September 19, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Friday, September 19th, 2025, 7:59 pm

রোজ গার্ডেন কেলেঙ্কারি: হাসিনার ইচ্ছেপূরণে রাষ্ট্রের ক্ষতি ৩৩২ কোটি

ছবি: মঈন আহমেদ

 

রেজা মাহমুদ

পদচ্যুত প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতায় থাকাকালীন সময় রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা ব্যয় করে পুরান ঢাকার ঐতিহাসিক ভবন ‘রোজ গার্ডেন’ অধিগ্রহণ করেছিলেন।

অভিযোগ উঠেছে, এটি ছিল তার ‘ব্যক্তিগত ইচ্ছেপূরণ’, যা বিশেষজ্ঞরা স্বৈরাচারী মানসিকতার ভয়াবহ দৃষ্টান্ত হিসেবে আখ্যা দিয়ে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি করেছেন।

সূত্র জানায়, হাসিনা গুলশানে এক বিঘা জমিসহ শত কোটি টাকার বাড়িও হস্তান্তর করেন, যাতে রাষ্ট্রীয় কোষাগারের ক্ষতি আনুমানিক ৩৩২ কোটি টাকায় গিয়ে দাঁড়ায়।

গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা জানান, অধিগ্রহণ থেকে রেজিস্ট্রেশন ও অর্থ প্রদান— সব ধাপেই অনিয়ম ও দুর্নীতি হয়েছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টারা বলছেন, এই চুক্তি সরকারি ক্রয় আইনসহ কমপক্ষে তিনটি আইন লঙ্ঘন করেছে। এক উপদেষ্টা বলেন, ‘যতই নথিপত্র পর্যালোচনা করছি, ততই বিস্মিত হচ্ছি।’ তিনি হাসিনার বিরুদ্ধে নির্বাহী ক্ষমতার চরম অপব্যবহারের অভিযোগ তোলেন।

বিশেষজ্ঞরা বলেন, একজন সাবেক প্রধানমন্ত্রী যদি শুধু তার দলের স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষার জন্য কয়েক শত কোটি টাকা রাষ্ট্রীয় অর্থ ব্যয় করেন, তবে সেটি গুরুতর দুর্নীতি। তারা আরও বলেন, একটি দরিদ্র দেশে ৩৩২ কোটি টাকা বিশাল অঙ্ক, যা দারিদ্র্য বিমোচনে যথেষ্ট সহায়ক হতে পারত।

টিআইবি’র নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান দ্য নিউ নেশন-কে বলেন, ‘শুধুমাত্র হাসিনার ইচ্ছেপূরণে জন্য রাষ্ট্রীয় কোষাগার থেকে প্রায় ৩৩২ কোটি টাকা ব্যয় করা সরকারি অর্থ লুটপাটের এক ভয়াবহ উদাহরণ। দলীয় স্মৃতিস্তম্ভ রক্ষা জনগণের স্বার্থ নয়, তাই এ বিষয়ে বিচার হওয়া উচিত।’

তিনি আরও বলেন, ‘যদি রাষ্ট্র এ ঘটনায় কঠোর শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়, তবে এটি হবে ভয়াবহ দৃষ্টান্ত— যেখানে এত বড় অপরাধও শাস্তি ছাড়া রয়ে যাবে। হাসিনার বিরুদ্ধে দৃষ্টান্তমূলক ব্যবস্থা নিলে ভবিষ্যতে কোনো প্রধানমন্ত্রী এমন ন্যাক্কারজনক কাজ করার সাহস পাবেন না।’

মূল্য কারসাজি: প্রথমে আন্তঃমন্ত্রণালয় কমিটি বাড়িটির মূল্যায়ন করে ১০৫.২৯ কোটি টাকা। বিক্রেতার আপত্তির পর তা বাড়িয়ে ২১০.৫০ কোটি টাকা করা হয়। ২০১৮ সালের মে মাসে হাসিনা ৩৪০ কোটি টাকার প্রস্তাবে অনুমোদন দেন। শেষ পর্যন্ত ৩৩১.৭০ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয়, যার কোনো যৌক্তিক ব্যাখ্যা নথিতে নেই। এ ছাড়া গুলশানের এক বিঘা জমি বিক্রেতাদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে দেওয়া হয়। জমিটি বর্তমানে এক বেসরকারি ডেভেলপারের হাতে উন্নয়নাধীন। তবে এই অতিরিক্ত অর্থের কতটা প্রকৃত মালিকদের হাতে পৌঁছেছে তা স্পষ্ট নয়।

আইন মন্ত্রণালয় উপেক্ষিত: প্রস্তাবটি প্রথমে আইন মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হলেও আইন কর্মকর্তারা এটিকে অবৈধ বলেন। পরে ফাইলটি প্রত্যাহার করা হয়। পরে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক শুধুমাত্র মৌখিকভাবে অনুমোদন দেন, উল্লেখ করে যে এটি ‘উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা’ অনুযায়ী।

এক সিনিয়র আইন কর্মকর্তা বলেন, প্রস্তাবটির কোনো আইনগত ভিত্তি ছিল না, কেবল প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছাই ছিল এর একমাত্র ভিত্তি। সরকারি ক্রয় আইন অনুযায়ী প্রতিযোগিতামূলক জরিপ বাধ্যতামূলক হলেও তা উপেক্ষা করা হয়, যেহেতু এটি রাষ্ট্রীয় প্রয়োজন নয়, বরং রাজনৈতিক স্বার্থ পূরণে করা হয়েছিল।

সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের দখল: ২০১৯ সালের ১৭ জুলাই বাড়িটি গণপূর্ত থেকে মাত্র ১০০১ টাকায় সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ে হস্তান্তর করা হয়। বর্তমানে সম্পত্তিটি জাতীয় জাদুঘর, শিল্পকলা একাডেমি এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের মধ্যে ভাগ করে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

কর্মকর্তারা স্বীকার করেন, ভবনটি ১৯৮৯ সালে একবার ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা হিসেবে ঘোষিত হলেও পরে হাইকোর্ট এটি আবার ব্যক্তিমালিকানায় ফিরিয়ে দেয়। স্থানীয়রা জানান, এর আসল নাম ছিল ‘রশিদ মঞ্জিল’, যা ১৯৩১ সালে ঋষিকেশ দাস নির্মাণ করেন এবং পরবর্তীতে এটি হুমায়ুন রশিদের মালিকানায় আসে।

জনপ্রতিক্রিয়া ও অন্তর্বর্তী সরকারের অবস্থান: টিকাটুলির প্রবীণ বাসিন্দারা ‘রোজ গার্ডেন’ নামটিকে হাস্যকর বলে আখ্যা দিয়েছেন। একজন বলেন, ‘এটা হুমায়ুন সাহেবের বাড়ি।’ অন্যজনের মন্তব্য, হাসিনা বাড়িটির গুরুত্ব অতিরঞ্জিত করেছিলেন।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট হাসিনার পতন ও দেশত্যাগের পর অন্তর্বর্তী সরকার দ্রুত আওয়ামী লীগ-সংক্রান্ত ফলক ও প্রতীক সরিয়ে ফেলে। সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের সচিব মোফিদুর রহমান বলেন, ‘এখন সম্পত্তিটি রাষ্ট্রের, কোনো দলের নয়। আমরা এটিকে জাতীয় ঐতিহ্য হিসেবে সংরক্ষণ করছি।’

সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা রাষ্ট্রের কোটি কোটি টাকার ব্যয় প্রসঙ্গে বলেন, ‘এখানে একটি পুকুর ও একটি পুরোনো ভবন আছে। হয়তো জাদুঘর কিছু প্রদর্শনী যুক্ত করবে। তবে যা স্পষ্ট তা হলো, একজন ব্যক্তিকে খুশি করতে রাষ্ট্রীয় সম্পদ থেকে ৪০০ কোটিরও বেশি টাকা অপচয় করা হয়েছে।’

লেখক
প্রধান প্রতিবেদক
দ্য নিউ নেশন

এনএনবাংলা/