February 23, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Saturday, February 15th, 2025, 1:06 pm

রংপুরে ফুল চাষে সফল উদ্যোক্তা আব্দুর রশিদ

আব্দুর রহমান মিন্টু, রংপুর : তামাকের আগ্রাসী রংপুর অঞ্চল হলেও এখানকার মাটি ফুল চাষের জন্য বেশ উপযোগী। পহেলা ফাল্গুন, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও একুশে ফেব্রুয়ারি ঘিরে রংপুরের ফুলচাষিরা প্রস্ততি নিয়েছে। এ বছর আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় রংপুরে ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। চলতি বছরে তিন দিবসকে ঘিরে জেলা কৃষি অধিদপ্তর ২ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্য-মাত্রার কথা জানিয়েছে। তবে গোলাপ চাষিরা বলছেন, গত বছরের তুলনায় ফুলের দাম কম।
সরেজমিনে রংপুর সিটি কর্পোরেশনের নজীরেরহাট, কাউনিয়া,তারাগঞ্জ,মিঠাপুকুর সহ বিভিন্ন উপজেলা ঘুরে গোলাপ, জারবেরা, রজনীগন্ধা,মামফুলসহ বিভিন্ন প্রজাতির ফুলের আবাদ করতে দেখা যায়।
আব্দুর রশিদ। অনেক কষ্ট ও চেষ্টার পরেও মেলেনি চাকরি। অর্জন করতে পারেননি অর্থ উপার্জনের পথ। নানা কিছু ভেবে যখন দিশেহারা রশিদ তখন মাথায় আসে নার্সারি করার চিন্তা।
একটা সময় নার্সারির প্রশিক্ষণ নিয়ে ভাগ্যের চাকা ঘুরেছে তার। ৪০ হাজার টাকার পুঁজি দিয়ে যাত্রা শুরু করে বর্তমানে সে লাখপতি। বাহারি ফুলের চাষ বদলে দিয়েছে তার জীবন। বিদেশি ফুল লিলিয়াম চাষে রংপুরে এই প্রথম সফল হয়েছেন তিনি। রংপুর নগরীর বুড়িরহাট ২ নং ওয়ার্ডের বাসিন্দা তিনি। রশিদের ফুলের বাগানে নানা জাতের প্রায় তিনশতাধিক ফুল রয়েছে। নার্সারিতে থেকে প্রতিদিন বিভিন্ন ফুল ও অন্যান্য চারা তিনি বিক্রি করছেন। বিদেশি জাতের লিলিয়াম ফুল চাষে সফল হয়েছেন তিনি। এই মৌসুমে বিক্রি করেছেন ১ হাজার ৭০০ লিলিয়াম।
একইসাথে জাতভেদে বাহারি গোলাপ, গ্লাডিওয়ালাস, চন্দ্রমল্লিকা, গাঁদাসহ নানান জাতের ফুল চাষ করে সফল এই উদ্যোক্তা। মাসে আয় করছেন ৪০ হাজার থেকে লাখ টাকা। তার নার্সারিতে শ্রমিক রয়েছে ৮ জন,পাশাপাশি কাজ করার সুযোগ পেয়ে থাকেন নারী শ্রমিকরা। তার দেখাদেখি ফুল চাষে উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন অন্যরাও। বেকারত্বকে না বলে তার এই উদ্যোগে খুশি আত্মীয়-স্বজন ও প্রতিবেশীরা।
আব্দুর রশিদের প্রতিবেশী চাচা বলেন, সবাইতো শুধু চাকরির পেছনে ছুটে, মোর ভাতিজা ওইলা আশা বাদ দিয়া ভাল কাম করছে ফুলের গাছ নাগেয়া। হামরাও আইসি ফুল দেখতে ভাল নাগে, ঘ্রানে চারোপাকে ভরা মেলা মানুষ আইসে। হামরা খুব খুশি ফুল দিয়া করি মিলে খাউক। কিন্তু এলা অনুষ্ঠান বেশি নাই এইজইনতে কামাই কম হয়ছে, নাতে আরও ভাল লাভ হইল হয়।
নার্সারিতে প্রবেশ মাত্রই মাঠ জুড়ে শোভা পাচ্ছে বাহারি রংয়ের নজরকাড়া গোলাপ, সুগন্ধে চারিদিকে ছুটছে মৌমাছি। এরইমধ্যে গাছের যতœ নিতে দৈনিক ব্যস্ত সময় পার করেন আব্দুর রশিদ। এছাড়াও চারিদিকে শোভা পাচ্ছে নেদারল্যান্ডসের আকর্ষণীয় ফুল লিলিয়াম। গ্লাডিওলাস দেখেই মুগ্ধ হচ্ছেন যে কেউ। দূর থেকে শুভ্রতা ছড়াচ্ছে পামফুল ও জিপসি। এই ফুল চাষের যথাযথভাবে বাজারকরতে পারলে অধিক লাভজনক। যার প্রতিটি স্টিক পাইকারি বিক্রি হচ্ছে ৭০-৯০ টাকা আর খুচরা বিক্রি হয় দেড়শ-দুইশ টাকার বেশি। তিনি জানান, মাত্র ৫ শতক জমিতে ৩০ হাজার টাকা ব্যয়ে লিলিয়াম চাষ করে তিন মাসে ৩ লাখ টাকা আয় করা সম্ভব।
সফল উদ্যোক্তা আব্দুল রশিদ বলেন, লেখাপড়া শেষ করে চাকরির জন্য অনেক ঘুরেছি। পরে বাধ্য হয়ে প্রশিক্ষণ নিয়ে শুরু ফুল চাষ। বর্তমানে অনেক ভালো আছি। এখন আমার এখানে ৮-১০ জন মানুষ কাজ করে। আগামীতে আরও বড় পরিসরে হাজার হাজার চারা নিয়ে ফুলের সমাহারে নিজের একমাত্র অবলম্বন করতে চাই। পরিবার নিয়ে বেশ ভালো আছি। তবে বর্তমানে অনুষ্ঠান কম থাকায় ফুলের চাহিদা কিছুটা কম। এই প্রথম আমার হাতে লিলিয়াম সফল। বিনামূল্যে চারা পেয়ে সফল হয়েছি এবং বেশ লাভবান হয়েছি।
ফুল চাষে লাভজনক হওয়ায় লিলিয়ামের পাশাপাশি গোলাপ, গাঁদা, রজনীগন্ধা, জিপসি, চন্দ্রমল্লিকা ও নানা প্রজাতির গ্লাডিওলাস ছাড়াও ধান,সবজিও চাষ করেন তিনি। নিজে স্বাবলম্বী হওয়ার পাশাপাশি অনেকের কর্মসংস্থানও সৃষ্টি করছেন বলে জানান আব্দুর রশিদ।
গবেষকরা জানান, রংপুর তামাকের আগ্রাসী অঞ্চল হলেও এখানকার মাটি ফুল চাষের জন্য উপযোগী। দুর্লভ লিলিয়াম হতে পারে ভাগ্যবদলের হাতছানি। আর তাই লিলিয়াম চাষে চাষিদের উদ্বুদ্ধ করে এই অঞ্চলে ফুল চাষির সংখ্যা বাড়ানো হচ্ছে বলেও জানান তারা।
জেলার সদর,কাউনিয়া,মিঠাপুকুর,তারাগঞ্জ,পীরগাছা,পীরগঞ্জ সহ রংপুর সিটি কর্পোরেশন জুড়ে ফুল চাষিদের সঙ্গে আলাপ করে জানা যায়,জেলা কৃষি অধিদপ্তরের বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হওয়ার মতো ফুলের উৎপাদন হয়েছে চলতি বছরে। কিন্তু গত বছর ফুলের উৎপাদন ভালো না হলেও দাম ভালো ছিল। এ বছরে ফুলের দাম গত বছরের তুলনায় অনেক কম বলে হতাশার কথা জানায় গোলাপ চাষিরা।সাতমাথা এলাকার গোলাপ চাষি মন্টু মিয়া বলেন, দোআঁশ মাটিতে মেরেন্ডা জাতের গোলাপের চাষাবাদ করা হয়। উর্বর ও নিষ্কাশিত জমিতে গোলাপ চারা রোপণ করলে ভালো ফলন পাওয়া যায়। গত কয়েক বছরের তুলনায় এ বছর ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। সিটি কর্পোরেশন নজীরেরহাট এলাকার ফুলচাষি আমিনুল ইসলাম বলেন, আমরা সারা বছর লাখ লাখ টাকা খরচ করেছি। এখন আমাদের জান বাঁচে না। এখন আমরা একটি ফুল পাইকারী ১৫-২০ টাকা বিক্রি করবো। কিন্তু এখন এক টাকা দেড় টাকা দাম।অপর ফুলচাষি সোলাইমান বলেন, এ বছর ফুলের উৎপাদন ভালো হয়েছে। গত বছর ফুল ছিল না কিন্তু বাজারে দাম ছিল ভালো। গত বছরের এই দিনে ফুলের দাম ছিল পাইকারী ১০-১২ টাকা। কিন্তু এখন আমরা ফুল বিক্রি করছি ৫-৬ টাকা দরে। এ বছর ফুলের উৎপাদন হয়েছে প্রচুর এবং বাগান ভালো আছে, তাই ফলন ভালো হয়েছে। গত বছর বাগান ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার কারণে ফুলের উৎপাদন কম হয়েছিল। তাই দাম বেশি ছিল। তবে তিন দিবসকে ঘিরে দাম ঠিক থাকলে লাভের আশা করছেন তিনি।অন্যদিকে রংপুরে গোলাপ গ্রাম খ্যাত নজীরেরহাট জনতা নার্সারির বাগানে প্রতিদিনই ভিড় করেন দর্শনার্থীরা। মনোমুগ্ধকর পরিবেশে ও ভালোবাসার প্রতীক হিসেবে প্রিয়জনদের হাতে তুলে দেন বাগানের তরতাজা গোলাপ।
রংপুর ঘাঘট সেনা প্রয়াসে ঘুরতে আসা মেহেবুব পারভেজ সুমন বলেন, লোকমুখে শুনেছি ও ইউটিউবে দেখেছি এখানে আসলে অনেক ভালো লাগে। এতো এতো ফুলের মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা যায়। চারদিকে অনেক মানুষ দেখে ভালো লাগছে। গোলাপ গ্রামটি অনেক সুন্দর।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক রিয়াজ উদ্দিন বলেন, জেলায় প্রায় ২৯৫ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ২১০ হেক্টর জমিতে গোলাপ ফুলের চাষ হয়েছে। অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছরের গোলাপের ফলন ভালো হয়েছে। তিন দিবস ঘিরে এ বছর গোলাপচাষিদের লাভের সম্ভাবনা রয়েছে। সব কিছু ঠিক থাকলে ২ কোটি টাকার ফুল বিক্রির লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে।
রংপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত পরিচালক ওবায়দুর রহমান মন্ডল জানান, আমরা প্রতিটি গ্রামে যুবকদের নানা ধরনের পরামর্শ দিচ্ছি, বলছি বসে না থেকে নিজেই উদ্যোক্তা হও। বাগানসহ অন্যান্য কাজ করো আমরা সহায়তা করব। আমরা রশিদকে নানা ধরনের পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছি। রশিদকে দেখে অনেক যুবক নার্সারি করার কথা ভাবছে। চাকরির পিছনে না ঘুরে প্রতিদিন রংপুরে সৃষ্টি হচ্ছে উদ্যোক্তা। এটি ভালো উদ্যোগ