নিজস্ব প্রতিবেদক:
রপ্তানির চেয়ে আমদানি করতে হয় বেশি। প্রবাসী আয়েও মন্দাভাব। বিদেশি ঋণের মাধ্যমে যে ডলার আসা কমেছে। ডলারের চরম সংকটে বাজার সামলাতে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রির ফলে কমছে রিজার্ভ। সবমিলিয়ে দেশের অর্থনীতিতে দুরবস্থা বেশ কিছু দিনের। তবে শুধু দেশে নয়, অর্থনীতির এ দৈন্যদশা বিশ্বজুড়েই। বৈশ্বিক এই সংকটের মধ্যেও পণ্য রপ্তানিতে কিছু সুখবর পাওয়া গেছে। ২০২১ সালে বৈশ্বিক তৈরি পোশাক রপ্তানি বাজারে আবারো দ্বিতীয় স্থান অর্জন করেছে বাংলাদেশ। ২০২০ সালে ভিয়েতনাম বাংলাদেশকে তৃতীয় অবস্থানে ঠেলে দিয়ে দ্বিতীয় হয়েছিল, সেই অবস্থান আবারও ফিরে এসেছ। অন্যদিকে সদ্য সমাপ্ত নভেম্বরে রপ্তানি আয়ের রেকর্ড হয়েছে। দেশের ইতিহাসে এক মাসে এত বেশি পরিমাণ রপ্তানি আর হয়নি কখনো। রপ্তানিখাত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বড়দিনকে সামনে রেখে বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশি তৈরি পোশাকের চাহিদা বেড়েছে। দেশে কয়েক মাস ধরেই দুশ্চিন্তার বড় বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ। সেটিকে আরও উসকে দিচ্ছিল প্রবাসী আয় ও পণ্য রপ্তানি। কারণ, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের প্রধান এ দুটি উৎস থেকে টানা দুই মাস (সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর) আয় কমেছে। তবে ইতিবাচক দিক হলো- সদ্য বিদায়ী নভেম্বর মাসে প্রবাসী আয়ও কিছুটা বেড়েছে। বাংলাদেশ থেকে চলতি বছরের নভেম্বরে ৫০৯ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে, যা চলতি বছরের ১১ মাসের মধ্যে সর্বোচ্চ। আর গত বছরের নভেম্বরের চেয়ে ২৬ শতাংশ বেশি। গত বছরের নভেম্বরে রপ্তানি হয়েছিল ৪০৪ কোটি ডলারের পণ্য। এদিকে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) হালনাগাদ পরিসংখ্যান থেকে জানা যায়, নভেম্বরে ভালো রপ্তানি হওয়ার কারণে চলতি অর্থবছরের সামগ্রিক পণ্য রপ্তানিতে প্রবৃদ্ধি বেড়েছে। অক্টোবর শেষে সামগ্রিকভাবে পণ্য রপ্তানিতে ৭ শতাংশ প্রবৃদ্ধি ছিল। নভেম্বর শেষে সেটি বেড়ে ১০ দশমিক ৮৯ শতাংশ হয়েছে। সব মিলিয়ে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরে জুলাই থেকে নভেম্বর পর্যন্ত পাঁচ মাসে ২ হাজার ১৯৫ কোটি ডলারের পণ্য রপ্তানি হয়েছে। দেশীয় মুদ্রায় যা ২ লাখ ১৯ হাজার ৫০০ কোটি টাকার কাছাকাছি। এর আগে, একক মাসের হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি রপ্তানি আয় এসেছিল এক বছর আগে গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে ৪৯০ কোটি ৭৭ লাখ (৪.৯০ বিলিয়ন) ডলার। দ্বিতীয় সর্বোচ্চ এসেছিল চলতি বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতে ৪৮৫ কোটি ৩ লাখ ৭০ হাজার (৪.৮৫ বিলিয়ন) ডলার। মার্চে এসেছিল ৪৭৬ কোটি ২২ লাখ ডলার। ফেব্রুয়ারিতে এসেছিল ৪২৯ কোটি ৪৫ লাখ (৪.২৯ বিলিয়ন) ডলার। এদিকে, বাংলাদেশ ব্যাংকের সর্বশেষ প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, রেমিট্যান্স আয়ও নভেম্বরে কিছুটা বেড়েছে। নভেম্বরে প্রবাসীরা বৈধ পথে ১৫৯ কোটি ৪৭ লাখ ডলার দেশে পাঠিয়েছেন। গত বছরের নভেম্বরে প্রবাসী আয় এসেছিল ১৫৫ কোটি ৩৭ লাখ ডলার। সেই হিসাবে, আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় গত মাসে প্রবাসী আয় আসা বেড়েছে ২ দশমিক ৫৮ শতাংশ।কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের জুলাই ও আগস্টে গড়ে ২০০ কোটি ডলারের বেশি প্রবাসী আয় বৈধ পথে দেশে পাঠিয়েছিলেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। জুলাইয়ে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার। আর আগস্টে ২০৩ কোটি ৭৮ লাখ ডলার। এরপর সেপ্টেম্বর ও অক্টোবরে প্রবাসী আয় কমে যায়। এদিকে, আমদানি খরচ বেড়ে যাওয়ায় ১৫ মাস ধরে কমছে রিজার্ভ। গত বছরের আগস্টে রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন বা ৪ হাজার ৮০০ কোটি ডলার ছাড়িয়েছিল। আমদানি দায় মেটাতে রিজার্ভ থেকে প্রতিনিয়ত ডলার বিক্রির কারণে তা কমে এখন ৩৪ বিলিয়ন বা ৩ হাজার ৪০০ কোটি ডলারের নিচে নেমে এসেছে। ডলার-সংকট দূর করতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরামর্শে ব্যাংকগুলো বিভিন্ন ধরনের লেনদেনের ক্ষেত্রে ডলারের দাম নির্ধারণ করে দিয়েছে। ব্যাংকগুলো এখন প্রবাসী আয় দেশে আনতে প্রতি ডলারের সর্বোচ্চ দাম দিচ্ছে ১০৮ টাকা। আর রপ্তানি আয় নগদায়নে ডলারের দাম ধরা হচ্ছে ১০০ টাকা। আমদানিতে ডলারের দাম ১০৫-১০৬ টাকা। একাধিক ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান, প্রবাসী আয়ে ডলারের যে দাম নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে, তা হুন্ডির চেয়ে বেশ কম। এ কারণে প্রবাসী আয় প্রেরণকারী প্রতিষ্ঠানগুলোও প্রবাসীদের থেকে ডলার কেনার পরও সেই ডলার বৈধ পথে দেশে না পাঠিয়ে হুন্ডির পথ বেছে নেয়। এ কারণে বৈধ পথে প্রবাসী আয় আসা কমে গিয়েছিল। এদিকে পণ্য রপ্তানিতে চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের শুরুটা ছিল খুবই ভালো। প্রথম দুই মাসে ৮৫৯ কোটি ডলার পণ্য রপ্তানি হয়। প্রবৃদ্ধিও ছিল ২৫ শতাংশ। তবে সেপ্টেম্বরে রপ্তানি কমে ৬ দশমিক ২৫ শতাংশ। অক্টোবরে কমে ৭ দশমিক ৮৫ শতাংশ। ইপিবির তথ্যানুযায়ী, চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে তৈরি পোশাক, চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য এবং চামড়াবিহীন জুতার রপ্তানি বেড়েছে। তবে হোম টেক্সটাইল, কৃষি প্রক্রিয়াজাত পণ্য, হিমায়িত খাদ্য, পাট ও পাটজাত পণ্য, রাসায়নিক পণ্য, প্রকৌশল পণ্যের রপ্তানি কমেছে। ইপিবির পরিসংখ্যান বলছে, মোট পণ্য রপ্তানির সাড়ে ৮৩ শতাংশ তৈরি পোশাক খাত থেকে এসেছে। চলতি অর্থবছরের প্রথম পাঁচ মাসে ১ হাজার ৮৩৩ কোটি ডলারের তৈরি পোশাক রপ্তানি হয়েছে। এই রপ্তানি গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ১৫ দশমিক ৬১ শতাংশ বেশি। পোশাকশিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএর সভাপতি ফারুক হাসান বলেন, রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে পোশাকের মূল বাজার যুক্তরাষ্ট্র এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোতে মূল্যস্ফীতি বেড়ে যায়। সেখানে পোশাক বিক্রিতে ধস নামে। তাতে রপ্তানির ক্রয়াদেশ আসাও কমে যায়। তবে ক্রয়াদেশ আবার আসতে শুরু করেছে। এটি দেশের জন্য ইতিবাচক। অর্থনীতি সংশ্লিষ্টরা বলছেন, রপ্তানি আয় বৃদ্ধির ধারা অব্যাহত রাখতে সরকারি-বেসরকারি খাত যে যার অবস্থান থেকে জোর প্রচেষ্টা চালাতে হবে। এই ইতিবাচক ধারা ধরে রাখতে পারলে আর কোনো সমস্যা হবে না। নভেম্বর মাসে রেমিট্যান্সও কিছুটা বেড়েছে। আইএমএফের প্রথম কিস্তির ঋণটাও ফেব্রুয়ারিতে পাওয়া যাবে। সব মিলিয়ে রিজার্ভের উপর যে চাপ সৃষ্টি হয়েছে, সেটা আর থাকবে না। সব মিলিয়ে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ঘুরে দাঁড়াবে বলে প্রত্যাশা সকলের।
আরও পড়ুন
রংপুরে বাংলাদেশ শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন মহানগর ও জেলা শাখার দ্বিবার্ষিক সম্মেলন
র্যাব রংপুরে ৩৫১.৩৮ গ্রাম হেরোইন সহ স্বামী-স্ত্রী আটক করেছে
দুর্নীতির ফাইল নষ্ট করতেই সচিবালয়ে আগুন: রংপুরে রিজভী