জেলা প্রতিনিধি, মৌলভীবাজার:
মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জের লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রাণীদের অবাধ বিচরণ অনেকটা কমে গেছে। অব্যবস্থাপনা, অতিরিক্ত মানুষের আনাগোনা, চুরি করে গাছ-বাঁশ উজাড়, বনের ভেতর রেল ও সড়কপথ করাসহ বিভিন্ন কারণে বনে প্রাণীদের বিচরণ কমে এসেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে বনে প্রাণীর সংখ্যা কমে যাওয়ার বিষয়টি মানতে নারাজ বন বিভাগ।
বন বিভাগের দাবি, বনে বানর ও শূকর প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। তবে অন্যান্য কত প্রজাতির প্রাণী আছে এবং তার নিদিষ্ট সংখ্যা কত তা জানা নেই কারোর।
দেশের সাতটি বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য ও ১০টি জাতীয় উদ্যানের মধ্যে অন্যতম লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান। এটি সংরক্ষিত বনাঞ্চল। ১৯৯৬ সালে লাউয়াছড়াকে ‘জাতীয় উদ্যান’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। এই জাতীয় উদ্যানে একটা সময় ৪৬০ প্রজাতির দুর্লভ উদ্ভিদ ও প্রাণী ছিল। এর মধ্যে ১৬৭ প্রজাতির উদ্ভিদ, চার প্রজাতির উভচর, ছয় প্রজাতির সরীসৃপ, ২৪৬ প্রজাতির পাখি ও ২০ প্রজাতির স্তন্যপায়ী প্রাণী থাকলেও বর্তমানে কী পরিমাণ উদ্ভিদ ও প্রাণী রয়েছে এর বাস্তব সংখ্যা নিয়ে রয়েছে ধোঁয়াশা। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানের আয়তন ১ হাজার ২৫০ হেক্টর লেখা থাকলেও নেই সীমানাপ্রাচীর। বনের পাশে যাদের বাড়িঘর ও জমি রয়েছে, তাদের অনেকেই বনের জমি দখল করে রেখেছেন। অনেকে আবার বনের জমি দখল করে গড়েছেন বাগান। বন বিভাগ এসব জায়গা উদ্ধারে অভিযান চালালেও সীমানার চিহ্ন না থাকায় বাধাগ্রস্ত হয় উদ্ধারকাজ। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে প্রাণীদের অবাধ বিচরণ কমে গেছে। পরিবেশকর্মীরা বলছেন, বনে প্রাণী কমা ও অবাধ বিচার না করার কয়েকটি কারণ রয়েছে। অতিরিক্ত পর্যটক প্রবেশ, বনের মূল্যবান গাছ-বাঁশ চুরি, বনের ভেতর দিয়ে বয়ে চলা রেল ও সড়ক পথসহ বিভিন্ন কারণে প্রাণী কমেছে। বিশেষ প্রতিনিয়ত রেল ও সড়ক পথে গাড়িচাপায় পিষ্ট হয়ে অনেক প্রাণী মারা যাচ্ছে। লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান বিলুপ্তপ্রায় উল্লুকের জন্য বিখ্যাত ছিল। তবে বর্তমানে কী পরিমাণ উল্লুক রয়েছে তা জানা নেই বন বিভাগের।
অনুসন্ধানে জানা যায়, ২০১৮-২০১৯ সালে লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে পর্যটক প্রবেশ করেছেন এক লাখ ৩৫ হাজার ৮১২ জন। দেড় বছর করোনার কারণে বন্ধ ছিল। ২০২৩-২০২৪ সালে পর্যটকের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় এক লাখ ৬২ হাজার ৬৭২ জন। সবশেষ ২০২৪ সালের জুলাই থেকে চলতি বছরের জুন পর্যন্ত এক লাখ ৬০ হাজার ৩৮৫ জন পর্যটক টিকিট কেটে উদ্যানে প্রবেশ করেছেন। ২০১৪ সালের জরিপে দেখা যায়, লাউয়াছড়া বনে ২৪৭ প্রজাতির প্রাণী রয়েছে, ১৬৭ প্রজাতির বিভিন্ন প্রজাপতি, ১২০ প্রজাতির অর্কিড ও ১৬৭ প্রজাতির অর্কিড ও উদ্ভিদ রয়েছে।
তবে বন বিভাগ বলছে, বনে প্রাণীর সংখ্যা কমেনি। বন্যপ্রাণী, পাখি, শূকরসহ বিভিন্ন প্রাণীর সংখ্যা বেড়েছে। দিনের বেলা প্রাণী দেখা না গেলেও ভোরে দেখা যায় অনেক প্রাণী। বিশেষ করে অতিরিক্ত পর্যটকের হই-হট্টগোল, গাড়ি ও ট্রেনের আওয়াজ ও জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে প্রাণীরা লোকালয় থেকে একটু দূরে চলে যায়। এসব কারণে প্রাণী কম দেখা যায় বনে। পর্যটন আর বনের প্রাকৃতিক পরিবেশ একসঙ্গে রক্ষা করা কঠিন।
সরেজমিনে বনের ভেতরে দেখা যায়, একদল বানর উদ্যানের ভেতর ঘুরে বেড়াচ্ছে। অনেক পর্যটক বানরের দলকে বিভিন্ন খাবার দিচ্ছেন। তবে অন্য কোনো প্রাণী দেখা যায়নি।
স্থানীয়রা বলছেন, একটা সময় এই বন ঘনত্বের কারণে সূর্যের আলো সরাসরি পড়তো না। এখন সেই ঘনত্ব নেই। আগে বনের মধ্যে প্রচুর পরিমাণে বন্যপ্রাণী দেখা গেলেও এখন বানর ছাড়া আর কিছুই দেখা যায় না।
বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন (বাপা) জাতীয় পরিষদের সদস্য সালেহ সোহেল বলেন, ‘লাউয়াছড়ায় প্রাণীরা এখন নিরাপদ নয়, এজন্য কমে যাচ্ছে। বিশেষ করে বনে খাবারের সংকট রয়েছে। পর্যাপ্ত খাবার না থাকলে বনে প্রাণীরা থাকবে না।’
বন্যপ্রাণী রক্ষায় পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, ‘চা বাগানের কীটনাশক মিশ্রিত পানি ছড়ায় এসে পড়ে। এজন্য অনেক প্রাণী মারা যায়। এগুলো বন্ধ করতে হবে। পর্যটক প্রবেশ কমাতে হবে। রেল ও সড়ক পথে গাড়ি নিয়ন্ত্রণে আনতে হবে, তাহলে যে টুকু প্রাণী আছে এগুলো রক্ষা করা যাবে।’
ক্রিয়েটিভ কনজারভেশন অ্যালায়েন্সের প্রধান নির্বাহী ও বন্যপ্রাণী গবেষক শাহরিয়ার সিজার রহমান বলেন, ‘লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যানে কী পরিমাণ প্রাণী রয়েছে তা বলা কঠিন। তবে এই বনে তীব্র পানির সংকট রয়েছে। পানির অভাবে অনেক প্রাণী হারিয়ে যাচ্ছে।’
তবে বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) জামিল মোহাম্মদ খানের দাবি, লাউয়াছড়া বনে বানর ও শূকর প্রচুর পরিমাণে বেড়েছে। তবে অন্যান্য প্রাণী বেড়েছে না কমেছে, তা নিয়ে গবেষণা ও সার্ভে করলে জানা যাবে।
বন্যপ্রাণীর নিরাপদে চলাচলের জন্য বন বিভাগ থেকে সর্বোচ্চ চেষ্টা করা হচ্ছে বলে জানান বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের সিলেট বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মো: আবুল কালাম। তিনি বলেন, বিভিন্ন কারণে এখন বনে প্রাণী কম দেখা যায়। বিশেষ করে অতিরিক্ত পর্যটক, বনের ভেতর মানুষের চলাচল, সড়ক ও রেলপথে গাড়ি চলাচলের কারণে। গাড়ির আওয়াজে প্রাণীরা নিরাপদে দূরে চলে যায়। প্রাণীরা সবসময় নিরিবিলি জায়গায় থাকতে চায়। তবে অনেকগুলো কারণে লাউয়াছড়া বনের প্রাণীরা নিরাপদে থাকতে পারছে না। উদ্যানের সীমানা নির্ধারণের জন্য সেটেলমেন্ট অফিসে চিঠি পাঠানো হয়েছে বলেও জানান বন কর্মকর্তা।

আরও পড়ুন
কুড়িগ্রামে বিজিবির বিশেষ অভিযানে ভারতীয় গরু–মদ জব্দ
নাসিরনগরে আইন-শৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা অনুষ্ঠিত
আওয়ামী লীগের দালাল খেতাব দিয়ে মোরেলগঞ্জ থানার ওসির অপসারণ দাবিতে মানববন্ধন