইনি দিক থেকে অনেক চ্যালেঞ্জের মুখেও পড়বে। জন্ম সূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার বাতিল করতে চান প্রেসিডেন্ট। কিন্তু আমেরিকায় যারা জন্মগ্রহণ করে, তারা আমেরিকান নাগরিক, এটা সংবিধানেই বলা আছে। ফলে এটা বাতিল করে দেয়ার মতো আইনগত অধিকার কি তার আছে?’
আগেও ফিরিয়ে আনা হয়েছে অবৈধ অভিবাসীদের
যে প্রায় ১৮ হাজার অবৈধ ভারতীয় অভিবাসীকে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নিয়েছে দিল্লি, তারই অংশ হিসেবে গত অক্টোবর মাসে বিশেষ বিমানে এক শ’রও বেশি নাগরিককে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বলে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে।
অক্টোবর মাসের সেই প্রত্যর্পণের সময়ে ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র রণধীর জয়সওয়াল যে মন্তব্য করেছিলেন সেটি উদ্ধৃত করা হয়েছে ব্লুমবার্গের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে।
জয়সওয়াল তখন বলেছিলেন, ‘অভিবাসনের বিষয়ে ভারত-মার্কিন সহযোগিতার একটি অংশ হিসেবে দুই দেশ অবৈধ অভিবাসন রুখতে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ভারত থেকে যুক্তরাষ্ট্রে যাতে আরো বেশি করে বৈধ অভিবাসী যেতে পারেন, সেই সুযোগ গড়ে তোলার জন্যই এই পদক্ষেপ।’
ওই সহযোগিতারই অংশ হিসাবেই বিমান ভাড়া করে যুক্তরাষ্ট্র থেকে প্রত্যর্পিত ভারতীয় নাগরিকদের ফিরিয়ে আনা হয়েছে, ‘অক্টোবর মাসের প্রত্যর্পণের ব্যাপারে প্রতিক্রিয়া দিতে গিয়ে বলেছিলেন জয়সওয়াল।
তার আগের এক বছর সময়কালে আমেরিকা থেকে ১১০০-রও বেশি প্রত্যর্পিত ভারতীয় নাগরিককে ফিরিয়ে আনা হয়েছিল বলে ব্লুমবার্গ জানিয়েছে।
তবে ওই আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমের সাম্প্রতিক প্রতিবেদনের পরে এখনো পর্যন্ত ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে কোনো প্রতিক্রিয়া আসেনি।
সূত্র : বিবিসি
আরও পড়ুন
রোহিঙ্গা সংকট নিয়ে বড় আন্তর্জাতিক সম্মেলন করবে সরকার: প্রধান উপদেষ্টা
আতঙ্কে নথিপত্রহীন বাংলাদেশিরা, নিউইয়র্কে গ্রেপ্তার ৪
বিএনপি-খেলাফত মজলিশের বৈঠকে যে আলোচনা হলো