জেলা প্রতিনিধি, রাজশাহী:
বুধবার (২১ জুন) রাজশাহী সিটি করপোরেশন (রাসিক) নির্বাচন। সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত মোট ১৫৫টি কেন্দ্রে বিরতিহীনভাবে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। যে লক্ষ্যে মঙ্গলবার (২০ জুন) ভোট কেন্দ্রগুলোতে কঠোর নিরাপত্তা দিয়ে পাঠানো হয় নির্বাচনী সরঞ্জাম। মঙ্গলবার (২০ জুন) সকালে রাজশাহী নিউ গভ. ডিগ্রি কলেজ থেকে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ও ভোট কেন্দ্রের দায়িত্বে থাকা পুলিশ কর্মকর্তাদের ইভিএমসহ সকল সরঞ্জাম কেন্দ্রে কেন্দ্রে নিয়ে যাওযার জন্য নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে বুঝিয়ে দেয়া হয়। আর নির্বাচনের শৃঙ্খলা বিষয়ে মঙ্গলবার সকালে পৃথকভাবে সাংবাদিকদের সাথে মতবিনিময় করেছেন রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মো. আনিসুর রহমান ও র্যাব-৫ এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার। তারা জানান, স্থানীয় প্রশাসন নির্বাচনটি সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে পাঁচ স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছেন। ফলে মঙ্গলবার (২০ জুন) সকাল থেকেই মহানগরীতে পুলিশের পাশাপাশি র্যাব ও বিজিবি সদস্যদের টহল দিতে গেছে। আর মাঠপর্যায়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত নিয়ে দায়িত্ব পালন করছেন জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটরাও। তবে নগরীর বিভিন্ন এলাকায় ভোটকেন্দ্রীক সম্প্রতি ঘটে যাওয়া অনাকাঙ্খিত ঘটনাগুলোর আলোকে অনেকেই আশঙ্কা করেছেন, ভোটের মাঠে কাউন্সিলর পদের ভোটযুদ্ধ নিয়ে ত্রিমুখী ‘গ-গোল’ হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
এই নির্বাচনে মেয়র পদে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটনের বিপক্ষে শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী না থাকায় এ পদের ভোট অনেকটা নিরুত্তাপ হবে। নগরবাসী মনে করছেন- বিএনপি-জামায়াতের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত এই সিটিতে দল দুটির কেউ মেয়রপদে ভোট না করায় আজকের নির্বাচনে লিটন অনেকটা ফাঁকা মাঠেই গোল দিচ্ছেন। তবে ভোটের মাঠে আজ অনেকটা উত্তাপ ছড়াতে পারে কাউন্সিলর প্রার্থীরা। রাজশাহী সিটির ৩০টি ওয়ার্ডের মধ্যে অর্ধেকের বেশিতেই ক্ষমতাসীন দলের একাধিক নেতা-সমর্থক কাউন্সিলর পদে ভোট করায় নিজেরাই নিজেদের মধ্যে উত্তাপ ছড়াতে পারেন। আর আনুষ্ঠানিকভাবে ভোটে না গেলেও ১৬টি ওয়ার্ডে বিএনপির নেতারাও কাউন্সিলর-সংরক্ষিত নারী কাউন্সিলর পদে লড়াই করবেন। সবমিলিয়েই আজ ভোটের মাঠে কাউন্সিলর পদের ভোটযুদ্ধ নিয়ে ত্রিমুখী ‘গ-গোল’ হওয়ার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এদিকে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠান সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণভাবে করার লক্ষ্যে সতর্ক অবস্থানে রয়েছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। ভোটের পরিবেশ শান্তিপূর্ণ রাখতে পুরো নগরজুড়ে নিরাপত্তা বলয় গড়ে তুলেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। আনসার ও পুলিশ সদস্যের পাশাপাশি স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে নির্বাচনী মাঠে থাকছে র্যাব ও বিজিবি সদস্যরাও। কোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা ছাড়াই সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ পরিবেশে নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দেয়ার লক্ষ্যে এই তিন বাহিনী সদা-সচেষ্ট রয়েছে বলে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে।
অপরদিকে অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দিতে সবধরনের প্রস্তুতিও সেরেছে নির্বাচন কমিশন। ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিনসহ (ইভিএম) অন্য নির্বাচনী সরঞ্জাম মঙ্গলবার সন্ধ্যার আগেই সকল ভোটকেন্দ্রে পাঠানোর কাজ সম্পন্ন করেছে নির্বাচন কমিশন। এর আগে মঙ্গলবার বেলা ১১টায় রাজশাহী নিউ গভর্নমেন্ট ডিগ্রি কলেজ অডিটরিয়াম থেকে নির্বাচনী সরঞ্জাম বিতরণ শুরু করা হয়। এ সময় প্রিজাইডিং কর্মকর্তারা নির্বাচনী সরঞ্জামাদি বুঝে নেন। রাজশাহী বিভাগীয় কমিশনার জি এস এম জাফরউল্লাহ এবং সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন প্রিজাইডিং কর্মকর্তাদের মাঝে নির্বাচনী সরঞ্জাম বিতরণ করেন।
রাজশাহীর আঞ্চলিক নির্বাচন কর্মকর্তা কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, সিটি নির্বাচনে মোট ভোটকেন্দ্র রয়েছে ১৫৫টি (৩টি অস্থায়ীসহ)। সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন করতে একজন রিটার্নিং কর্মকর্তা ও ১০ জন সহকারী রিটার্নিং কর্মকর্তাসহ ৩ হাজার ৬২৫ জন নির্বাচনী কর্মকর্তা ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠান সম্পন্ন করবেন। আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন রয়েছে প্রায় সাড়ে ৩ হাজার পুলিশ ও আনসার সদস্য। এ ছাড়া স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে ৩০০ র্যাব ও ১০ প্লাটুন বিজিবি মোতায়েন করা হয়েছে। আর প্রতিটি ওয়ার্ডে একজন করে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দায়িত্ব পালন করবেন। এ ছাড়া মাঠে থাকছেন নির্বাচন কমিশনের ১০ জন নিজস্ব পর্যবেক্ষক।
রাসিক নির্বাচনে মেয়র পদে চারজন প্রার্থীর মধ্যে মূলত দুই প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। কারণ, বরিশাল সিটি নির্বাচন ইস্যুতে ইসলামি আন্দোলন বাংলাদেশের হাতপাখা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী হাফেজ মাওলানা মুরশিদ আলম ফারুকী আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন থেকে অনেক আগেই সরে দাঁড়ানোর ঘোষনা দেন। আর জাতীয় পার্টির লাঙ্গল প্রতিক নিয়ে সাইফুল ইসলাম স্বপন প্রতিদ্বন্দ্বীতায় থাকলেও তিনিও দলটির কেন্দ্রের পক্ষ থেকে সার্পোট না পাওয়ায় প্রকৃত ভোট যুদ্ধে মাঠে নেই বলে গত দুইদিন দেশের বিভিন্ন গনমাধ্যমে তার সাক্ষাতকার প্রকাশিত হয়েছে। এ প্রসঙ্গে লাঙ্গলের প্রার্থী সাইফুল ইসলাম স্বপনের সাথে গত সোমবার (১৯ জুন) দুপুরে মুঠোফোনে কৌঁসুলি আলাপকালে জানান, বিভিন্ন কারণে তিনি আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচন থেকে সরে দাড়াতে পারছেন না।
ফলে মেয়র পদে এবার ভোটের মাঠে রয়েছেন- আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীক নিয়ে দলটির সভাপতিম-লীর সদস্য ও রাসিকের সদ্য সাবেক হওয়া মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন এবং জাকের পার্টির গোলাপ ফুল প্রতীকে লতিফ আনোয়ার। তবে শুরু থেকেই নির্বাচনী মাঠ দখলে রেখেছেন নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী লিটন। তার নিকটতম শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী না থাকায় নগরবাসী মনে করছেন, তৃতীয়বারের মত পুনরায় নগরপিতার আসনে বসতে যাচ্ছেন নৌকার মেয়র প্রার্থী খায়রুজ্জামান লিটন। আর সিটির ১০টি সংরক্ষিত ওয়ার্ডে ৪৬ জন নারী কাউন্সিলর প্রার্থী আর ৩০টি সাধারণ ওয়ার্ডে ১১২ জন কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। এই সিটির ৩০ ওয়ার্ডের মধ্যে ৫টি ওয়ার্ডে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের ৪ জন করে, ১টি ওয়ার্ডে ৩ জন ও বাকি ১৩টি ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের ২ জন করে কাউন্সিলর প্রার্থী প্রতিদ্বন্দ্বীতা করছেন। এ ছাড়া সংরক্ষিত মহিলা কাউন্সিলরসহ ১৬টি ওয়ার্ডে বিএনপি সমর্থিত কাউন্সিলর প্রার্থীরা নির্বাচন করছেন। ইতোমধ্যেই বেশ কয়েকটি ওয়ার্ডে নির্বাচন পূর্ববর্তী সহিংসতায় জড়িয়েছিল ক্ষমতাসীন দলের কাউন্সিলর প্রার্থীরা। তাই নির্বাচনের দিনও তাদের মধ্যে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটনার সম্ভাবনা রয়েছে বলেও মনে করছেন সচেতন মহল।
এদিকে কোনো ধরনের অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ভোট গ্রহণের অনুষ্ঠান উপহার দেওয়ার আশাবাদ ব্যক্ত করেছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। এ বিষয়ে রাজশাহী মেট্রোপলিটন পুলিশ (আরএমপি) কমিশনার মো. আনিসুর রহমান মঙ্গলবার সকালে বলেন, ১৫৫ টি কেন্দ্রে ভোটগ্রহণ হবে। এর মধ্যে ১৪৮টি গুরুত্বপূর্ণ ও ৭টিকে সাধারণ ভোট কেন্দ্র হিসেবে চিহ্নত করা হয়েছে। কিন্তু আমরা সকল কেন্দ্রগুলোকেই গুরুত্বের সঙ্গে নিয়েছি। আর নির্বাচনকে সুষ্ঠু করতে আইন-শৃঙ্খলা পরিবেশ স্বাভাবিক রাখতে পুলিশের পাশাপাশি বিজিবি, র্যাব ও আনসার সদস্যবৃন্দ দায়িত্ব পালন করবে। নির্বাচন পূর্ববর্তী, নির্বাচনকালীন এবং নির্বাচন পরবর্তী সময়ে যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবেলায়ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রস্তুত রয়েছে বলেও জানান আরএমপি কমিশনার।
আর র্যাব-৫-এর অধিনায়ক লে. কর্নেল রিয়াজ শাহরিয়ার বলেন, নির্বাচন কমিশনের নির্দেশনা অনুযায়ী সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন নিশ্চিত করতে র্যাব বদ্ধ পরিকর। বুধবার ভোর ৬টা থেকে সিটি নির্বাচনে অন্যান্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর পাশাপাশি র্যাবের প্রায় ৩০০ সদস্য নিয়োজিত থাকবে। যারা মোবাইল ও স্ট্রাইকিং ফোর্স, সাদা পোশাকে গোয়েন্দা এবং বোমা নিষ্কিৃয়কারী হিসেবে নির্বাচনে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়োজিত থাকবে। এছাড়াও র্যাব সদরদপ্তরে থাকা স্পেশাল ফোর্স হেলিকপ্টারসহ যেকোনো পরিস্থিতিতে মোতায়েনের জন্য প্রস্তুত রয়েছে। আর সার্বিক পরিস্থিতি তদারকির জন্য নির্বাচন সেল ও কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে বলেও জানান র্যাব-৫ অধিনায়ক।
নির্বাচন কেমন হবে জানতে চাওয়া হলে আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের মেয়রপ্রার্থী এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, ‘বেশ উৎসবমুখর পরিবেশেই ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। তবে বিএনপি-জামায়াত মেয়র পদে নির্বাচনে অংশ নিলে হয়তো আরো বেশি উৎসবমুখর হতো। আরেক প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, কাউন্সিলর পদের জন্য দুই-একটি জায়গায় হয়তো কিছুটা উত্তাপ ছড়ানোর আশঙ্কা রয়েছে। তবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা অত্যন্ত সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। এছাড়াও সকল অপ্রীতিকর ঘটনা এড়াতে আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা প্রশাসনকে সহযোগিতা করতে মাঠে কাজ করবে বলেও জানান আওয়ামী লীগের এই প্রেসিডিয়াম সদস্য লিটন।
রাজশাহী সিটি নির্বাচনের রিটার্নিং কর্মকর্তা মো. দেলোয়ার হোসেন বলেন, সুষ্ঠুভাবে ভোট সম্পন্ন করতে আমাদের সকল ধরনের প্রস্তুতি রয়েছে। কেন্দ্র ছাড়াও নির্বাচনী এলাকার গুরুত্বপূর্ণ স্থানগুলোতে ১ হাজার ৫৬০টি সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করা হয়েছে। তাই কোথাও কোনো অনিয়মের সুযোগ নেই। যেকোনো পরিস্থিতি মোকাবিলায় নির্বাচন কমিশন প্রস্তুত রয়েছে। তিনি বলেন, সকাল ৮টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ইভিএমে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে। এ নির্বাচনে ৩ লাখ ৫১ হাজার ৯৮২ জন ভোটার রয়েছেন। এরমধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৭১ হাজার ১৬৭, নারী ভোটার ১ লাখ ৮০ হাজার ৮০৯ জন। এ ছাড়া তৃতীয় লিঙ্গের ভোটার রয়েছে ৬ জন। আর সুষ্ঠুভাবে নির্বাচন অনুষ্ঠান উপহার দিতে সকলের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেছেন রিটার্নিং কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন।
আরও পড়ুন
সাংবাদিকদের সাথে রংপুর পুলিশ সুপারের মতবিনিময়
আশুলিয়ায় মরদেহ পোড়ানোর মামলায় কনস্টেবল মুকুল কারাগারে
শীতে শিশুদের সুস্থ রাখবে যেসব খাবার