সৈয়দ তোশারফ আলী
গত এপ্রিলের শেষ সপ্তাহে একটি বহুল প্রচারিত দৈনিক পত্রিকায় বর্ষীয়ান অর্থনীতিবিদ রেহমান সোবহানের একটি চমৎকার রাজনৈতিক বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়। লেখাটির শিরোনাম ছিল “একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার চ্যালেঞ্জ”। (প্রথম আলো ২৩ এপ্রিল ২০২৫) এর ঠিক পরের দিন “একটি নতুন রাজনৈতিক ব্যবস্থার পথরেখা” শিরোনামে আরও একটি লেখা প্রকাশিত হয়। বস্তুত লেখাটি সুদীর্ঘ হওয়ায় পত্রিকাটি একটি লেখা দুই কিস্তিতে ভিন্ন শিরোনাম দিয়ে প্রকাশ করে।
সে যা-ই হোক আজকের দিনে দীর্ঘ লেখার পাঠক বিরল । যদিও দীর্ঘ নিবন্ধ পড়ার অভ্যাস আমার আশৈশব। আর সে লেখা যদি হয় বিশ্লেষণ মূলক তবে তো সোনায় সোহাগা। ড. রেহমান সোবহানের বিশ্লেষণে কেবল অতীত নয় সমকালীন জুলাই গণঅভ্যুত্থানের বিষয়ও সবিশেষ গুরুত্ব পেয়েছে। তার বিশ্লেষণ পড়তে গিয়ে এতো দিনের নিরুত্তর কিছু প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা থেকে এই লেখাটির জন্ম। আলোচনার শুরুতে চলুন নিকট অতীত থেকে কিছু সময় ঘুরে আসি।সময়টা ১৯৬১ সাল। ইতোমধ্যে পাকিস্তানে সামরিক শাসন দৃঢ়মূল হয়ে বসেছে এবং যার প্রভাব শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত ছড়িয়ে পড়েছে। ঠিক এ রকম পটভূমিতে ঢাকার ইসলামিক একাডেমীতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েরই একজন তরুণ অর্থনীতির শিক্ষক পাকিস্তানি অর্থনীতির উপর একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন । প্রবন্ধটির শিরোনাম ছিল — “How to build Pakistan into a well -knit Nation.” সেদিনের এই তরুণ শিক্ষকই ছিলেন আজকের প্রাজ্ঞ রেহমান সোবহান। একথা অনস্বীকার্য যে ,তার সেই প্রবন্ধটি ছিল মূলত “স্বাধিকার আন্দোলনের এক অগ্নিস্ফুলিঙ্গ” ।
জাতীয় অর্থনীতির অবিভাজ্য চরিত্র রয়েছে। এ সম্পর্কে সচেতন থাকলে সমগ্রের সঙ্গে অংশের আন্ত:সম্পর্ককেও গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করতে হয়। একে বিচ্ছিন্ন বা বিভক্ত করে দেখলে আর একক সত্তা অক্ষুন্ন থাকে না। এই সত্য অর্থনীতির ছাত্র হিসেবে রেহমান সোবহান সম্যকভাবে জানতেন বলেই আমাদের ধারণা। তারপরও তিনি পাকিস্তানের দুই অংশের বিকাশমান অর্থনীতির উন্নয়ন বিচারে পরিসংখ্যান তত্ত্ব ব্যবহার করে তার নিবন্ধে Dual Economic theory-র পক্ষে যুক্তি তুলে ধরেন। এই কাজ করতে গিয়ে তিনি সেদিন জাতীয় অর্থনীতির অবিভাজ্যতাকে একদিকে উপেক্ষা করেন অন্যদিকে অসম উন্নয়ন যে পুঁজিবাদী অর্থনীতির চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য এই বৈজ্ঞানিক সত্যকেও আড়াল করেন। একাজ করতে গিয়ে তিনি ঐক্যমুখীন ভাবনার জায়গায় সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী দৃষ্টিভঙ্গিকে সামনে নিয়ে আসেন। তার এই “এক দেশ, দুই অর্থনীতি ” নতুন সংকটের সৃষ্টি করে। যে সংকট থেকে পাকিস্তান বেরিয়ে আসতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়। তিনি ছিলেন মার্ক্সবাদী ঘরনার অর্থনীতিবিদ কিন্তু শ্রমিক শ্রেণীর দৃষ্টিতে আর্থ-রাজনীতির বিশ্লেষণে খুব পরিপক্ক ছিলেন একথা বলা যাবে না। কারণ, তার তত্ত্ব দর্শন শ্রমিকদের সংহতির পক্ষে করেনি। পাকিস্তানের অর্থনীতি বিশ্লেষণ করতে গিয়ে তিনি লক্ষ্য করেন পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতির চালচিত্র দুই অংশে দুই ধরনের। উন্নয়ন প্রক্রিয়ায়ও ভিন্নতা রয়েছে। এটা থাকাই কি স্বাভাবিক ছিল না? কারণ, পূর্ব বাংলাকে যখন পশ্চিমাংশের সঙ্গে জুড়ে দিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রটি গঠন করা হয় তখন পূর্ব বাংলা ছিল একটি রুরাল স্লাম বা গ্রাম্য বস্তি। একথা বাংলার গভর্নর ফ্রেডরিক বারোজ এবং পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু জোর দিয়েই বলেছিলেন। বারোজ চেয়েছিলেন বাংলাকে অখন্ড রাখতে আর নেহরু চেয়েছিলেন আপাতত: পূর্ব বাংলাকে পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হোক, তারপর অর্থনৈতিকভাবে ভায়াবেল না হতে না পেরে পূর্ব বাংলা “ঘরে ফিরে”আসবে। তখন গোটা বাংলা হবে ভারত ইউনিয়ন ভুক্ত। আপনারা সবাই জানেন, এটাই ছিল নেহেরু ডকট্রিন। আমাদের ধারণা এ ডকট্রিন সম্পর্কে রেহমান সোবহান সাহেবেরও সম্যক ধারণা ছিল।
তিনি ভাল করেই জানতেন ও বুঝতেন পুঁজিবাদী উন্নয়ন প্রক্রিয়া বৈষম্যমূলক না হয়ে পারে না। এ কারণে উন্নয়নের ক্ষেত্রে পাকিস্তানেও আঞ্চলিক বৈষম্য সৃষ্টি হয়েছিল । কিন্তু তার সমাধান খোঁজার দরকার ছিল পরিকল্পিত অর্থনৈতিক কার্যক্রমের মাধ্যমে। আর রাজনৈতিক ইতিহাস ও অভিজ্ঞতার আলোকে দাবি তোলা জরুরি ছিল শেরেবাংলা আবুল কাশেম ফজলুল হকের লাহোর প্রস্তাব বাস্তবায়ন করার। আবুল হাশিম সাহেব ঠিক এই প্রশ্নে মুসলিম লীগের দিল্লি কনভেনশনে দৃঢ় ভূমিকা রেখেছিলেন। লাহোর প্রস্তাবের মূল কথা ছিল ,”এক জাতি, দুই দেশ “। এই চিন্তা মাথায় নিয়ে অগ্রসর হলে বিষয়টি অবশ্যই ভিন্ন মাত্রা পেতো। রাজনৈতিক চিন্তক আবুল মনসুর আহমদ একাত্তরের অর্জনকে লাহোর প্রস্তাবের বাস্তবায়ন হিসেবেই দেখেছেন। কিন্তু মুসলিম জাতিসত্তা সমুন্নত রাখার ব্যাপারে অনীহার কারণ ছিল সেক্যুলার রাষ্ট্রচিন্তা। এমনকি রেহমান সোবহান সাহেবও যদি অসম উন্নয়নের প্রাসঙ্গিক উপসর্গকে পুঁজিবাদী বিকাশের অপরিহার্য অনুষঙ্গ হিসেবে দেখতেন তাহলেও তার যৌক্তিক সমাধান হয়তো বা তিনি ভিন্নভাবে খুঁজতেন। সে পথে তিনি যেমন হাঁটেননি তেমনি অন্যদের মধ্যে নূরুল ইসলাম, আবু মাহমুদ,আখলাকুর রহমান, আনিসুর রহমান, মোজাফফর আহমদ, মোশাররফ হোসেন প্রমুখ অর্থনৈতিক চিন্তকদেরও হাঁটতে দেখা যায়নি। তারাও রেহমান সোবহান সাহেবের বাইরে নতুন কিছু বলতে পারেননি। বস্তুত,তারা কেউ শ্রমিক শ্রেণী তথা মেহনতি মানুষের স্বার্থ রক্ষার্থে কিংবা মালিক শ্রেনীর স্বার্থ রক্ষার্থে পাকিস্তানি অর্থনীতির বিচার বিশ্লেষণ করতে পারেননি । মালিক ও শিল্প শ্রমিক স্বার্থের বিচারে পরস্পর বিরোধী হলেও তাদের একের স্বার্থ ছিল অপূরের স্বার্থের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। তাদের এই ব্যর্থতার জন্য মালিক ও শ্রমিক উভয়ের সংহতি উগ্র জাতীয়তাবাদী ঝড়ে ছত্রখান হয়ে যায়। সেদিন যদি সঠিক তত্ত্ব দর্শন সামনে থাকতো তাহলে হয়তো একাত্তরের অনাকাঙ্ক্ষিত রক্তপাত ও জীবনহানি এড়ানো যেতো। সেটা যে সম্ভব হয়নি তার একাধিক কারণের মধ্যে সঠিক বিশ্লেষণের অভাবও ছিল অন্যতম।
বলা হতে পারে যে, মহতী লক্ষ্য অর্জনে অপরিমেয় আত্মদানের অসংখ্য নজির আছে ইতিহাসে । কিন্তু সেই আত্মদান যদি ব্যক্তি ও গোষ্ঠীকে সুপ্রতিষ্ঠিত করার কাজে ব্যবহৃত হয় আর সাধারণ মানুষের সুন্দর জীবনের স্বপ্ন থেকে যায় নাগালের বাইরে তাহলে কি উদ্দেশ্যের সততা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে না? এই ব্যর্থতাই আমাদের ট্র্যাজেডি, যার ছায়া পড়ছে বর্তমানের উপর এবং বিঘ্নিত করছে আমাদের অগ্রযাত্রা।
অভিজ্ঞতার আলোকে আমাদের বুঝতে হবে যে রাজনীতিতে ব্যক্তির বিস্ময়কর উত্থান এবং বিপুল সংখ্যক বিভিন্ন শ্রেনী ও পেশার মানুষের আত্মদান সমাজ পরিবর্তনে তখনই সার্থক ভূমিকা রাখতে পারে যখন ঘোষিত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ একদল কর্মী একাগ্র চিত্তে তা বাস্তবায়ন করতে লেগে যায়। যার অভাবে বাংলাদেশ এক ভয়ংকর পরিস্থিতির শিকার হয়। অর্থনীতির চেহারা আগের অবস্থায় ফেরানো কঠিন হয়ে পড়ে। আইন শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি, দুর্নীতি ও দুর্ভিক্ষ সাধারণ মানুষের চোখের ঘুম কেড়ে নেয়। অনাহার থেকে বাঁচাতে কয়েক হাজার নাঙ্গরখানা খোলা হয়। সোনার বাংলার স্বপ্ন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। পরিস্থিতি সামাল দিতে গণতন্ত্রের বদলে একদলীয় ব্যবস্থাকে উপযোগী বিবেচনা করা হয়। ঘোষণা করা হয় দ্বিতীয় বিপ্লব । গঠন করা হয় বাকশাল । বদলে ফেলা হয় সংবিধান । ন্যাপ , সিপিবি ও ছাত্র ইউনিয়নের নেতা কর্মীরা উৎসাহ নিয়ে নতুন ব্যবস্থাকে স্বাগত জানায়। কারণ,তখন তারা অধনবাদী বিকাশের এক অদ্ভুত তত্ত্ব হাজির করেন। পরিস্থিতির অবনতি দেখে রেহমান সোবহান সাহেবরা অনুতাপে ভোগার বদলে সেদিন এসব অগণতান্ত্রিক পদক্ষেপের অনুকূলেই ছিলেন। কারণ ,দেশ সমাজতন্ত্রী ব্লকের অভিমূখী হচ্ছে দেখে তাদের মধ্যে বাড়তি উৎসাহ কাজ করছিল। কিন্তু একনিষ্ঠ সমাজবাদী তাজউদ্দিন সাহেবের কোন সম্পৃক্ততা এসবের সঙ্গে ছিল বলে আমাদের জানা নেই । গড্ডালিকা প্রবাহে গা না ভাসিয়ে রাজনৈতিক চরিত্রের বিশুদ্ধতা রক্ষায় দৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক এমএজি ওসমানী ও ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন। আসলে স্রোতের প্রতিকূলে চলার সাহস ও নৈতিক শক্তি সবার থাকে না। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বিক্ষুব্ধ সেনারা এই নতুন বাকশালী পরিকল্পনার ইতি টেনে দেয়। এ কাহিনী সবাই জানেন। তাই পুরোনো কাসুন্দি না ঘেটে চলুন রেহমান সোবহান সাহেবের বিষয়ে ফিরে যাই। প্রাজ্ঞ ব্যক্তি হিসেবে জুলাই -আগসট গণ অভ্যুত্থানকে তিনি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি দেখেছেন। যদিও তিনি নিজে ও তার সংগঠন সিপিডি (সেন্টার ফর পলিসি ডায়লগ) শেখ হাসিনা ও তার সরকারের বিরোধী অবস্থানে ছিলেন না। ভারতকে করিডোর দেয়ার ব্যাপারে প্রভাবিত করারও সর্বাত্মক চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ছাত্র -গণ আন্দোলনের তীব্রতা বাড়তে থাকলে তার মোকাবেলায় শেখ হাসিনার গৃহীত পদক্ষেপকে “অচিন্তনীয়” এবং আইন প্রয়োগকারী বাহিনীকে দেয়া তার নির্দেশকে “অমার্জনীয়” বিশেষণ দিয়ে আলোচ্য নিবন্ধে ব্যাখ্যা করেছেন ।তার লিখেছেন, “সেনাবাহিনী সৌভাগ্য বশত: পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি-র পথে না হেঁটে তার আদেশ অমান্য করে সঠিক কাজ করেছে।” তা না হলে “গণহত্যা ঘটে যেতে পারত।”
তার বিশ্লেষণে সেনাবাহিনীর নির্দেশ পালন না করার বিষয়টি যতটা গুরুত্ব পেয়েছে আন্দোলনে আপামর জনসাধারণের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি ততটা গুরুত্ব পায় নি। উপরন্তু তিনি দেখাতে চেয়েছেন এ রকম আদেশ অমান্য করার ঘটনা ১৯৯০ সালে ও ২০০৭ সালেও
ঘটেছিল। কিন্তু তার পিছনে ছিল রাজনৈতিক দলগুলোর আন্দোলন। ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনাকে দেশ ছাড়তে বাধ্য করেছে মূলত ছাত্র জনতা। রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের মধ্যে পলায়নী মনোভাব ছিল। সেনাবাহিনীকে নিরস্ত করার পিছনে ভূমিকা ছিল জাতিসংঘের ।
রেহমান সাহেব আরও কিছু বিষয় এড়িয়ে গেলেও ছাত্র জনতার অভ্যুত্থানের উপর জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনের ৫ শতাধিক পাতার রিপোর্ট যে “নির্ভরযোগ্য দলিল” হিসেবে কাজ করবে একথা তিনি স্পষ্ট করে বলেছেন। শেখ হাসিনা তিনটি ভূয়া নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় থেকে অর্থনৈতিক কাঠামোয় যে সব অপকর্ম করে গেছেন তা তার ভাষায়”হতবাক” করে দেয়ার মতো। তিনি একটি টাস্কফোর্স -এর রিপোর্টের তথ্যকে গুরুত্বপূর্ণ বিবেচনা করেছেন, যে রিপোর্টে অনেক “অন্ধকার” দিক ফুটে উঠেছে। তার মতে, অপকর্মের ভয়াবহ প্রভাব পড়েছে ব্যাংকিং খাতে।
তিনি তার বিশ্লেষণে সীমান্তের ওপারের অর্থাৎ ভারতের দৃষ্টিভঙ্গিকে “বিচ্যুত দৃষ্টিভঙ্গি” হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। তার শব্দ ব্যবহারের মুন্সীয়ানাও পাঠকের দৃষ্টি এড়াবার নয়। যেমন, শেখ হাসিনার “অন্তরঙ্গ পুঁজিপতি চক্রের লাগামহীন দুর্নীতি “, নির্বাচন জালিয়াতি, হত্যাকাণ্ড, মানবাধিকার লঙ্ঘন ইত্যাদি বিষয়গুলো ভারত সরকার সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে ইউনূস সরকারের বিরুদ্ধে খেয়াল খুশি মত কথা বলে যাচ্ছে। ফলে বিশ্বাসযোগ্যতা হারাচ্ছে। বিশ্বাসযোগ্যতা তার কি কাজে আসবে, যদি শেখ হাসিনা ও আওয়ামী লীগকে ব্যবহার করে ভারত তার হৃত কলোনি পুনরুদ্ধার করতে না পারে! ভারতকে নিয়ে রেহমান সোবহান সাহেবরা অধিক বাক্য ব্যয় না করে আমাদের কি করনীয়, সেকথা বলুন। মোদীজির ভারত এখন শুভবুদ্ধি থেকে বহুদূরে অবস্থান নিয়েছে। সম্মানজনক সম্পর্ক গড়া এবং তা বজায় রাখার জন্য কি করনীয় তা ভারত ভালই বোঝে। সে পথে হাঁটতে কি ইচ্ছুক ভারত? ভারত চায় বাংলাদেশকে তার শোষণের মৃগয়া ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করতে। আশিয়ান দেশগুলোর মধ্যে ব্যবসায়ীক লেন -দেনের ক্ষেত্রে যে ন্যায্যতা বিদ্যমান সেই নীতি মানলেও সার্ক অকার্যকর হতো না। ইসলামের সামাজিক সাম্যবাদকে বর্নবাদী ভারত কখনও সহজভাবে নিতে পারেনি। এটা দুর্ভাগ্যজনক যে মুক্তবুদ্ধির দাবিদার মুসলিম ভাবুকদের মধ্যে সাম্প্রদায়িকতা বিচারে মারাত্মক বিভ্রান্তি রয়েছে। মহাত্মা গান্ধী যাদের হরিজন বলতেন সেই দলিত শ্রেনীর লোকেরা ছিল ইংরেজ শাসকদের কাছে শেডুলকাষ্ট । এদের উন্নয়নের জন্য ম্যাকডোনাল্ড তার কমিউন্যাল অ্যাওয়ার্ডে কিছু সুবিধা সংরক্ষনের ব্যবস্থা রাখলে তেলে বেগুনে জ্বলে উঠেছিল বনেদি হিন্দু সম্প্রদায়ের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ। কারণ, এটা তাদের ধর্মীয় বিশ্বাসের অপরিহার্য অংশ বা বদ্ধমূল ধারণা যে, নিম্ন বর্ণের হিন্দুদের ইহজাগতিক জীবনে উন্নয়ন হবার নয়। পূর্ব জন্মের পাপের ফল হচ্ছে ইহজাগতিক দুঃখ দুর্দশা। শেডুলকাষট হিন্দুদের নেতা যোগেন্দ্র নাথ মণ্ডল এ কারণে মুসলমানদের সঙ্গে পাকিস্তান আন্দোলনে সম্পৃক্ত ছিলেন। বস্তুত, ভারত বিভক্তির মূলে ছিল ভারতীয় হিন্দু সম্প্রদায়ের অনুদার মনোভাব ও অমানবিক আচরণ। ন্যায্যতার অভাব দেখা দিলে সহোদর ভাইয়ের সঙ্গেও মানুষ থাকতে পারে না। আলাদা হয়ে যায়।
আমাদের অভিজ্ঞতার নাতি দীর্ঘ ইতিহাসে দুটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ঘটনায় এ সত্য প্রমাণিত। অনেক রক্ত, অনেক অশ্রু, অনেক বেদনা যুক্ত আছে সেই ইতিহাসের সঙ্গে। কিন্তু সংবেদনশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে আমাদের এ সংগ্রামের কাহিনীকে একটি গ্রন্থের দুটি অধ্যায় হিসেবে কেউ উপস্থাপন করেনি। ১৯৪৭-এর অর্জনকে পরিত্যাগ করতে গিয়ে আমরা আমাদের মহান নেতাদের অবদানকে আড়ালে ঠেলে দিয়েছি। ১৯৭১-এর অর্জনকে বড় করতে গিয়ে ছোট মাপের নেতাদের ফুলিয়ে ফাঁপিয়ে বড় করে তুলতে চেষ্টা করেছি। এই হাস্যকর চেষ্টায় ইতি টেনে ছোট বড় মিলিয়ে সবাইকে এক গ্যালাক্সিতে সাজিয়ে রাখলে সেটাই শোভন হতো এবং সবার প্রশংসা পেতো। সৎ, সাহসী ও নির্লোভ বুদ্ধিজীবির অভাবে
সেটা হয়ে ওঠেনি। সেটা করা হলে আজ আর কাউকে ইতিহাসের সামনে জুবুথুবু দিয়ে দাঁড়াতে হতো না বা দাঁড় করানো যেত না।
স্বল্পকালীন এই পার্থিব জীবনকে অর্থবহ করার নানা পথ ও পন্থা রয়েছে। ক্ষমতার নেশায় আসক্ত হলে অন্যান্য নেশার মতো তা থেকে মুক্তি পাওয়া কঠিন। রাষ্ট্র পরিচালনা করতে গিয়ে সিদ্ধান্ত নিতে ভুল হতে পারে কিন্তু মেরে কেটে ক্ষমতায় থাকতে হবে কেন? ভুলভ্রান্তি এক কথা আর প্রতিপক্ষকে নির্মূল করতে গুম খুন ফাঁসি কার্যকর করা ভিন্ন কথা। রাজনীতি যদি জনকল্যাণের ,সমাজ পরিবর্তনের উপায় না হয় , তাহলে সে রাজনীতি থেকে দূরে থাকাই সমীচীন। তরুণদের উদ্দেশে বলবো, তোমাদের সামনে কেবল ইউরোপ আর আমেরিকাকে রেখো না এশিয়ার দেশ চীন, জাপান ,দক্ষিণ কোরিয়া, সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার মতো দেশকেও রেখো।এসব দেশের তরুণ তরুণীরাও দৃপ্তপদে জীবনের পথে এগিয়ে যাচ্ছে । দক্ষতা ও যোগ্যতায় তোমাদেরকেও তাদের সমকক্ষ হয়ে উঠতে হবে। এ প্রসঙ্গে গাছের বেড়ে ওঠার উদাহরণ দিয়ে বলবো ঠিকমত আলো- বাতাস, জল আর সার পেলে যথা সময়ে ফুলেফলে ভরে উঠে গাছ, আর বেড়ে ওঠার কথা বলতে হয় না। তবে সময় মতো আগাছা পরিষ্কার করতে হয়, প্রয়োজনে কীটনাশক দিতে হয়। দেশ জাতির ভালো মন্দ নিয়ে যারা ভাবেন তাদের চিন্তা ভাবনার দিক নির্দেশনা অনুযায়ী গ্রহণ বর্জন করা শিখতে হবে। বিচার বিশ্লেষণের কষ্টি পাথরে যাচাই করতে হবে প্রত্যেককে। এজন্যই রেহমান সোবহান সাহেবের মতো প্রাজ্ঞ বর্ষিয়ানকে নিয়ে এই আলোচনা*
লেখক: সাংবাদিক,কলামিস্ট ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।

আরও পড়ুন
নাঙ্গলকোটে বিএনপির মনোনয়ন না পেয়ে রেলপথে টায়ার জ্বালিয়ে বিক্ষোভ
গণসংযোগের সময় বিএনপি মনোনীত প্রার্থীসহ ২ জন গুলিবিদ্ধ
রংপুরে রিটা রহমানকে নমিনেশনের দাবিতে বিক্ষোভ মিছিল, সংবাদ সম্মেলন