January 7, 2025

The New Nation | Bangla Version

Bangladesh’s oldest English daily newspaper bangla online version

Sunday, January 5th, 2025, 5:09 pm

শেষের বাঁশি কি শুনতে পাচ্ছেন রোহিত–কোহলি

রোহিত শর্মা (বাঁয়ে) ও বিরাট কোহলি: এএফপি

নিজস্ব প্রতিবেদক:
শুরুর সবকিছুই থাকে প্রতিশ্রুতিময়। যেমনটা রোহিত শর্মারও ছিল। ১৭৭ ও অপরাজিত ১১১—জোড়া সেঞ্চুরিতে অভিষেক। টেস্ট ক্রিকেটে এমন প্রতিশ্রুতিময় শুরু কজনেরই–বা আছে! লাল বলের ক্রিকেটে বিরাট কোহলির জন্মলগ্নটা আবার অতটা রঙিন নয়, অভিষেক টেস্টে করেছেন ৪ ও ১৫ রান। তবে লম্বা ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টকে যদি শুরু ধরা হয়, তাহলে কোহলির আরম্ভেও ছিল প্রতিশ্রুতি। ক্যারিয়ারের প্রথম ১০ টেস্টে দুটি সেঞ্চুরি, ফিফটি পাঁচটি। প্রথম সেঞ্চুরিটা আবার অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে তাদেরই মাটিতে।

কিন্তু প্রতিশ্রুতির পাপড়িগুলো মেলে ধরে সবাই কি আর পারে শতদল হয়ে ফুটতে! রোহিত ও কোহলি পেরেছিলেন। তাঁরা যে পেরেছিলেন, তাঁদের ক্যারিয়ারে চোখ রাখলে কেউই দ্বিমত করবে না। রোহিত–কোহলির টেস্ট ক্যারিয়ার কতটা সমৃদ্ধ, সেটা যত্ন করে পাট করে রাখা তাঁদের ক্যারিয়ারের ভাঁজগুলো ওলটালেই বোঝা যাবে। এ লেখা এগোতে এগোতে সেই ভাঁজগুলো নিশ্চয়ই খোলা হবে। এর আগে এ লেখার শিরোনাম ‘শেষের বাঁশি কি শুনতে পাচ্ছেন রোহিত–কোহলি’ কেন, তা একটু খোলাসা করা যাক।
যৌবনে যে গাছ ফুল আর ফলে সুশোভিত থাকে, সেও একসময় বয়সের ভারে বিবর্ণ আর জীর্ণশীর্ণ হয়ে নুয়ে পড়ে। দুর্বার প্রতিশ্রুতিও নিশ্চয়ই ক্রমে, খুব নীরবে পাণ্ডুর হবে—এটাই জাগতিক নিয়ম। বয়সের সঙ্গে কি আর যুদ্ধ চলে! বয়স বাড়বে, হাঁটুতে টান লাগবে। বয়স বাড়বে, দৃষ্টি ক্ষীণ থেকে ক্ষীণকায় হবে। বলতে পারেন, কী সব ফালতু কথা! রোহিত আর কোহলির কী এমন বয়স হয়েছে—সবে তো ৩৭ ও ৩৬ বছর। কিন্তু যেকোনো খেলোয়াড়ের ক্যারিয়ারেই তো এ বয়স গোধূলিবেলা। ক্রিকেটার, বিশেষ করে যাঁরা ব্যাটসম্যান, এ বয়সে দৃষ্টিশক্তির প্রখরতা কমে যাওয়ায় তাঁরা বল দেরিতে দেখবেন।

কোথায় হারিয়ে গেল বিরাট কোহলির সেই ছন্দকোথায় হারিয়ে গেল বিরাট কোহলির সেই ছন্দ:এএফপি

নিয়মিত জিম করা আর হিসাব করে খাবার খাওয়ার কারণে আগের চেয়ে খুব বেশি স্থুলকায় না হয়ে গেলেও নড়াচড়ায় কিছুটা হলেও শ্লথ হয়ে যাবেন। তাই পা নড়বে কম, মানে ফুটওয়ার্কে দেখা দেবে সমস্যা। আগে যেসব শটে দুর্বার ছিলেন, সেগুলো সাচ্ছন্দ্যে খেলতে পারবেন না। রোহিত–কোহলিরও হয়তো সেই সময় এসে গেছে। তাই তো আজ বোর্ডার–গাভাস্কার ট্রফি শেষ হওয়ার পর ব্যাট হাতে ব্যর্থ ভারতের ক্রিকেটের দুই মহাতারকাকে নিয়ে সংবাদ সম্মেলনে কোচ গৌতম গম্ভীরকে প্রশ্ন করা হয়েছিল—টেস্ট ক্রিকেটে রোহিত ও কোহলির কি ভবিষ্যৎ বাকি আছে? গম্ভীরের উত্তরটা ছিল কৌশলী, ‘আমি কোনো খেলোয়াড়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে বলতে পারি না। এটা আসলে তাদের ওপর নির্ভর করে। আমি যেটা বলতে পারি, তাদের মধ্যে এখনো ক্ষুধাটা আছে। এখনো খেলাটির প্রতি তাদের ভালোবাসা আছে।’

গম্ভীর কৌশলী হতে পারেন, পরিসংখ্যান তো আর তা নয়। বয়স আর সংখ্যা সব সময়ই নিরেট, বাস্তব আর আবেগহীন। খেলার প্রতি আপনার ভালোবাসা যতই থাক, বয়স সেটা বুঝবে কেন? বয়স আপনাকে বোঝাবে বাস্তবতা—অনেক হয়েছে, আর নয়! আর সংখ্যা দেবে ধারণা—একে দিয়েই চলছে বা একে দিয়ে আর হচ্ছে না! এ কারণেই ঘেঁটে আসা যেতে পারে রোহিত ও কোহলির সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স। সদ্য শেষ হওয়া ২০২৪ সালে ১০টি টেস্ট খেলেছেন কোহলি, মাত্র একটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটি। আর সর্বশেষ খেলা সিডনি টেস্টে তাঁর রান ১৭ ও ৬।

১২৩ টেস্টে ৪৬.৮৫ গড়ে ৩০ সেঞ্চুরি ও ৩১ ফিফটিতে ৯২৩০ রান করা কোহলির ক্যারিয়ারে ২০২৪–এর চেয়েও খারাপ বছর গেছে। ২০২০ সালে খেলা ৩ টেস্টে রান করেছেন মাত্র ১৯ গড়ে। ২০২০, ২০২১ ও ২০২২ সালে সেঞ্চুরি পাননি একটিও। কিন্তু ২০২৩ সালে আবার ফিরে পেয়েছিলেন নিজেকে। ১২ ইনিংসে দুটি করে সেঞ্চুরি ও ফিফটিতে প্রায় ৫৬ গড়ে করেছেন ১২২৬ রান। নিজেকে ফিরে পাওয়ার পর কোহলিই বলেছিলেন, মাঝের বাজে সময়টায় তিনি শুধু সুসময়টাকেই ভাবতেন। কোহলির ১৪ বছরের টেস্ট ক্যারিয়ারে সেই সুসময়ের গল্পটা এ রকম—তখন তিনি কোনো বছরে আশির কাছাকাছি গড়ে রান তুলতেন, কোনো বছরে তুলতেন আড়াই হাজারের কাছাকাছি রান। কোনো কোনো বছর পেতেন পাঁচটি–চারটি করে সেঞ্চুরি।

ভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা অবশ্য এখনই হার মানতে রাজি ননভারতের অধিনায়ক রোহিত শর্মা অবশ্য এখনই হার মানতে রাজি নন:এএফপি

রোহিতের শুরুই তো হয়েছিল সুসময় দিয়ে! ২০১৩ সালে শুরু ক্যারিয়ারে এরপর পতনের চেয়ে উত্থানই দেখেছেন বেশি। কখনো নব্বইয়ের বেশি গড়ে রান করেছেন। এক বছর তো তিন ইনিংস খেলে আউটই হননি, গড় ২১৭! সেই রোহিতেরই কিনা সর্বশেষ ১৫ ইনিংসে সর্বোচ্চ স্কোর ৫২। ২০–এর ওপর রান করেছেন মাত্র একবার—২৩।
কিন্তু সাদা পোশাকের ক্রিকেটে রোহিত–কোহলিদের আজকালটা বড় বেরঙনি। কিছুই যেন রাঙাতে পারছেন না তাঁরা। পরিস্থিতিটা এমন দাঁড়িয়েছে—সংবাদমাধ্যম আর যোগাযোগমাধ্যমের সমালোচনার তীব্র স্রোতের বিপরীতে তরি ভাসানোর সাহসও যেন হারিয়ে ফেলেছেন রোহিত! সিডনি টেস্ট থেকে নিজে থেকেই সরে দাঁড়িয়েছেন।

ভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা সিডনি টেস্ট থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকেভারত অধিনায়ক রোহিত শর্মা সিডনি টেস্ট থেকে সরিয়ে নিয়েছিলেন নিজেকে:এএফপি

এক টেস্টের জন্য সাহসটা হারিয়ে ফেললেও মনের জোর হয়তো এখনো কমেনি রোহিতের। তাই তো যেসব ক্রিকেটবোদ্ধা, ক্রিকেট লিখিয়ে বা সাংবাদিক তাঁর ক্যারিয়ারের এপিটাফ লিখে ফেলেছেন, তাঁদের উদ্দেশে বলেছেন, ‘ধারাভাষ্যকক্ষে যাঁরা বসে আছেন কিংবা ল্যাপটপে যাঁরা লেখেন, তাঁরা ঠিক করবেন না আমার জীবন কীভাবে যাবে। অনেক দিন ধরে খেলাটা খেলছি, তাঁরা ঠিক করবেন না, আমি কখন খেলব, কীভাবে খেলব, কখন অধিনায়কত্ব করব কিংবা কখন সরে দাঁড়াব।’ কোহলি এর আগে সমালোচনার জবাব কড়াভাবে দিলেও এবার এখন পর্যন্ত মুখ খোলেননি। কে জানে কখন, কোথায় রোহিতের মতো তিনিও সমালোচকদের দিকে পাল্টা তির ছোড়েন!

সে নাহয় সময় পেলে ছুড়বেন, কিন্তু দুজনের সাম্প্রতিক পারফরম্যান্স ঘেঁটে কী পাওয়া গেল? একটা বাস্তবতা বোঝার সময় এখনই হয়তো তাঁদের দুজনেরই হয়ে গেছে, যে বাস্তবতার কথা পুর্ণেন্দু পত্রী লিখে গেছেন তাঁর কবিতায়—‘স্বপ্নেই শুধু দ্বিতীয়বার ফিরে পাওয়া যায় শৈশব…স্বপ্নেই শুধু আরেকবার অগাধ জলের ভিতর থেকে/ মুখ তুলে তাকায় ছেলেবেলার লাল শালুক।’ রোহিত–কোহলিকে হয়তো এটাও বুঝতে হবে—একসময়ের তুমুল বীরকেও একদিন বয়সের কাছে নতজানু হতে হয়, সুতীক্ষ্ণ আর আয়নার মতো স্বচ্ছ ও চকচকে তলোয়ারে একদিন মরচে ধরে!